প্রতিক্রিয়া
জি-৭ সম্মেলন ও সন্ত্রাসবাদ দমন
জার্মানির নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত দক্ষিণ বাভারিয়ার আল্পসের বিলাসবহুল এলমাউ ক্যাসল রিসোর্ট। উপস্থিত ছিলেন স্বাগতিক জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মারকেল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ, ইতালির প্রধানমন্ত্রী মাত্তিও রেনজি, কানাডার প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার এবং জাপানের প্রধানমন্ত্রী সিনজো আবে। আরো ছিলেন জাতিসংঘ, আন্তজার্তিক মুদ্রা তহবিল (আই এমএফ), বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান কর্তা ব্যক্তিরা। আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন ইরাকি প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল এবাদি, নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুহারি, তিউনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট বেজি এসেবসি।শিল্পোন্নত দেশ হলেও তাদের সারা বিশ্বের সব রাষ্ট্রের কল্যাণ সাধনের জন্যই কাজ করতে হয়। কেননা এই সম্মেলনের অনেক সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা সমগ্র বিশ্বের রাজনীতিকেই প্রভাবিত করে। তাই আগামী দিনের পৃথিবীর জন্য নানা বিষয়ে তাদের ঐকমত্য একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়। জি-৭ সংগঠনটি মূলত একটি অর্থনৈতিক সংগঠন। আর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অর্থনৈতিক কূটনীতি বলতে অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পরিচালিত কলা-কৌশলকেই বুঝানো হয়।
যৌথ ভবিষ্যতের আলোচনার মধ্য দিয়ে শেষ হলো এবারের জি ৭-এর সম্মেলন। সবাই ঐকমত্যে পৌঁছান বিশ্বব্যাপী জঙ্গি হামলার বিষয়ে সামরিক শক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে।বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, আধুনিক বিশ্ব নিরাপত্তা ধারণার অন্যতম একটি বিবেচ্য বিষয় হলো সন্ত্রাসবাদ। সন্ত্রাসবাদ বলতে আমরা নিরস্ত্র লোককে হত্যা, গুপ্ত হামলা জঙ্গিবাদ কিংবা হিংসাত্মক কার্যকলাপ এগুলোকেই বুঝে থাকি। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী এসব কর্মকাণ্ড বেড়েই চলেছে। আর এবারের জি-৭ সম্মেলনে এই বিষয়ের ওপর জোর দেওয়ায় তা বিশ্ববাসীর জন্য কতটুকু সফলতা আনতে পারে তা সময়ই বলে দেবে। কেননা মূলত সন্ত্রাসবাদ এমন একটি ধারণা যা প্রত্যেকটি রাষ্ট্র কিংবা সংগঠন তার নিজস্ব স্বার্থের সাথে সঙ্গতি রেখে এই শব্দটিকে ব্যবহার করে থাকে। এ ছাড়া এবারের সম্মেলনের অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল বৈশ্বিক অর্থনীতি, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আরো শক্তিশালী করে তোলা, আটলান্টিকের দুই পারের ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সমস্যা চিহ্নিত করণে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোসহ আরো বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ইস্যুতে যৌথ মোকাবিলার কথা। এবারের সম্মেলনে জলবায়ুর সমস্যা মোকাবিলার বিষয়ে যে প্রসঙ্গটি উঠে এসেছে তাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কেননা এই সমস্যা ব্যাপকহারে সৃষ্টির ফলে বর্তমানে পৃথিবী হুমকির মুখে পড়ছে। মানুষের নানাবিধ অবিবেচকের মতো কার্যকলাপ এর জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দায়ী। এবারের সম্মেলনে অবশ্য বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি বিরুপ প্রভাব পড়ে দরিদ্র দেশগুলোর ওপর। তাই তাদের জন্য একটি তহবিলে সহায়তা দানের কথাও বলা হয়। যা নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ দমনের বিষয়ে আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে আলোচনা হয় আইএস এবং বোকো হারাম জঙ্গি হুমকি মোকাবেলার প্রসঙ্গে। বিশ্বব্যাপী যে জঙ্গি হুমকি রয়েছে তাকে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন ডেভিড ক্যামেরন। উপস্থিত বিশ্বের নেতারা আইএস এবং বোকো হারাম জঙ্গি তৎপরতার বিষয়ে সামরিক শক্তি অব্যাহত রাখার বিষয়ে মত দেন। এবারের সম্মেলনে ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়ার বিষয়ে কঠোর মনোভাব প্রয়োগ করেন বারাক ওবামা এবং অ্যাঙ্গেলা মারকেল।
জি ৭-এর এবারের সম্মেলনের মধ্য থেকে স্পষ্টতই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, রাশিয়ার ওপর থেকে খুব শিগগিরই উঠছে না পশ্চিমা নিষেধাঞ্জা। কেননা সম্মেলনে বিশ্বের শক্তিধর যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানি এমনই কথা বলেছে। এবারের সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বার বারই বলেছেন ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। পশ্চিমারা বলছেন ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে রাশিয়া সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়ে কিয়েভকে চাপে রেখেছে। কিন্তু রাশিয়া এ কথা সব সময়ই অস্বীকার করে আসছে।এ ছাড়া সম্মেলনে রাশিয়ার নানাবিধ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। বলা হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের বিশেষ করে ন্যাটোর নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি রাশিয়া। কিন্তু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন অবশ্য বেশ কয়েকদিন ধরেই বলে আসছেন, রাশিয়া পশ্চিমা বিশ্বের জন্য হুমকি নয়। এ ছাড়া তিনি ইউক্রেনে শান্তিচুক্তির পক্ষেই মত দিয়েছেন। এ ছাড়া রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি তাঁর এক স্বাক্ষাৎকারে এটাও বলেছেন, রাশিয়া ও ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বড় কোনো সংঘর্ষের আশঙ্কা নেই। অন্যদিকে পূর্ব ইউক্রেনে রুশপন্থী বিদ্রোহীদের সহায়তা করার বিষয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ পশ্চিমাদের। কিন্তু রাশিয়া তা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।
বর্তমান জি-৭। এর শুরুর সময়টা ছিল ১৯৭৫ সাল। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ইতালি ও জাপান শিল্পোন্নত এই ছয়টি সদস্য রাষ্ট্র নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় এই সংগঠনটি। নাম ছিল এ-৬। সদস্য দেশগুলোর পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা চাই। এই উদ্দেশ্য নিয়েই প্রতিষ্ঠা। ১৯৭৬ সালে এর সদস্য হিসেবে যোগ দেয় কানাডা। ১৯৯৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এতে যোগ দেয় রাশিয়া। তখন এর নাম হয় জি-৮। এর পর থেকে এই সংগঠন জি-৮ নামেই পরিচিত হয়ে আসছিল।কিন্তু গত বছর ইউক্রেনের ক্রিমিয়া নিজেদের একীভূত করে নেওয়ার কারণে সংগঠনটি থেকে রাশিয়ার পদ স্থগিত করা হয়। সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৭-এ। এখন এর নাম জি-৭। এবার অর্থাৎ গত ৬ জুন থেকে ৭ জুন অনুষ্ঠিত হলো এর ৪১তম সম্মেলন। সংগঠনটির ২০১৬ সালে ৪২তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে জাপানে।বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে ৪১তম সম্মেলনের নানা ঘোষণা ও বাস্তবায়নের দিকে।
লেখক : অনুবাদক ও বিশ্লেষক।