এক্সট্রা কাভার
ক্রিকেটের সেই দিনগুলো
রীতিমতো সাবেকের খাতায় চলে গেছে নামগুলো এবং তাও নয় নয় করে প্রায় তিন দশক। তারপরও শফিকুল হক হীরা, রকিবুল হাসান, ইউসুফ বাবু,রবিন, ইশতিয়াক আহমেদ, এ এস এম ফারুক, নামগুলো এখনো একটা প্রজন্মের কাছে যথেষ্ট শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হয়। কারণ, বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম প্রজন্ম তাঁরা। রেকর্ড বই দিয়ে এদের মাপা কঠিন। মাপার চেষ্টা করাও ঠিক হবে না। বাংলাদেশের হয়ে আহামরি রেকর্ড এদের কারোরই নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভিত্তিপ্রস্তরটা গেঁথেছিলেন যে এঁরাই হাত ধারাধরি করে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দিনে দিনে আকাশমুখী বিশাল এক ইমরাত হয়ে উঠছে। সেই ইমারতের ভিত গড়ার কাহিনীটা প্রায় অজানাই কয়েকটা প্রজন্মের কাছে। অথচ এক প্রজন্ম থেকে আরেকটা প্রজম্মের কাছে সেই কাহিনী ছড়িয়ে পড়া উচিত। স্বাধীনতার উষালগ্নে যে সব ক্রিকেটারের অন্তত পরিশ্রম আর নিরলস সাধনায় বাংলাদেশ ক্রিকেটের পথ চলা শুরু, তাঁদের জনাকয়েককে সম্প্রতি এক আড্ডায় ডেকেছিল বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন- বিএসজেএ। উদ্দেশ্য ছিল এঁদের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্পটা অন্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
আড্ডা। কখনো কখনো আর নিছক আড্ডা থাকে না। খুলে দেয় ইতিহাসের নতুন জানালা। বেরিয়ে আসে ছোট ছোট অথচ তাৎপর্যপূর্ণ কাহিনী। বিএসজেএর আড্ডাটাও সেদিন রূপ নিয়েছিল আদ্যান্ত ক্রিকেট সমর্পিত কিছু প্রাণের মিলনে। যাদের কেউ সাবেক ক্রিকেটার। কেউ সাবেক ক্রিকেট কোচ। কেউ সাবেক সাংবাদিক (সাংবাদিকরা সাবেক হয়ে যান সেটা অবশ্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না)। কেউ ক্রিকেট সাংবাদিকতায় এই সময়ের প্রতিনিধি। তবে সব কিছুর আগে কৃতজ্ঞচিত্তে অভিনন্দন জানাতে হয়; সেই আড্ডার আয়োজকদের। কারণ, ওই রকম একটা আয়োজন ছাড়া হয়তো জানা যেত না; বাংলাদেশের নানা ক্রিকেটীয় ঘটনা আবিষ্কৃত হতো না অনেকের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গুরুত্বপূর্ণ মোড়। আবার এই ক্রিকেট আড্ডাটা না হলে হয়তো ছাব্বিশ বছর পর বিএসজেএতে প্রত্যাবর্তন হতো না ক্রীড়া সাংবাদিকতায় বাংলাদেশের অন্যতম পথিকৃত মুহাম্মদ কামরুজ্জামানের! কোনো এক অজানা অভিমনে এত বছর দূরেই ছিলেন তিনি বিএসজেএ থেকে। ক্রিকেট আর সাবেক ক্রিকেটারদের কাছে বিএসজেএও কৃতজ্ঞ থাকতে পারে; ওই আড্ডার সৌজন্যে তাঁরাও ফিরে পেল তাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্যকে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে আজ রোল মডেলের অভাব নেই। সাকিব-তামিম-মাশরাফি-মুশফিক এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক বড় তারকা। ওদের দেখেই হবু ক্রিকেটাররা ঝুঁকছে ক্রিকেটে। মা-বাবারা স্বপ্ন দেখছেন ছেলেকে বড় ক্রিকেটার বানানোর। আবার অনেক টিন এজার তারকা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর আছে অথচ তারা জানে না ওই গ্রহে পৌঁছাতে কত পরিশ্রম আর কত ঘাম ঝরাতে হয়। তবে তারাও সৌভাগ্যবান নিজেদের রোল মডেলের রক্তে-মাংসের শরীরটাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাচ্ছে।
কিন্তু রকিবুল হাসান-ইউসুফ বাবুরা? নিজের ছোট বেলার ‘হিরো’কে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা অনেক পরে। রকিবুল হাসান- –ইউসুফ বাবু; বাংলাদেশ দলের দুই উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান। ক্যারিয়ারের শুরুতে পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বড় ফাস্ট বোলারের বিপক্ষে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। সাফল্যও যে একেবারে ছিল না তাও নয়। তারপরও পাক ক্রিকেট মহলে বাঙালি বলে নাক সিটকানো ছাড়া কী পেয়েছিলেন তাঁরা! তাঁদের ক্রিকেটীয় দক্ষতা-যোগ্যতাকে পাকিস্তানিরা কখনোই সেভাবে স্বীকার করতে চায়নি। পূর্ব পাকিস্তানের ক্রিকেটকে দেখা হতো একটা নেগেটিভ মনোভাব নিয়ে। যে কারণে পাকিস্তানের হয়ে টেস্ট খেলাই হলো না রকিবুলের! তবে রকিবুল-ইউসুফ বাবু দুজনেরই ক্রিকেট আইডল ছিলেন হানিফ মুহাম্মদ। ‘হানিফ মুহাম্মদের অনেক কিছু অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি আমি। তিনিই ছিলেন আমার আইডল। আমাদের কাছে তখন ব্যাটসম্যানশিপের শেষ কথা হানিফ মুহাম্মদ। ঢাকা স্টেডিয়ামে স্যার গারফিল্ড সোর্বাসসহ অনেক বড় বড় ক্রিকেটারকে খেলতে দেখেছি। কিন্তু কেন যেন মনের মধ্যে গেঁথে গেল হানিফ মুহাম্মদ!’ নিজের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্পের একপর্যায়ে সেদিন বলছিলেন ইউসুফ বাবু। উঠতি তরুণ ক্রিকেটার রকিবুল হাসানের কাছে হানিফ মুহাম্মদ ছিলেন বড় এক ব্র্যান্ডনেম। হাইটে রকিবুলও হানিফ মুহাম্মদের মতো ছোটখাটো।আর রকিবুল হাসানের উঠে আসার সময় হানিফ মুহাম্মদ পাকিস্তান ক্রিকেটের প্রায় প্রবাদ পুরুষ হয়ে উঠেছেন। তাই হানিফ মুহাম্মদের ব্যাটিং স্টাইল রকিবুলের কাছে প্রায় শেষ কথা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে হানিফ মুহাম্মদের পাকিস্তানের হয়ে খেলা হয়নি এদের কারোই আর। তবে বাংলাদেশ দলের ব্লেজার পরে হানিফ মুহাম্মদের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাঁদের দুজনেরই।
বাংলাদেশ দলের ব্লেজার যখন রকিবুল-ইউসুফ বাবু-শফিকুল হক হীরা-ইশতিয়াকরা পরেছেন; সে সময়ের বাংলাদেশ ক্রিকেট আর আজকের বাংলাদেশ ক্রিকেটের মাঝে তুলনা করার কোনো সুযোগ নেই। এমন একটা সময় তাঁরা ক্রিকেট খেলেছেন যখন ভালো ব্যাট-গ্লাভস-প্যাড পর্যন্ত পেতেন না তাঁরা। উইকেট বলতে বেশির ভাগই ছিল ম্যাট। প্র্যাকটিসের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বলতে কিছু খুঁজেই পাওয়া যেত না বাংলাদেশ ক্রিকেট মানচিত্রে! তবু তাঁরা ক্রিকেট খেলেছেন। লড়াই করেছেন বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে তুলে ধরতে। আর এখন সাকিব-মুশফিক-তামিম-সৌম্যদের লড়াই বিশ্বক্রিকেটে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করা। নিজেদের পারফরম্যান্স তুলে ধরা। বাংলাদেশ দলের তারকা থেকে বিশ্ব ক্রিকেটের তারকা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা। তাঁদের এই লড়াইটাও অনেক কঠিন। তবে সবার লড়াইয়ের ইতিহাসটা ক্রিকেটপ্রেমীদের জানা দরকার। আধুনিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ হয়তো নতুন। কিন্তু তার ক্রিকেট পরম্পরা অনেক পুরনো। সেটা মাঝে মধ্যে নতুন করে জানা দরকার।