তুরস্ক নির্বাচন

বিদায় একদলীয় শাসনব্যবস্থা

Looks like you've blocked notifications!

তুরস্কের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে দুটো বড় ঘটনা ঘটেছে। প্রথমত, পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির (এইচডিপি) বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছে। এই প্রথম তারা ১৩ শতাংশ ভোট পেয়ে দলীয়ভাবে পার্লামেন্টে যাচ্ছে। তুরস্কের আইন অনুযায়ী, সংসদে আসন পেতে অন্ততপক্ষে ১০ শতাংশ ভোট পেতে হয়। এর কম আসন পেলে আসনগুলো অধিক ভোটপ্রাপ্ত দলগুলোর মধ্যে বোনাস আসন হিসেবে বণ্টন করা হয়।

দ্বিতীয়ত, দীর্ঘ ১৩ বছর পর তুরস্কের ক্ষমতাসীন ইসলামপন্থী দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) পার্লামেন্ট একক আধিপত্য হারিয়েছে। দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, একেপির এই ভোটব্যাংক কমে যাওয়ায় বোঝা যাচ্ছে, তুরস্ক আর একক কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় থাকছে না। এরদোগানকে এখন জোট গঠন করে ক্ষমতায় বসতে হবে। ধারণা করা হচ্ছিল, এ নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয় পেলে নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের একচ্ছত্র শাসন চালু করতেন তিনি। যেহেতু দুই-তৃতীয়াংশ আসন তিনি পাননি, তাই সাংবিধানিকভাবে আর সেই ক্ষমতা তিনি পাচ্ছেন না।

কাজেই এই পর্যালোচনা থেকে আমরা বলতে পারি, তুরস্কে একটি স্বচ্ছ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। যদি জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এককভাবে ক্ষমতায় বসত, তাহলে বিদেশি গণমাধ্যমে এই নির্বাচনের স্বচ্ছ্বতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হতো। তখন ‘ফ্রি কান্ট্রি’ হিসেবে তুরস্ককে সম্বোধন করা হতো না, যেমনটি এখন করছে কোনো কোনো মিডিয়া। অথচ নির্বাচনের আগে লেখা হচ্ছিল, তুরস্ক ক্রমে স্বৈরাচারী শাসনক্ষমতার হাতে চলে যাচ্ছে। গণতন্ত্র অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে, কুক্ষিগত হচ্ছে ব্যক্তি-স্বাধীনতা।

ভোটের ফলাফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ২০১১ সালে একেপি যেখানে ৫০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পেয়েছিল, সেখানে এবার পেয়েছে মাত্র ৪১ শতাংশ ভোট। বেসরকারি ফল অনুযায়ী, ৯৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ ভোটের মধ্যে একে পার্টি পেয়েছে ৪০ দশমিক ৭৮ শতাংশ ভোট। ২৫ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রিপাবলিকান পিপলস পার্টি। এ ছাড়া ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টি ১৬ দশমিক ৩৮ ও পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি ১২ দশমিক ৯৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে। তুরস্কের সংসদের ৫৫০টি আসনের মধ্যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে ২৭৬ আসন পেতে হয়। কিন্তু ৪০ দশমিক ৭৮ শতাংশ ভোট পেয়ে একে পার্টি পেয়েছে ২৫৮ আসন। সিএইচপি পেয়েছে ১৩২ আসন। এ ছাড়া এমএইচপি ৮১টি এবং এইচডিপি পেয়েছে ৭৯টি আসন। এখন এরদোগানের একেপিকে সরকার গঠনের জন্য সমমনা কোনো দলের সঙ্গেই জোট বাঁধতে হবে। এ ক্ষেত্রে একে পার্টি জয়ী হলেও তাদের ভেতর পরাজয়ের একটা বোধ কাজ করবে। তারা মনে করতে পারে, কুর্দি ভোটাররা পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির দিকে ঝুঁকেছে বলে তাদের এই ‘পরাজয়’। অবশ্য একে পার্টির আসনসংখ্যা কম পাওয়ার পেছনে দেশটির প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পিপলস পার্টি কোনো প্রভাবকের ভূমিকা পালন করতে পারেনি। তারা নিজেরাই বরং গতবারের চেয়ে ১ শতাংশ কম ভোট পেয়েছে। অর্থাৎ একেপির ভোটের একটা মোটা অংশ গিয়ে জমা পড়েছে এইচডিপির ভোটব্যাংকে। ধারণা করা হচ্ছে, ৩ থেকে ৪ শতাংশ কুর্দি ভোটার একে থেকে সরে এসেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই নির্বাচনের পর তুরস্কে রাজনৈতিক ভারসাম্য ধরে রাখা কঠিন হবে। এরদোগান যদিও বলছেন, ‘আমি আশা করি, নির্বাচনে কোনো একক দল ক্ষমতায় বসতে পারার বিষয়টি ইতিবাচকভাবে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলগুলো একটা প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াবে।’ কিন্তু আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কাজটি স্বয়ং এরদোগানের জন্যই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এখন পর্যন্ত প্রধান তিন বিরোধী দল বলেছে, তারা কেউ একেপির সঙ্গে জোট গঠন করবে না। সে ক্ষেত্রে পুনরায় নির্বাচনের কথা ভাবতে হবে দেশটির নির্বাচন কমিশনকে। সব মিলিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়াবে এত দিন একদলীয় শাসনব্যবস্থায় থাকা তুরস্ক। তাই তো অনেকে বলছেন, ‘বিদায় একদলীয় শাসনব্যবস্থা, হ্যালো রাজনৈতিক অস্থিরতা।’

লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক।