বিদেশনীতি
মোদির সফর, নীল আকাশের হাতছানি
৩৬ ঘণ্টার সফর শেষে দিল্লির বিমানে পা দেওয়ার আগে এক টুইট বার্তায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি বলেছেন, ‘ধন্যবাদ বাংলাদেশ। এই সফর আমার স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে থাকবে। এই সফর বাংলাদেশ-ভারত অংশীদারিত্ব আরো সুদৃঢ় করবে।’ ঢাকা সফরের অর্জন তুলে ধরে তিনি আরো বলেন, এই সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমরা অতীতে অমীমাংসিত বিষয়গুলো সাফল্যের সঙ্গে কাটিয়ে উঠেছি। এটি আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করবে। ভারতকে আঞ্চলিকতার গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বশক্তির আসনে নেওয়ার স্বপ্নচারী মোদি প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে পাশে রাখার অঙ্গীকার করেছেন। উপরন্তু বিশ্বশক্তি হিসেবে ভারতকে তুলতে সমর্থনের প্রত্যাশাও প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে দুই দেশের সম্পর্কের গভীরতা বোঝাতে দুই দেশের অভিন্ন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষার সঙ্গে ক্রিকেটপ্রীতির কথাও বলে গেছেন। ‘একটি বাক্যে যদি আমাকে বলতে হয়, তাহলে বলব, লোকেরা মনে করত আমরা খুব আশপাশে রয়েছি, এখন বিশ্ববাসীকে বিশ্বাস করতে হবে আমরা আশপাশে রয়েছি, একসাথেও রয়েছি।’ নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের উন্নতির প্রশংসা করেছেন তিনি। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিকে সাধুবাদ জানান মোদি। বলেন, ‘তাদের (সন্ত্রাসী) কোনো দেশ নেই, আদর্শ নেই, সংস্কৃতিও নেই। তাদের পরিচয় একটাই, তারা মানবতার শত্রু।’ মে মাসের প্রথম সপ্তাহে স্থল সীমান্ত চুক্তি কার্যকরের পথ খোলার পর ৬ জুন বাংলাদেশ সফরে আসা মোদি সে সম্পর্কে বলেছেন, ‘খুব কম মানুষই এটাকে মূল্যায়ন করতে পেরেছে যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্থলসীমান্ত চুক্তি, এটি শুধু জমি সংক্রান্ত বিবাদের সমাধান নয়, যদি কেউ মনে করে দু-চার কিলোমিটার জমি এদিক ওদিক গিয়েছে, এটা কিন্তু সেই চুক্তি নয়। এটা সেই চুক্তি, যা মনকে যুক্ত করেছে।’ প্রকৃত প্রস্তাবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরে অনেকগুলো সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। আঞ্চলিক যোগাযোগ, রফতানি বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আঞ্চলিক যোগাযোগ বা কানেকটিভিটির আওতায় ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভুটান ও নেপালে পণ্য সরবরাহ করতে পারবে বাংলাদেশ। একইভাবে ভারত বাংলাদেশের ভূখণ্ড ও বন্দর ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পাঠাতে পারবে। এ জন্য বাংলাদেশকে নির্দিষ্ট হারে মাশুল প্রদান করবে ভারত। বাণিজ্য চুক্তির আওতায় ভারতে রফতানি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হবে। ভারতের সঙ্গে বড় অঙ্কের যে বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, তা দূর হবে রফতানি বাণিজ্যের মাধ্যমে। এ ছাড়া জ্বালানি ও সেবাসহ বিভিন্ন খাতে ভারতের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার সম্ভাবনা বেড়েছে।
বঙ্গবন্ধু কনভেনশন সেন্টারে ৭ জুন দেওয়া নরেন্দ্র মোদির ভাষণের সূত্র ধরেই বলা যায়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই মুহূর্তে ভারতকে ভাবা হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের এবং বন্ধুপ্রতিম দেশ। তা ছাড়া ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগ ও কংগ্রেসের বন্ধুত্বের বিষয়টি সর্বজনবিদিত। ফলে ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার গঠনের পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন আসছে কি না বা নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্কই বা কী হতে যাচ্ছে, তা নিয়েও জনমনে ছিল ব্যাপক কৌতূহল। তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষপর্যন্ত যখন নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এসে বিশ্বস্ত বন্ধুত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তখন পুরোনো সম্পর্কের নতুন প্রত্যাশা জেগে উঠেছে। মোদির সফরের পর ছিটমহলের মানুষ এখন তাদের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস থেকে মুক্তি পেয়েছে। সফরের প্রথম দিনে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, যোগাযোগ ও সংযোগ বিষয়ে একাধিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। স্বাক্ষর হয়েছে উপকূলীয় নৌ-চলাচল চুক্তি এবং অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল প্রটোকল। এ দুটি চুক্তির ফলে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতে পণ্য পরিবহনের পথ সুগম হবে এবং বাংলাদেশি সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হচ্ছে ভারতীয় কয়েকটি বন্দরের। এ ছাড়া, ঢাকা-শিলং-গৌহাটি এবং কলকাতা-ঢাকা আগরতলা- এই দুটো রুটে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাস চলাচলও উদ্বোধন হয়েছে। তবে, সংযোগ সংক্রান্ত এসব চুক্তির ফলে ভারতই বেশি লাভবান হচ্ছে বলে মনে করেন কেউ কেউ। কারণ ভারতের পাওয়া এ ক্ষেত্রে অসামান্য, কারণ তাদের উত্তরের রাজ্যগুলোর সঙ্গে যে দীর্ঘদিনের সমস্যা, সেটা এখন প্রায় মিটে যাবে। তবে সীমান্ত আরো সুসংহত হয়েছে। এ ছাড়া ভারত বিনিয়োগ নিয়ে আসছে, সেটাও ভালো খবর। দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ধারা আগের মতোই অব্যাহত থাকবে। অনেক সময়ই সরকার বদলের পরপরই প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক বদলে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে যে সম্পর্ক ছিল, এখনো তারই একটি ধারাবাহিকতা দেখা যাচ্ছে। এটাও বাংলাদেশের জন্য একটি বড় অর্জন।
আগেই বলেছি, মোদির সফরের সূত্রে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, উপকূলীয় জাহাজ চলাচল ও দুই রুটে বাস চলাচলের বিষয়ে চারটি চুক্তিসহ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মোট ১৯টি চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক সই হয়। ছয় চুক্তি ও প্রটোকলের মধ্যে রয়েছে- দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি (নবায়ন), উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি, অভ্যন্তরীণ নৌ-ট্রানজিট ও বাণিজ্য প্রটোকল (নবায়ন), বাংলাদেশ স্টান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) ও ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্টান্ডার্ডসের (বিআইএস) মধ্যে মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা চুক্তি এবং কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা ও ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি বাস চলাচলে দুটি চুক্তি ও প্রটোকল। ১৩টি এমওইউ ও আধা সরকারি এমওইউ হলো- ভারত-বাংলাদেশের কোস্টগার্ডের মধ্যে সমঝোতা, মানবপাচার প্রতিরোধের বিষয়ে, পাচার ও জাল নোটের বিস্তার প্রতিরোধ, ২০০ কোটি ডলারের ভারতীয় নতুন ঋণচুক্তির বিষয়ে সমঝোতা, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে ব্লু- ইকোনমি ও সমুদ্রসীমা বিষয়ে সমঝোতা এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার নিয়ে সমঝোতা স্মারকে সই হয়েছে। সমঝোতা চুক্তিগুলোর আরো রয়েছে- জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সার্কের জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ভারতীয় সহায়তার (আইইসিসি) অধীনে প্রকল্প, ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন, ২০১৫-১৭ সালের জন্য সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি, বাংলাদেশ-ভারত শিক্ষা সহযোগিতা বিষয়ে সম্মতিপত্র। এ ছাড়া আখাউড়ায় ইন্টারনেটের জন্য আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইথ ইজারার বিষয়ে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি (বিএসএনএল) ও ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেডের (বিএসসিসিএল) মধ্যে সমঝোতা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও নয়া দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ এবং কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ ইন্ডিয়ার মধ্যে আরেকটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। সরকার দেশে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চার হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভারতের দুটি কোম্পানির সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে।
বর্তমান সরকার সব সময়ই কানেকটিভিটির ওপর জোর দিয়েছে। নরেন্দ্র মোদির সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিরাট লাভবান হবে। বাংলাদেশের দিক থেকে এটি একটি সফল সফর। এই সফরে জনগণের সব ধরনের প্রত্যাশা পূরণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সফরটি ইতিবাচক এই কারণে যে নরেন্দ্র মোদি বিজেপি নেতা তাই তাঁর সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা ছিল তার একটি পরিবর্তন এসেছে। তা ছাড়া যে চুক্তিগুলো হয়েছে, তাতে যোগাযোগের বাধাগুলো দূর হবে। সারা বিশ্বের ঝানু ঝানু রাজনীতিবিদদের মাত্র ২৫ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মোদি দেখিয়ে দিচ্ছেন রাজনীতি কীভাবে করতে হয়। তাঁর চরম বিরোধিতাকারীরাও ধীরে ধীরে তাঁর ভক্ত হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতিতেও ‘প্রফেশনালিজম’ যে আজ কত জরুরি সেটা তাঁকে দেখে বোঝা গেল। আশা করি, দুদিনের সফরে মোদি বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে গেলেন যে শেখ হাসিনা ছাড়া, আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কারো পক্ষে এমন উন্নতির ধারা বজায় রাখা সম্ভব নয়। আশা করি এটাও বুঝে গেছেন যে শেখ হাসিনা কোনো সন্ত্রাসীদের ছাড় দেবেন না, জঙ্গিবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন না, নাশকতাকারীদের সঙ্গে সংলাপ করবেন না; তাঁর লক্ষ্য একটাই- বাংলাদেশের উন্নয়ন। নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনার রাজনীতির লক্ষ্য মানুষের কল্যাণ করা। সেই লক্ষ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার মাইলফলক সৃষ্টি হয়েছে ৬ ও ৭ জুনের মোদির সফরে।
(ড. মিল্টন বিশ্বাস, সহযোগী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) writermiltonbiswas@gmail.com