স্মরণ
ষোড়শী শহীদ, স্থান দিও পায়ের নিচে
মেয়েটির বয়স ১৬ বোধহয় হয়নি, আত্মীয়দের সঙ্গে চলে যাচ্ছিল ভারতে জান বাঁচাবার জন্য। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ২০-২৫ জন হিন্দু মানুষ জড়ো হয়েছিলেন কুমিল্লার এক গ্রামে। এদের মধ্যে অনেকেই ছিল ঢাকার বাসিন্দা। যে মানুষটি আমাকে এই ঘটনা বলেছিল সে নিজে ফরিদপুরের বাসিন্দা, পরিবার নিয়ে চলে যাচ্ছিল ওপারে।
রাতে থাকার পর খুব ভোরে তাদের নদী পার হওয়ার কথা। বেশ কিছু নৌকা তখন এই পারাপারের কাজে ব্যস্ত থাকত। দুশ্চিন্তা-দুর্ভানায় আচ্ছন্ন মানুষগুলো সারা রাত ঘুমায়নি। সব কিছুর মধ্যে সকাল বেলা তারা একটি দুঃসংবাদ পেল। পারাপারের স্থানে দু-তিন দিন আগে পাক আর্মি এসে ঘাটে আক্রমণ চালায়। মাঝিরা জান বাঁচাবার জন্য নৌকা ফেলে পালিয়ে যায়। আর্মিরা দু-তিনটা নৌকা ডুবিয়েছে, আগুন দিয়েছে। তাদের নৌকা দিয়ে পার করার যার কথা তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তারা সবাই মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়, যে করেই হোক তারা ওই দিন ভারতে চলে যাবে। যদিও রাতের বেলা পার হওয়া বেশি নিরাপদ কিন্তু তবু তাদের মধ্যে কয়েকজন পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তখনই। ওদের ভয় ছিল আর্মিরা হয়তো খবর পাবে এতগুলা নতুন মানুষের গ্রামে আসার। হিন্দু শরণার্থীদের লুট করা ছিল পাকিস্তানিদের নিয়মিত কাজ। রাজাকারদের মাধ্যমে খবর যাওয়ার ভয় ছিল। যদিও তারা সবাই টাকা পেয়েছে এদের কাছ থেকে।
গ্রামের একটি ছেলে তাদের পথ-ঘাট দেখিয়ে নিয়ে যায়। ফেনী নদীর একটি তুলনামূলক শীর্ণ স্থানে তারা দাঁড়িয়ে থাকে নৌকার আশায়। তাররে নিরুপায় হয়ে তারা ঠিক করে যে কচুরিপানা দিয়ে ভেলার মতো কিছু বানিয়ে সাঁতরে তারা নদী পার হবে। খানিকটা আগালে টানে মানুষ ওপারে চলে যেতে পারে। ‘এ ছাড়া আমাদের কোনো উপায় ছিল না। আমাদের মাথা ঠিক ছিল না, আমরা জানতাম না কী করছি, আমরা কেবল প্রাণ বাঁচাতে চাইছিলাম।’
সাত-আটজন মানুষ এই কচুরিপানার ভেলা ঠেলে নদী পার হওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। যতটা সহজ ভেবেছিল তারা বিষয়টি তত সহজ ছিল না। কিন্তু তবুও তারা হাত-পা ছুড়ে নদীর পানিতে সাঁতরাচ্ছিল। এই ভেলা ধরে শরীরটা নদীর পানিতে রেখে তারা পার হচ্ছিল কিন্তু সবার ভারে ভেলাটা ক্রমেই পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছিল। এদের মধ্যে কয়েকজন নারী ও কিশোরী ছিল, কেউ মা আবার কেউ কন্যা।
খানিকটা আগাবার পর জনৈক নারী যিনি নিজের শিশুটিকে এক হাতে ধরেছিলেন তিনি ভয়ের চোটে চিৎকার শুরু করে দেন। কারণ, কচুরিপানার ভেলাটা তখন ধীরে ধীরে পানির নিচে নামছিল। সেই মাকে সবাই চুপ করতে বলে কারণ, তার আওয়াজ শুনে পাকিস্তানি আর্মি টের পেতে পারে এই ভয়ে। কিন্তু মহিলাটি চুপ করতে পারছিল না। এরা শহরের মানুষ, ওমন পরিস্থিতিতে আগে কখন পড়েনি।
১৫-১৬ বছরের মেয়েটি ভেলার একটি কোণা ধরে ভেসে ভেসে যাচ্ছিল। মেয়েটি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে ওই মাকে চুপ করতে বলছিল কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছিল না। ‘ভগবান জানে মেয়েটির মাথায় কি এসেছিল, কারণ সে নিজের হাত ভেলা থেকে সরিয়ে নিল। যাতে করে একটা বাড়তি মানুষের ওই ভেলাটি থেকে চাপ কমে। আমাদের চোখের সামনে মেয়েটি ডুবে গেল। সবাইকে বাঁচাতে গিয়েই হয়তো মেয়েটা প্রাণ দিল।’
একটা মানুষের ওইভাবে তলিয়ে যেতে দেখে সবাই স্তম্ভিত ও নির্বাক হয়ে যায়। কারো কিছু করার ছিল না, কারণ নদীতে তখন মেয়েটি আর নেই। তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। হতবুদ্ধি, হতবাক ওই শিশু কন্যার মাও নীরব হয়ে যায়। এক সময় তারা ওপারে পৌঁছে যায়।
যে মানুষ পানিতে তলিয়ে যায় অন্যের প্রাণ বাঁচাবার জন্য সেই মানুষের চেয়ে বড় ত্যাগ করা কি সম্ভব? কিশোরী মেয়েটি নিজের প্রাণ দিয়েছিল অন্যদের প্রাণ বাঁচাতে। আমরা তার নাম-পরিচয় বা ঠিকানা জানি না। শুধু এইটুকু জানি যে ১৯৭১ সালের ঘটনাগুলো আমাদের মধ্যকার শ্রেষ্ঠতম মানুষদের সঙ্গে আমাদের পরিচিত করেছে। চরমতম স্বার্থ ত্যাগে এর চেয়ে শুদ্ধতম উদাহরণ আমার জানা নেই। আমরা তার ইতিহাস রচনা করি না, জানতেও চাই না, ওটাকে অনেকেই ইতিহাসও বলে না। সাধারণ মানুষের অচেনা ইতিহাস জানার ব্যাপারে কারো আগ্রহ নেই। হে ষোড়শী শহীদ, আমাদের স্থান দিও তোমার পায়ের নিচে।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক