বিশ্লেষণ

অস্কার, ট্রাম্প ও কাকতালীয় ঘটনা

Looks like you've blocked notifications!

কোনো কিছুই রাজনীতির ঊর্ধ্বে নয়। এই বাক্যটি প্রতিবারই প্রমাণিত হয় একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের আসরে। এবারও সেটার ব্যতিক্রম ঘটেনি। পুরস্কারের বহর দেখলেই বোঝা যায়, হয় ঘরোয়া, নয়তো আন্তর্জাতিক রাজনীতির দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত অস্কার। আর অন্যবারের চেয়ে এবারের অস্কারের মেজাজ তো একটু ভিন্ন ছিলই, কারণটা হলো ট্রাম্পের শাসনামল। নানা বৈষম্য, কঠোর অভিবাসন নীতিসহ রাজনৈতিক বিভিন্ন বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, মন্তব্য ও গণমাধ্যমের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ—সব মিলিয়ে হলিউড-শিবিরে ট্রাম্প ‘খলনায়কের’ চরিত্রেই আবির্ভূত হয়েছেন। এই তো কিছুদিন আগে প্রতিবন্ধীদের উদ্দেশে ট্রাম্পের অঙ্গভঙ্গির কড়া সমালোচনা করেন সর্বোচ্চবার একাডেমি অ্যাওয়ার্ড মনোনয়ন পাওয়া অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপ। শুধু তিনি নন, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে খোলা রাজপথে বক্তব্য রেখেছেন সংগীতশিল্পী ম্যাডোনাসহ অনেক মার্কিন লেখক ও বুদ্ধিজীবী।

ক্ষমতায় বসার সঙ্গে সঙ্গেই ট্রাম্প সাতটি মুসলমান দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। আর এর প্রতিবাদে অস্কার অনুষ্ঠান বয়কটের ঘোষণা দেন এবারের বিদেশি ভাষার সেরা চলচ্চিত্র বিভাগে মনোনয়ন পাওয়া ছবির পরিচালক আসগর ফরহাদি। ইরানি এই পরিচালকের ‘দ্য সেলসম্যান’ শেষ পর্যন্ত পুরস্কার ছিনিয়ে নিলেও পরিচালক নিজ হাতে তা গ্রহণ করতে পারেননি বা গ্রহণ করার জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যাননি। একই কারণে অনুষ্ঠান বর্জন করেছেন ‘দ্য সেলসম্যান’ ছবির অভিনেত্রী তারানেহ আলিদস্তি। এটা ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের সরাসরি প্রতিফলন। বিষয়টি যে শিল্পীরা ভালোভাবে দেখেননি, সেটা আর বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

এমনিতেও বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্রে রাজনীতি বিষয়টি বেশ প্রকট আকারেই ধরা দেয়। এই আসগর ফরহাদি ২০১২ সালে আরো একবার পুরস্কারটি বগলদাবা করেন, ‘আ সেপারেশন’ ছবির জন্য। সম্প্রতি ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের যে ধরন, সেটার থেকে খুব বেশি পার্থক্য ২০১২ সালেও ছিল না। তাই ও রকম কাহিনীর একটি ছবি পেয়েছিল আঙ্কেল অস্কারের মূর্তিটি। ছবিতে বৃদ্ধ এক লোককে ইরানের শাসককুলের রূপক আকারে হাজির করা হয়। একটি পরিবারে ছেলে বৃদ্ধ বাবাকে ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না, কিন্তু স্ত্রী ও কন্যা ইরান ছাড়তে চায় যত দ্রুত সম্ভব, উন্নত ভবিষ্যতের জন্য। এই বিচ্ছেদরেখা টেনেই শেষ হয় ‘আ সেপারেশন’ ছবিটি। ইরানের নতুন প্রজন্ম পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট এমন এক বার্তাই প্রচার হয় ফরহাদির আগের ছবিতে।

এ ধরনের রাজনৈতিক ছাপ তো থাকেই অস্কারে, তবে এবার ট্রাম্পবিরোধী মনোভাবটাই যেন বেশি প্রতিফলিত হলো একাডেমি অ্যাওয়ার্ডে। মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার জবাবে যে ইরানি চলচ্চিত্রকে বিদেশি ভাষার শ্রেষ্ঠ ছবি করা হয়নি, সেটা কি অস্বীকার করা যাবে? আবার সেরা অ্যানিমেটেড ছবির পালক যুক্ত হলো ‘জুটোপিয়া’র মুকুটে। কী আছে জুটোপিয়ায়? সেখানে দেখা যায়, এক খরগোশ গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে আসে পুলিশ হওয়ার জন্য। এখানে খরগোশ ‘বর্ণবৈষম্যে’র শিকার হয়। পুলিশের দুঃসাহসিক কোনো অভিযানে না পাঠিয়ে গাড়ি পার্কিংয়ের কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয় খরগোশকে। তবে অদম্য খরগোশ ঠিকঠিকই নিজের যোগ্যতা দিয়ে জায়গা করে নেয় জুটোপিয়া পুলিশ ডিপার্টমেন্টে। এটা যেন নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টেরই এক রূপক গল্প। ‘অপর’কে ভয় পাওয়া, ঘৃণা করা, জায়গা না ছেড়ে দেওয়া ইত্যাদি বৈষম্য ট্রাম্পের নীতির ভেতরই প্রোথিত, সেটারই প্রতিবাদ জানাতে যেন পুরস্কৃত হলো ‘জুটোপিয়া’।

সেরা প্রামাণ্যচিত্র (সংক্ষিপ্ত বিষয়) বিভাগে পুরস্কার পেয়েছে ব্রিটিশ প্রামাণ্যচিত্র ‘দ্য হোয়াইট হেলমেটস’। সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবী উদ্ধারকর্মীরাই পরিচিত হোয়াইট হেলমেট নামে। এদের পোশাকি নাম সিরিয়ান সিভিল ডিফেন্স। অরলান্ডো ভন আইসসিডেল পরিচালিত এই প্রামাণ্যচিত্রের পুরস্কারপ্রাপ্তি প্রমাণ করে, সিরিয়ায় যুদ্ধের অবসান চায় শিল্পীসমাজ। কেন সিরিয়ায় সংঘাত শেষ হচ্ছে না, সেখানে কারা কারা বদলি যুদ্ধ বা প্রক্সি ওয়ার করছে, সেখানে শক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তা কী ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর শুধু শিল্পীসমাজ কেন, কারোরই অজানা নয়।

এবারের অস্কার, অর্থাৎ ৮৯তম একাডেমি অ্যাওয়ার্ডে সেরা ছবির সম্মান পেয়েছে ‘মুনলাইট’। ব্যারি জেনকিন্স পরিচালিত ছবিটি তৈরি হয়েছে তারেল আলভিন ম্যাকক্র্যানির লেখা ‘ইন মুনলাইট ব্ল্যাক বয়েজ লুক ব্লু’ নাটক অবলম্বনে। ৭৪তম গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ডে ছবিটি বেস্ট মোশন পিকচার (ড্রামা) বিভাগে পুরস্কৃত হয়। আর এবারের অস্কারে সেরা ছবি, সেরা পার্শ্ব অভিনেতা ও সেরা চিত্রনাট্য (গৃহীত) বিভাগে পুরস্কার লাভ করে ‘মুনলাইট’। ছবিটি মনোনয়ন পেয়েছিল আটটি বিভাগে।

‘মুনলাইট’ ছবির উপজীব্য সমকামী এক কৃষ্ণাঙ্গ বালকের জীবনসংগ্রাম। গত বছর থেকেই বলা হচ্ছিল, ছবিটি নাকি অন্য মাত্রার রোমান্টিক মাস্টারপিস। ফ্লোরিডার মিয়ামিতে বেড়ে ওঠা চিরনের জীবনকাহিনী ছবিটিতে দেখানো হয় তিনটি ধাপে। পরিবারের দারিদ্র্য, মাদকাসক্ত মা, আর নিজের সমকামিতা নিয়ে জীবনে জোর লড়াই করে বাঁচে চিরন। এর মধ্য দিয়েই নিজেকে, নিজের স্থান ও বিশ্বকে জানা হয় তার। যুক্তরাষ্ট্রে গত কয়েক বছর ধরেই কালোদের ওপর যে বৈষম্য দেখা যাচ্ছে, কালোদের যেভাবে গুলি করছে সাদা পুলিশরা, সেটা ট্রাম্পের জয়ের মাধ্যমে আরো যেন এক কাঠি বেড়েছে। ছবির মূল চরিত্র যে এলাকার, সেই ফ্লোরিডাতেই কৃষ্ণাঙ্গরা পুলিশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এর মাঝেই শ্বেতাঙ্গদের উত্থানের বার্তা ছড়িয়েই মসনদে বসেছেন ট্রাম্প। তিনি যুক্তরাষ্ট্র বলতে বোঝেন শুধু সাদাদের, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যে অভিবাসীদের দেশ, সেটা তিনি ভুলে যান। তাই ফ্যাসিবাদী নেতাদের মতো তিনিও ইতিহাসের পেছনের অধ্যায়ে ফিরে যেতে চান, সঙ্গে নিতে চান উগ্রপন্থী শ্বেতাঙ্গদের। তিনি বলে আবারও যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি মহান বানাবেন। হায়, তিনি ভুলে যান রেড ইন্ডিয়ানদের, তিনি ভুলে যান শ্বেতাঙ্গরাই যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র ইতিহাস নন। ট্রাম্পের এমন একচোখা নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে অশ্বেতাঙ্গ, বিশেষ করে হিস্পানিক ও এশীয়রা রয়েছেন শঙ্কার ভেতর। কৃষ্ণাঙ্গরাও এর বাইরে নন। এমন অবস্থায় ‘মুনলাইটে’র সেরা হওয়াকে কি কাকতালীয় বলবেন?

অস্কারের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সেরা পার্শ্ব চরিত্রে অভিনেতার পুরস্কারটাও পেয়েছেন একজন মুসলমান। এটাও কি তবে কাকতালীয়? আমার মনে হয় না। পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করে পুরস্কার পেয়েছেন মাহেরশালা আলি, ‘মুনলাইট’ ছবিতে অভিনয়ের জন্যই। আর এই পুরস্কার উৎসর্গ করা হয় কালো ও খয়েরি শিশুদের জন্য। ‘মুনলাইট’ ছবির একজন প্রযোজক অ্যাডেল রোমানস্কি এই ঘোষণাটি দেন। মুসলমানদের গণহারে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা, আর যুক্তরাষ্ট্রকে বিশুদ্ধ সাদা চামড়ার দেশ বানানোর উদ্ভট কল্পনার জবাব এভাবেই দেওয়া হলো এবারের অস্কারে।   

অন্যদিকে, এবারের আয়োজনে সেরা পরিচালক হয়েছেন ড্যামিয়েন শ্যাজেল। তাঁর পরিচালিত ‘লা লা ল্যান্ড’ পাঁচটি বিভাগে পুরস্কার পায়, ছবিটি মনোনয়ন পেয়েছিল ১৪টি বিভাগে। এর আগে ১৯৯৭ সালে ‘টাইটানিক’ ও ১৯৫০ সালে ‘অল অ্যাবাউট ইভ’ দুটি ছবি ১৪টি বিভাগে মনোনয়ন পায়। ছবিটিতে মূল চরিত্রে অভিনয়ের জন্য এমা স্টোন পেয়েছেন সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার। ছবিটির প্রাণ সংগীত। সংগীতের দুই বিভাগ—অরিজিনাল স্কোর ও অরিজিনাল সং দুটোতেই সেরা ‘লা লা ল্যান্ড’। যাঁরা ছবিটি দেখেছেন, তাঁদের নিশ্চয় মনে আছে ‘সিটি অব স্টার্স’ গানটির কথা। আর গোটা ছবিটিই তো সুরের চাদরে মোড়া এক প্রেম ও বিচ্ছেদের চলচ্চিত্র।

ছবির শিরোনামে থাকা ‘লা লা’ দিয়ে LA, অর্থাৎ লস অ্যাঞ্জেলেসকে যেমন বোঝানো হয়েছে, তেমনি বাস্তব থেকে বেরিয়ে নিজের কল্পিত জগতে ঘুরে বেড়ানোর সুরকেও ধরার চেষ্টা হয়েছে। এমা স্টোন ও রায়ান গোসলিং অভিনীত চরিত্র দুটি একে অপরের প্রেমে পড়েন, দুজন কল্পনার জগতে উড়তে থাকেন, এরপর একসময় নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ছিটকে পড়েন একে অপরের কাছ থেকে। ছবিটির মাধ্যমে যেন দর্শকদের কল্পিত জগৎ থেকে বাস্তবে এনে আছড়ে ফেলা হয়। আবার বলতে পারেন ছবিটি আখেরে ভালোবাসার কথা বলতে চেয়েছে। ছবিটির মধ্যে ‘ক্যাসাবলাঙ্কা’ বা ‘রোমান হলিডে’ বা ‘সান ফ্লাওয়ার’ বা ‘রেবেল উইদাউট আ কজে’র মতো বিচ্ছেদের সুর আছে, আবার বিচ্ছেদ যে এড়ানো যেত সেই ইঙ্গিতও আছে ‘লা লা ল্যান্ডে’। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট অবশ্য কালো-ধলা-খয়েরি সকলকে নিয়ে প্রেমময় দেশ গড়তে রাজি নন, তিনি বিচ্ছেদেই বিশ্বাসী, তিনি দেয়াল তুলতে চান, বিচ্ছেদের অপর নাম তো দেয়ালই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক