শিক্ষা

উপযুক্ত শিক্ষা নিশ্চিত করা হোক

Looks like you've blocked notifications!

শিক্ষা ও সৌন্দর্য উভয় শব্দই বোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সুশিক্ষার প্রসার মানুষের সৌন্দর্য বোধকেও জাগ্রত করে, তবে এই সৌন্দর্য বোধের অর্থ বাহ্যিক দিক থেকে সৌন্দর্য বিচার নয় বরং চিত্তের পরিশুদ্ধি, মানবিকতা ও প্রকৃতির সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করা বোঝায়। যেকোনো স্থানে পাঠাগার স্থাপন বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে এর চর্চা হতে পারে তবে সৌন্দর্য চর্চার জন্য ছাত্রী হোস্টেলে বিউটি পার্লার ও লন্ড্রি স্থাপন বাধ্যতামূলক করার ওপর জোর দেওয়া সত্যিই কিছুটা বেমানান। গত ১৬ জুন মঙ্গলবার চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে সম্মানিত শিক্ষা সচিব এন আই খানের মন্তব্য শুনে এমনটিই বোধ হওয়া স্বাভাবিক।

আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষার হাল এতই নাজুক যে গ্রামাঞ্চলের অনেক শিশুই উপযুক্ত পোশাক ও বই খাতার অভাবে স্কুলে যেতে পারে না। তা ছাড়া এখন পর্যন্ত দেশে শতভাগ শিক্ষার হারও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষার পর ঝরে পড়ে, আর তার থেকেও বেশি শিক্ষার্থী বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পার করতে ব্যর্থ হয়। যাদের কাছে শিক্ষালাভ করাটাই দুরূহ, তাদের জন্য মূল্যবান ট্যাব দিয়ে লেখাপড়া করা আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া কিছুই নয়। শিক্ষাসচিব বলেছেন, ‘আমরা মাল্টিমিডিয়া বই তৈরি করেছি যেন শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনে শুয়েবসে পড়তে পারে। সব শিক্ষার্থীর হাতে ট্যাবলেট পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি।’ কথাটি ঠিক রূপকথার দেশের রাজার মতো নয় কি? দেশে দুর্ভিক্ষের কথা শুনে যিনি বলেছিলেন, ‘প্রজারা ভাত খেতে পারে না তো কী হয়েছে, ওদের পোলাও খেতে বলো।’ যেখানে দেশের সব শিশু ও কিশোরের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হয়, যেখানে দেশের অসংখ্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের স্কুলঘর শিক্ষাদানেরই উপযুক্ত নয়, সেখানে বছরে ২৫ লাখ ট্যাবলেট বিতরণের প্রত্যাশা বিলাসী কল্পনা ছাড়া আর কী হতে পারে। তিনি বলেছেন, প্রতিটি হাই স্কুলে অপটিক সার্ভার ও হাই স্পিড কানেকশন দেওয়া হবে। বিবেচনার বিষয় হলো, আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই সুবিধা থাকা অপরিহার্য হলেও সেখানে নেট স্পিড অতি মাত্রায় দুর্বল যা দিয়ে কোনো শিক্ষার্থীর পক্ষে ইন্টারনেট থেকে দরকারি ফাইল নামানো তো দূরের কথা, কোনো তথ্য বের করাও কষ্টকর হয়ে যায়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সেবা নিশ্চিত না করে হাই স্কুলে নেট সুবিধা প্রদান করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করা কতটা যুক্তিসঙ্গত তা ভাবার বিষয়।

বর্তমানে দেশে কিশোর অপরাধের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এর একটি অন্যতম কারণ হলো ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও প্রযুক্তির ব্যাপক অপব্যবহার। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী প্রযুক্তি দিয়ে যতটা উপকৃত হবে, যেভাবে প্রযুক্তির প্রয়োগ সফলতার সঙ্গে করতে পারবে, একজন স্কুলের শিক্ষার্থী কখনই সেভাবে তা পারবে না বরং বিশ্বায়নের প্রভাবে ও অভিজ্ঞতার অপূর্ণতার কারণে তার দ্বারা প্রযুক্তির অপব্যবহার হওয়াটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া ট্যাব বা কম্পিউটারের মাধ্যমে পড়াশোনার বিষয়ে তারা যতটা আগ্রহী হয়, তার থেকেও বেশি আগ্রহী হয় এর অপব্যবহারে। তাই স্কুলগামী কিশোরদের ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ বা সীমাবদ্ধতা জারির বদলে তাদের হাতের নাগালে অবাধে প্রযুক্তির ব্যবহার পৌঁছে দেওয়া অনেকটা আত্মঘাতী পরিকল্পনা বলেই মনে হয়। তা ছাড়া শিক্ষায় প্রযুক্তির এমন ব্যবহার আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে কতটুকু উপযুক্ত তাও বিবেচনায় রাখা উচিত।

বাংলাদেশের মতো একটি দারিদ্র্যপীড়িত উন্নয়নশীল দেশে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদাগুলো সবার জন্য পরিপূর্ণ করা আজও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এখনো প্রতিবছর চিকিৎসার অভাবে মারা যায় হাজার হাজার প্রসূতি ও শিশু। অগণিত শিশু অধিকারবঞ্চিত হয়ে, শিক্ষার আলো থেকে দূরে সরে গিয়ে পথে পথে ঘোরে, নির্যাতনের শিকার হয় হাজারো অসহায় নারী। চাকরির অভাবে অসংখ্য বেকার যুবক অপরাধের পথ বেছে নেয়। মানসম্মত শিক্ষার অভাবে সুশিক্ষার পথ থেকে সরে যায় লক্ষাধিক শিক্ষার্থী আবার দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষার আলো থেকেই সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয় অনেক শিশু। এমন অগণিত সমস্যা সমাধানের অপেক্ষায় আমরা দিন কাটাই। আজ নারী ও শিশুশিক্ষার শতভাগ হার নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। দৃষ্টি দেওয়া উচিত  স্থান, কাল নির্বিশেষে বৈষম্যমুক্ত ও মানসম্মত শিক্ষার প্রসার করার বিষয়ে। সেই সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে ভালো মানের বিদ্যালয় স্থাপন করার প্রতি যেমন সচেতন হওয়া উচিত, তেমনি যত্নবান হওয়া উচিত অতি প্রয়োজনীয় শিক্ষা সরঞ্জামের ঘাটতি হ্রাস করে তার সরবরাহ নিশ্চিত করার প্রতি। তাহলেই জাতি যেমন শিক্ষিত হবে, তেমনি জাগ্রত হবে তাদের সৌন্দর্য বোধ। এর জন্য কোনো ট্যাবলেট বা বিউটি পার্লারের প্রয়োজন পড়বে না।

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়