নারী দিবস

যে রাঁধে, চুল বাঁধে, সে সবই পারে

Looks like you've blocked notifications!

যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে—বহুল প্রচলিত এ প্রবাদটি যেন জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ প্রবাদের পরিপূরক। কিন্তু এই রাঁধা আর সমানতালে চুল বাঁধার বয়সটা কত দিনের। এই তো বিশ শতকের শুরুতেই বাঙালি নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া তাঁর ‘জাগো গো ভগিনী’ প্রবন্ধে আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘স্বামীরা যখন পৃথিবী থেকে মঙ্গল বা গ্রহ নক্ষত্রের দূরত্ব মাপায় ব্যস্ত, স্ত্রী তখন বালিশের কভার মাপেন।’ এক শতকেরও কম সময়ের ব্যবধানে অবস্থার বিস্ময়কর পরিবর্তন আনতে পেরেছেন নারীরা, এ কথা সত্য। কিন্তু কতটা এগিয়েছে আমাদের নারীরা?  রাঁধা আর চুল বাঁধার শতকরায় একজন নারী কতটা ভালো আছেন, তার হিসাব কখনো করেছি আমরা?

একজন নারী প্রকৃত নারী হয়ে উঠতে শুরু করেন জন্ম থেকেই, তাঁর চারপাশের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কিন্তু আধুনিক সমাজে নারীর মানুষ হয়ে ওঠার সূচনা ঘটে মূলত উচ্চশিক্ষার হাত ধরে, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই কি তাই। উচ্চশিক্ষিত মেয়েরাও কি মুক্ত; ভাঙতে পেরেছে পরাধীনতার শিকল?

মেধাবী মেয়েরা অভিভাবকের সহায়তায় পড়ালেখা শেষে কাজে লেগে যায়। অনেকে আজকাল শ্বশুরবাড়িতে বাবার বাড়ির মতোই আদর এবং সুযোগ পায়। এরা নিজের চাকরি ও ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। সেটি খুব হাতেগোনা। কিন্তু বাকি যে অধিকাংশ মেয়ে, মহিলা অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে জীবনযাপন করে তাঁরা? অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ধাপ পার হন, কিন্তু তারপর তাঁদের জীবন কেটে যায় শুধুই সংসারে। তবে এত পড়ালেখা করে কী করেন? সাজগোজ, শপিং, বিউটি পার্লার যাওয়া, নিজেকে আরো সুন্দরী করে তোলার চেষ্টা, রেস্টুরেন্টে খাওয়া, হিন্দি সিরিয়াল দেখে তা অনুকরণ করা। আড্ডা, পরচর্চা, পরনিন্দা? সন্তানের স্কুলের সামনে বসে থাকা? অন্যদের কী আছে, না আছে, তার তুলনা করা? স্বামীর অপেক্ষায় মন খারাপ করা, ঘরে ফিরলে ঝগড়া করা? কাজের লোকের ওপর খড়গহস্ত হওয়া। সব বিষয়ে খুঁত ধরা? আর অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বামীর মা-বোন-ভাই-আত্মীয়স্বজন থেকে দূরত্ব রাখার চেষ্টা। তবে শুধুই নারী, গতানুগতিক এই পরিচয় থেকে বেরিয়ে একজন মানুষ হয়ে ওঠার মধ্যে কতটা তফাৎ থাকে?

অবিবাহিত হলে মায়ের কাছে, অতএব তাঁদের নিয়ে কথা নেই। কিন্তু বিবাহিত মেয়ে, যাঁরা চাকরি করছেন, তাঁদের পরিবার কে দেখাশোনা করছে? কাজের লোক, শাশুড়ি বা ননদ। যৌথ পরিবার হলে যে বউটির স্বামী কম আয় করেন, তাঁর ঘাড়ে পড়ে সংসারের বেশিরভাগ কাজ।  কী অসহায় অবস্থা, কে রাঁধবে, বাজার করবে, কাপড় ধুবে? নিজে রান্না হয়তো করে ফেলবেন, কিন্তু কাটা, ধোয়া, মসলা বাটা, বাসন ধোয়া, ঘর ঝাড়ামোছা। মাথায় হাত দেওয়া ছাড়া আর কী উপায়। দু-চার দিন কোনোরকম চলার পর অসুস্থ, কোমর ব্যথা, গা, মাথার ব্যথায় বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। অনেকের আবার আজকাল এই দুর্দিন সামাল দেওয়ার জন্য বুয়াকে দিয়ে বেশি করে রান্না করে ডিপফ্রিজে তুলে রাখেন। সেটা ভালো আইডিয়া; কিন্তু বারবার ফ্রিজ থেকে বের করা, আবার সেটি ফ্রিজে তুলে রাখা খাবার কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত থাকে, সেটা কি তারা ভেবে দেখেন, কী খাবার তুলে দেন প্রিয়জনের পাতে।

এই বিশ শতকের সত্তর-আশির দশকেও রান্না আর স্বামী-সংসার সামলানোই ছিল নারীর একমাত্র কাজ। কিন্তু যুগের পরিবর্তনে এসেছে নারীর সমান অধিকার আর কাজের ক্ষেত্রে সুযোগ। নারী স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো ব্যাপারে ধৈর্যশীল, সহানুভূতিশীল এবং আগ্রহী। এ জন্যই এখন বিভিন্ন অফিস-আদালতে নারীকে উচ্চপদেও দেখা যায়।

তারপরও প্রশ্ন আসে, একজন নারী কি একজন ভালো কর্মী বা নেত্রী হতে পারে? উত্তরটা নিঃসন্দেহে হ্যাঁ। অনেক ক্ষেত্রে একজন পুরুষ নিজের জেতার কথাটাই ভাবে। অন্যদিকে একজন নারী চিন্তা করে একমত হওয়া, ছাড় দিতে হলেও দুজনেই কীভাবে জেতা যায়। এ অবস্থাটাকে অফিশিয়াল ভাষায় বলা হয় উইন উইন সিচুয়েশন বা উভয় পক্ষেরই জেতা, যা সফল নেতৃত্বের গুণের মধ্যে পড়ে।

যেসব বিবাহিত নারী বা একজন মা বাইরে চাকরি করেন, তাঁদের রীতিমতো দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় যে সকালের মিটিংয়ে সময়মতো পৌঁছাতে না পারলে বস ভাববে, নিশ্চয়ই কোনো পারিবারিক ঝামেলার কারণে দেরি হয়েছে। ব্যাপারটা তো পুরো মিথ্যে না, সত্যিই একজন নারীকে তাঁর পুরো সংসারটা গুছিয়ে অফিসে আসতে হয়, যাতে তাঁর অনুপস্থিতিতে পরিবারের কারো কোনো সমস্যায় না হয়। এ ক্ষেত্রে অফিসের যিনি কর্মকর্তা, উনারই বুঝতে হবে এই সমস্যা। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, উল্টো সবার সামনে কথা শুনিয়ে দেন যে এ কারণে নারীদের নিয়োগ দেওয়া ঠিক নয়। ভাবুন, তখন তার মনের অবস্থা।

প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হওয়ার পরও নারীরা ওই স্বামীর সঙ্গেই সংসার করে থাকেন। কারণ, তাঁরা আর্থিকভাবে স্বামীর ওপর নির্ভরশীল। আবার অনেক সময় অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন নারীরাও পারেন অত্যাচারী স্বামীকে ত্যাগ করতে। পুরুষশাসিত সমাজ তাঁকে সহজভাবে গ্রহণ করে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, নির্যাতিত নারীর আত্মীয়স্বজনও চান, পারিবারিক অশান্তি ডিভোর্স নামক চরম পর্যায়ে পৌঁছে যাক। আমাদের সমাজে স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য একটা সমস্যা, এটা মানুষ বুঝতেই চায় না। মেয়েদের বাবার বাড়ি থেকে মেয়েটার ওপর চাপ আসে মানিয়ে নেওয়ার জন্য। এতে নির্যাতিত নারী আরো অসহায় হয়ে পড়েন। তিনি ভাবতে থাকেন, ডিভোর্স হলে কোথায় হবে তার নিরাপদ আশ্রয়? আর একবার ডিভোর্স হলেই সবাই উনার অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে চাইবে।  সমাজে ডিভোর্সী পুরুষের গ্রহণযোগ্যতা আছে, কিন্তু ডিভোর্সী নারী যেন মহাপাপী, অচ্ছুৎ আর চাকরির ক্ষেত্রে তো অবস্থা তথৈবচ। এ এক দুষ্টুচক্র। যে চক্র ভাঙতে ব্যর্থ হয়ে, যুগ যুগ ধরে এভাবেই নারীরা অন্যায় সহ্য করে পরোক্ষভাবে অন্যায়কে সমর্থন দিয়ে এসেছে।

এর ফলে নির্যাতিত নারীদের মধ্যে হতাশা, জীবন ও কর্মে উদাসীনতা, সিজোফ্রেনিয়া, খিটখিটে মেজাজ, অনৈতিক সম্পর্ক এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছালে আত্মহত্যা প্রবণতা ইত্যাদি মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এতে স্বামীর ওপর জমে থাকা রাগ বা ক্ষোভ অনেক সময় সন্তান বা পরিবারের অন্য সদস্যের ওপর গিয়ে পড়ে। ফলে অশান্তি দেখা দিতে পারে পুরো পরিবারে।

নারীর কাজ এখন কি শুধুই রান্না ঘরে? মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের স্কুলে হাজিরা দিয়ে তাদের শিক্ষকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হয় বাচ্চার অবস্থান নিয়ে, যা স্কুল থেকে আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া বাচ্চার ক্লাসের ট্যুরে কখনো অনেক বাচ্চা দেখাশোনার জন্য ভলান্টিয়ার হিসেবে অভিভাবকদের ডাকা হয়। অনেকে আগ্রহ করে সেসবেও হাজির হন। সেলাই বা ছবি আঁকা, লেখা পার্টি, পড়শি, বন্ধুদের সাহায্য-সহযোগিতা বিপদে-আনন্দে আত্মীয়স্বজনের খোঁজ রাখা, সাহায্য করা। এভাবে অনেকে মানবিক হয়ে ওঠেন। এত কিছুর পর, ঘুরে বেড়ানোর জন্য সময় থাকে দলবেঁধে দূরে কোথাও চলে যাওয়া। রান্না করে নিয়ে যাওয়া বা ওখানে বারবিকিউ করে দিন কাটানো। মাছ ধরা, খেলাধুলা, সাইকেল, বোট চালানো। কখনো বিশেষ উপলক্ষে জন পনেরো-বিশ মানুষ নিজের বাড়িতে ডাকা। ১০-১২ রকমের পদ রান্না করে বিশাল খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন একাই করেন। সঙ্গে বাড়ি থাকে পরিপাটি। আর রাতভর এসব পার্টিতে শুধু খাওয়া-দাওয়া নয়, ছোটখাটো সাংস্কৃতিক আয়োজনও থাকে। তার জন্যও নিজেকে এবং বাচ্চাদের প্রস্তুত সবই করতে পারেন মেয়েরা।

বাড়ির টুকটাক ছোটখাটো মেরামত, গাড়ি চালানো, ধোয়া, ইঞ্জিনের তত্ত্বাবধান করা—কোন কাজটা মেয়েরা পারেন না? অনেক মহিলা তো একাই বাচ্চাদের মানুষ করেন। ভোরে উঠে ছোট বাচ্চার খাবার-দাবার, কাপড় সাজিয়ে তাকে তৈরি করে, একটু বড়টাকে লাঞ্চবক্সসহ স্কুলব্যাগ ঠিক করে একগাদা কাপড় পরিয়ে, নিজে পরিপাটি তৈরি হয়ে নাশতা করে বের হন। ছোটটাকে ডে-কেয়ারে, বড়টাকে স্কুলে নামিয়ে নিজে কাজে যান। তিন-চারটা বাচ্চা হলেও সবকটিকেই সামাল দেন। ফেরেন বাচ্চা নিয়ে বাজার হাট করে।

সেখানেও কি তাঁর দম ফেলার ফুরসত আছে? ঘরের গৃহকর্মী কজগুলো ঠিকমতো করছে কি না, সে টেনশন ইত্যাদি। ক্লান্ত হয়ে তিনি যখন ঘরে ফেরেন, তখন তাঁকে সেবা করার মতো কেউ থাকে না।

এর পরও রান্না, খাওয়া সেরে লন্ড্রি, ঘরদোর গোছান, বাচ্চাদের পড়া দেখানো, গল্প, টিভি দেখা, সপ্তাহ শেষের আয়োজন—সবই চলতে থাকে। একাই সবকিছু সামাল দেন। প্রতিটি দিন এভাবেই কাটছে তাঁর। মুখে হাসি, কাঁধে সংসারের দায়িত্ব নিয়ে অনায়াসে পার করে দিচ্ছেন ছোট্ট এই জীবনটার মূল্যবান দিনগুলো। যখন সব কর্তব্য আর ত্যাগের মাঝে নিজের আনন্দটুকু খুঁজে পান, তখনই মনে হয়, এই মেয়েরাই আসল কর্মঠ স্বাবলম্বী মানুষ। বাড়ি, সন্তান এবং অফিসের কাজ একাই সামলাতে পারেন।

যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে—কথাটা তখন খুব খাঁটি মনে হয়।

লেখক : শিক্ষক