কুলদীপ নায়ার

শেখ হাসিনার জন্য প্রণোদনা

Looks like you've blocked notifications!
কুলদীপ নায়ার। ফাইল ছবি

ঢাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক সফরের সমালোচনা করেছেন ভারতের প্রথিতযশা সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার। দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় ‘এ শট ইন দ্য আর্ম ফর হাসিনা’ শিরোনামে লেখা কলামে তিনি এ সমালোচনা করেন। ওই কলামে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও সমালোচনা করেছেন। কুলদীপ নায়ারের কলামটি অনুবাদ করে তুলে ধরা হলো এনটিভি অনলাইনের পাঠকদের জন্য। 

ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরটি হয়েছে অসময়ে। দেখে মনে হয়েছিল তিনি যেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পড়তি ইমেজ ঠেকাতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশে। তিনি সেখানে কেবল ভারতবিরোধী অনুভূতিকেই আরো তীব্রতর করে তুলেছেন। কারণ নয়াদিল্লিকে কখনোই নিরপেক্ষ দেখা যায়নি।

আমি জানি না কেন এবং কত দিন ধরে আমাদের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনকে সমর্থন দিয়ে যেতে হবে। এটা সত্য তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে দূরবর্তী এবং অত্যাচারী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে স্বাধীন করেছেন। কিন্তু এটি শেখ হাসিনাকে সংবিধান ও প্রচলিত নিয়মনীতিকে অবজ্ঞা করার অধিকার দেয় না। 

একটি উদাহরণই দেখুন, ঢাকা ও চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের হয়ে নির্বিচারে ভোটবাক্সে ব্যালট পেপার ঢোকানো হয়েছে। এটি ভোটার ও সাধারণ জনগণের কাছে ভীতিকর ছিল। শেখ মুজিব নিশ্চিতভাবে তাঁর  সমাধিতে নড়েচড়ে উঠবেন। কারণ তিনি রাওয়ালপিন্ডির সামরিক জান্তা শাসকদের বিরুদ্ধে মানুষের আত্মপ্রকাশের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।

এতে কোনো সন্দেহ নেই, মোদির সফর জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে থাকা ক্রমবর্ধমান মৌলবাদী প্রভাবের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ দলকে শক্তি জুগিয়েছে। কিন্তু এরপরও হাসিনার নিজের পথ বের করার উপায় জানা আছে। প্রকৃতপক্ষে, যে রুক্ষভাবে তিনি তাঁর চারপাশের ভিন্নমতকে দমন করছেন, তাতে তাঁর পরিচয় নিয়ে সন্দেহ জন্মেছে। তাঁর কি সত্যিই কোনোদিন মুক্তরাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক শাসনের প্রতি আস্থা ছিল? 

বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেনকে অপদস্থ করার বিষয়টি এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উদাহরণ। তিনি (কামাল হোসেন) তাঁর বাবা শেখ মুজিবের একজন সহকর্মী এবং জীবনভর এক নীতি আঁকড়ে ধরে থাকায় কিংবদন্তিতুল্য একজন ব্যক্তি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নির্বাচন বর্জন করাটা ছিল একটি বিবেচনাবহির্ভূত কাজ। তবে এটিও সত্য যে, হাসিনা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, নির্বাচনে জেতার জন্য তিনি যেকোনো কিছু করতে পারেন। এরপরও, বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করত, তাহলে কয়েকজন প্রার্থী হলেও জিতে আসতেন। তাহলে জণগণের সামনে হাসিনার দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা তাঁরা করতে পারতেন। 

নিঃসন্দেহে, বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন শাসকগোষ্ঠীর ভাগ্য নির্ধারণ করেছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন নির্বাচনটিও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এর মাধ্যমে যাচাই করা যেত, সাধারণ নির্বাচনের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে যেসব প্রতিশ্রুতি শাসক দল দিয়েছে, তারা তা পূরণ করতে পেরেছে কি না। 

ভারত অনেক ভাগ্যবান। কারণ, যেভাবে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দেশকে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ করে গেছেন, তা এখনো কায়মনোবাক্যে অনুসরণ করা হয়। তবে তাঁর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী গণতন্ত্রকে কক্ষচ্যুত করেছিলেন এবং গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধসহ মানুষের মৌলিক অধিকারও ক্ষুণ্ণ করেছিলেন। কিন্তু জনগণ বিষয়গুলোকে ভালোভাবে নেয়নি। নির্বাচন ঘোষিত হওয়ার সাথে সাথে মানুষ নিজেদের চেপে রাখা ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিল। এটাও বলা হচ্ছিল যে, এমনকি মহান ইন্দিরা গান্ধীও হেরে যেতে পারেন। 

এটা অবশ্য ভিন্ন বিষয়, যখন ১৯৮০ সালের দিকে পুনরায় ক্ষমতায় এসেছিলেন তখন তিনি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনকারী আমলাদের শাস্তি দেওয়ার পথ খুঁজে বের করেছিলেন। এটা দুঃখজনক বিষয় যে, আগের জনতা সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিল বলে তিনি যাকেই সন্দেহ করেছিলেন তাঁর বিরুদ্ধেই প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করেছিলেন। 

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, যারা জরুরি অবস্থার রচয়িতা ছিল- সেই দলটিই শেষ পর্যন্ত শিক্ষা পেয়েছিল। দলটি শেষে নিজেদের ভুল কাজগুলো নিয়ে দুঃখপ্রকাশও করেছে। আমি আশা করেছিলাম, দলটি জাতির কাছে ক্ষমা চাইবে। কারণ দুঃখপ্রকাশ ও ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য আছে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে তাঁদের কথা বলার ক্ষমতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হারিয়েছে, যা তাঁদের একসময় ছিল। এটি একটি দুঃখজনক অবনমন। কিন্তু এটা আরো গ্লানিকর যখন এই পরিবর্তনটা হয়েছে এমন একজনের হাত ধরে, যাঁর পরিবার পশ্চিম পাকিস্তানের নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচার থেকে জাতিকে মুক্ত করেছিল।

এর জন্য হাসিনা ছাড়া কাউকে দায়ী করার নেই। তিনি নিজেই গণতন্ত্রের দীপশিখাকে নিভিয়ে ফেলেছেন। শেখ মুজিবের মেয়ে এমনটি করেছেন, এটা শুধু হতাশারই নয়, বরং পরাজয়ের। তিনি জাতিকে শেকল পরাতে পারেন, এমন ভাবনাটাও কষ্টের। কিন্তু এটিই হয়েছে, যখন থেকে তিনি ঠিক-বেঠিক, নৈতিক-অনৈতিকের মধ্যের শেষ রেখাটিও মুছে ফেলেছেন।

এই পরিবেশে হাসিনা এখন স্বৈরশাসকের প্রতিচ্ছবির প্রতিনিধিত্ব করছেন। এ অবস্থার মধ্যে মোদির সফরটি ছিল আরো দুর্ভাগ্যজনক। কোথাও তাঁর বলা উচিত ছিল, বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া একটি দেশ এবং দেশটির উচিত সেই পথে চলা অব্যাহত রাখা। কিন্তু তিনি হাসিনাকে আশ্বস্ত রাখার পথ বেছে নিয়েছেন। এতে বাংলাদেশের মানুষ হতাশ। কারণ তাঁরা আশা করেছিলেন, তিনি এমন কিছু বলবেন যে হাসিনা যেভাবে দেশ চালাচ্ছেন, তাতে ভারত সন্তুষ্ট নয়।
 
এটাও সত্য যে, মোদি ছিটমহল বিনিময়ের ব্যাপারে বহুদিনের পুরনো একটি চুক্তি বাস্তবায়ন করেছেন। কিন্তু চুক্তিটির বিষয় যখন সংসদে তোলা হয় তখন এতে ভারতের সব দলেরই সমর্থন ছিল। অবশ্যই, এ চুক্তি বাস্তবায়নের কৃতিত্বটি মোদিরই। পাশাপাশি উপকারী ও চমৎকার প্রতিবেশীর (বাংলাদেশ) সঙ্গে চুক্তিটিতে সমর্থন দেওয়ায় সব রাজনৈতিক দলকে তাঁর ধন্যবাদ দেওয়া উচিত ছিল। শুধু মোদির জন্য ‘বার্লিন দেয়ালের’ পতন হয়েছে এটা ভাবা অমূলক। 

আমি আশা করব, তিনি (মোদি) পাকিস্তানের সমালোচনা থেকে দূরে থাকবেন। তার মানে এই নয় যে, সমালোচনা করাই যাবে না, তবে তিনি যখন দক্ষিণ এশিয়ায় ঐক্যের কথা বলছেন- তখন বিভেদ এড়িয়ে যাওয়া বিবেচনাপ্রসূত।

তাঁর এটা বোঝা উচিত, যেভাবে তাঁর পূর্বসুরিরা ভেবেছেন, ঠিক সেভাবেই একদিন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একটি সাধারণ বাজার থাকবে, একদিন পারস্পরিক ব্যবসাবাণিজ্য ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে তারা একে অপরের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে।

বাংলাদেশের জনগণ তিস্তার পানি নিয়ে একটি চুক্তির আশা করেছিল। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের মন্তব্যটি এতে সহায়ক ছিল না। কারণ, ঢাকার উদ্দেশে মোদির যাত্রা শুরুর আগেই সুষমা মিডিয়াকে জানিয়ে দেন, এবারের সফরসূচির আলোচনায় তিস্তা নেই। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোদির সাথে বাংলাদেশ সফরে অংশ নেওয়া ছিল গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। ঢাকাকে এটি বার্তা দিচ্ছে যে তিস্তার বিষয়টি নয়াদিল্লি গুরুত্বের সাথে নিয়েছে।

মোদির সফরে চুক্তিটি হয়নি বলে এটা ধরে নেওয়া ঠিক হবে না যে, ভারত নিজের অবস্থান বদলাবে না। প্রকৃতপক্ষে, মমতার সফর থেকে ঢাকার এ বার্তা নেওয়া উচিত, প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে। হয়তো আরো কিছু সময় লাগবে।

কুলদীপ নায়ার : প্রথিতযশা সাংবাদিক ও কূটনীতিক। রাজনৈতিক বিশ্লেষণের জন্য বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। ভারতীয় প্রেস কাউন্সিলের গুরুত্বপূর্ণ পদ ছাড়াও তিনি যুক্তরাজ্যে ভারতের হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন। ৯২ বছর বয়সী এই লেখক ব্রিটিশ ও স্বাধীন ভারতের ৮০ বছরের ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তাঁর লেখা কলাম ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৮০টি পত্রপত্রিকায় ১৪টি ভাষায় প্রকাশিত হয়।