প্রতিক্রিয়া

মৃত্যুর মিছিলে আরিফারা

Looks like you've blocked notifications!

কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন, ‘ভালোবেসে যদি কেউ খুনি হতে চান, তাই হয়ে যান।’

বাংলাদেশে অসংখ্য পুরুষ ভালোবেসে খুনি হয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। খবরের কাগজ কিংবা অনলাইন পোর্টালগুলোর সংবাদ পড়লে এমনটাই মনে হবে।

আমার প্রথম প্রশ্ন, খুনগুলো কি ভালোবেসে হচ্ছে নাকি না পাওয়ার বেদনায় (ব্যর্থতায়) কিংবা হারানোর কষ্টে (অপমানে) হচ্ছে? নাকি ‘মেল শোভিনিজম’ (male chauvinism) এর ভয়াবহতাই প্রকাশ পাচ্ছে?

ঢাকার সেন্ট্রাল রোডের ১৩ নম্বর বাসা, বৃহস্পতিবার সকাল পৌনে ৯টা, ১৬ মার্চ। নিজ ফ্ল্যাটের সিঁড়ির গোড়ায় ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে পড়েন আরিফুন্নেসা আরিফা নামের একজন ব্যাংকার। হাসপাতালে নেওয়ার পরও তাঁকে আর বাঁচানো যায়নি। খুনটি করেছেন তাঁরই প্রাক্তন প্রেমিক তথা প্রাক্তন স্বামী রবিন। সিসিটিভি ফুটেজে রবিনের এপিঠ-ওপিঠ দেখা যায়। এপিঠে এক্স স্ত্রীর জিনিসপত্র বোঝাই করে নিয়ে এসেছেন সুবোধ বালকের মতো। তিন মিনিটের মাথায় সুবোধ ঠাকুরের ওপিঠ ধরা পড়ে সিসিটিভিতেই—দৌড়ে পালাচ্ছেন।

আর আসা-যাওয়ার এই তিন মিনিটের মধ্যেই আরিফার ঘাড়ে তিনি তাঁর হিংসার আগুন, ইনফেরিওরিটির আগুন নিভিয়ে গেছেন। এই ধরনের আগুনে গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে পুড়ছে অনেক পুরুষই। যদিও এই আগুনকে ‘ভালোবাসার হিসাব-নিকাশ’ বা ‘দাম্পত্য কলহ’ এইসব শব্দের মোড়কে ফেলা হচ্ছে, সত্যি বলতে গেলে এসব হচ্ছে ‘ মেল শোভিনিজম’। কিছু নমুনা দেই।

— আচ্ছা যে স্বামীকে আরিফা তালাকনামা পাঠিয়েছেন, তাঁকে নিজের ফ্ল্যাটে ডেকে এনেছেন কেন?

— নিজের মা বাসায় যখন ছিলেন না, তখন খুনি প্রাক্তনকে আসতে বলাটা কি ঠিক ছিল?

— উচ্চাভিলাষী নারী, স্বামীকে তালাকনামা পাঠিয়েছেন, আবার তাঁকে দিয়ে নিজের রেখে আসা মালপত্র আনাতে গেলেন কেন?

ওপরের এ ধরনের প্রশ্ন আমাদের চারপাশে অনেকের মুখে বা ফেসবুক কমেন্টে আকারে-ইঙ্গিতে প্রকাশ পাচ্ছে আরিফা হত্যাকাণ্ডের পরে। আরো প্রকাশ পাবে যদি দ্রুত বিচার আইনে উপযুক্ত শাস্তি এই সাবেক তথা খুনিকে দেওয়া হয়।

আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন—নারীর বিরুদ্ধে যেকোনো ক্রিমিনাল অ্যাক্টের পক্ষে দ্রুত একটা সাফাই গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটছে, কেন?

এর উত্তরও তবে কি ‘মেল শোভিনিজম’?

এই কলামটি লেখার আগে বাংলা সার্চ ইঞ্জিন ‘পিপীলিকা'তে গিয়ে ‘আরিফা’ নাম দিয়ে সার্চ দিয়েছিলাম। অনলাইনে নজরে এলো অনেকগুলো শিরোনাম : ‘পারিবারিক কলহের কারণে আমি আরিফাকে খুন করেছি’, ‘বাল্যবিবাহ ও যৌতুকে স্বপ্নভঙ্গ আরিফার’, ‘অর্থ না পেয়ে স্বামী ও শাশুড়ি আরিফার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়’— এমন নানা ধরনের শিরোনাম। আমাকে লিখতে বলা হয়েছে নিহত ব্যাংকার আরিফাকে নিয়ে। ইন্টারনেটে দেখলাম, আরিফা নামের একাধিক নারীর জীবনেই নেমে এসেছে নির্যাতনের খড়গ। আরিফাদের জীবনপ্রদীপ নিভে যাচ্ছে যৌতুক কিংবা দাম্পত্য কলহের কারণে।

আরিফারা যখন ব্যাংকার, স্ত্রী পেটানো স্বামীকে ডিভোর্স দিতে তোয়াক্কা না করে নতুন করে বাঁচতে শুরু করেন এক কক্ষের একটা ফ্ল্যাটে, একটা সুন্দর জীবনের আশায়—সেখানেও এক্স হাজবেন্ড এসে তাঁদের খুন করে যান।

এই সমাজে আরিফারা এক্স কিংবা ওয়াই—বর্তমান কিংবা সাবেক কোনো পুরুষের হাতেই নিরাপদ নন। নারীর এই অনিরাপদ জীবনের মূল কারণ হচ্ছে ‘মেল শোভিনিজম’।

মেল শোভিনিজম হচ্ছে পুরুষের এক ধরনের মানসিকতা, যেখানে সে নিজেকে সব সময় নারীর চেয়ে সুপিরিয়র ভাবে এবং আচরণে (উগ্র বা মৌন) তা প্রকাশ করে।

যে পুরুষ সমাজে খুব প্রতিষ্ঠিত, সে যদি অর্থে-বিত্তে স্ট্যাটাসে তুলনামূলক কম প্রতিপত্তির নারীকে বিয়ে করে, তবে স্ত্রীর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ‘ফকির, ছোটলোক’ বলে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাবান স্বামীর বিপরীতে দাঁড়িয়ে নারী ডিভোর্স চাইতেও ভয় পান। পয়সাওয়ালা জামাই হাতছাড়া হয়ে যাবে ভেবে অনেক মা-বাবাও মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ান না, মেল শোভিনিজম দেখা যাচ্ছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

যে পুরুষ সমাজে অর্থবিত্ত, স্ট্যাটাসে নারীর চেয়ে তুলনামূলক কম বলবান, সে পুরুষ বিবাহিত স্ত্রীর গায়ে হাত তুলে নিজের ‘ক্ষমতা’ প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত থাকেন ‘নষ্টা, চরিত্রহীন’ বলে। এ ক্ষেত্রে নারী ডিভোর্স দিলে তাঁকে খুন করে নিজের কল্পিত ‘ব্যর্থ’ জীবনের প্রতিশোধ নিতেও কার্পণ্য করেন না।

আর এ দুই শ্রেণির বাইরে যে পুরুষ আছে, মূলত তাঁরাই প্রকৃত পুরুষ, যাদের জন্য সমাজটা এখনো কোনোমতে টিকে আছে। কিন্তু এইসব পুরুষ কি বুঝতে পারছেন, দিন দিন তাঁদের সংখ্যা কমে আসছে?

পৃথিবীতে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ ডিভোর্সের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আপনি ডিভোর্সের তালিকায় পৃথিবীর প্রথম কিংবা শেষ ব্যক্তি নন। প্রেমে সাড়া না পাওয়া ক্ষণিকের বেদনার হতে পারে, এটা কখনোই অপমান নয়। অপমান হচ্ছে—খুনি কিংবা যৌন উত্ত্যক্তকারী বা স্ত্রী পেটানো স্বামী হিসেবে সমাজে নিজেকে পরিচিত করা। প্রেম বা বিয়ে-বিচ্ছেদ সাময়িক বা দীর্ঘমেয়াদি বেদনার হতে পারে, কিন্তু এতে অপমান বা ব্যর্থতার কিছু নেই।

ভালোবাসায় অক্ষম, অত্যন্ত নিচু মানসিকতার পুরুষের পক্ষেই একজন নারীকে ‘পাওয়া না পাওয়ার হিসাব কষে’ আক্রমণ করা সম্ভব।

শুরুর কথায় ফিরে যাই। হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন, ‘কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনি হতে হয়। যদি কেউ ভালোবেসে খুনি হতে চান তাই হয়ে যান, উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়। এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ দেশমাতৃকাকে ভালোবেসে যুদ্ধে যাওয়ার যে ডাক কবি লিখেছিলেন ১৯৬৯ সালে, সে ডাক অনেক বাঙালি পুরুষের মননে অর্থের বিচ্যুতি ঘটিয়ে ফেলেছে।

আশা নাজনীন : লেখক