অভিমত
গোপনে বিয়ে নিয়ে কিছু কথা
পিউ আর জুয়েলের ভালোবাসা। তারা বিএসসি ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। পিউয়ের বাড়ি থেকে ছেলে দেখা হচ্ছে। এদিকে জুয়েল এখনো ছাত্র। সে পিউয়ে পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে তার পরিবার একবার বিবেচনার প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করবে না। এখন কি উপায়! তারা গোপনে বিয়ে করে ফেলল। এই মুহূর্তে কাউকে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। পরে সুবিধা সময়ে মতো বললেই হবে। যে যার বাড়িতেই থাকবে। কেই কিছুই টের পাবে না। ঝামেলাও নেই।
এই গল্প খুবই পরিচিত গল্প। সেই ছোট বয়স থেকে শুনছি। একজন মনোবিজ্ঞানী হিসেবে আমার মানুষের নানা ধরনের জীবন গাথা শুনতে হয়। কত কত অদ্ভুত কাহিনী।
নানা কারণেই মানুষ গোপনে বিয়ে করে। কেউ বিয়ে করে রাখে সম্পর্ককে একটা স্থায়ী রূপ দিতে। কিন্তু হয়তো এখনো তারা প্রকাশ্যে বিয়ে করার মতো প্রস্তুত নয়। হয়তো আর্থিক সামর্থ্যও হয়নি। হয়তো পরিবারকে দুঃখিত করতে চায় না। সময় নিয়ে পরিবারকে রাজি করাবে এমনটা ভাবছে।
আবার এমনও আছে যে মেয়ের হয়তো বিয়ের বয়সই হয়নি। ফলে প্রকাশ্যে বিয়ে করলে এই বিষয়টি উঠে আসবে। দুজনের একজন হয়তো খুব উতলা হয়ে বিয়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করল। তখন আপাতত গোপনে বিয়েটা সেরে রাখা হলো।
আজকাল অনেক প্রেমের সম্পর্কই শারীরিক সম্পর্কে গড়ায়। এটিও বিয়ে করে রাখার একটি কারণ হতে পারে। তাতে এক ধরনের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। আবার মনের মধ্যে অপরাধবোধও কম থাকে।
বিখ্যাত মানুষদের মধ্যেও গোপনে বিয়ে করার চল রয়েছে। এটি মনে হয় এক ধরনের ফ্যাশনই হয়ে গেছে। পরে বিয়ের ঘোষণা এলে এক ধরনের নাটকীয়তা তৈরি হয়। বেশ কয়েকদিন পত্রিকা-টিভিতে ঝড় তৈরি হয়। আবার অনেকের খুব বিরক্তিকর ও কিছুটা বিপজ্জনক ভক্ত জুটে যায়। বিশেষত ভক্ত যদি হয় বিপরীত লিঙ্গের ও সে যদি সেলিব্রেটিটির বিষয়ে রোমান্টিক চিন্তা রাখে তবে তো কথাই নেই। ঝামেলা এড়াতেই তখন গোপনে বিয়ে করতে হয়। অনেক সেলিব্রেটি হয়তো তার বিয়েতে সাংবাদিক জুটে উটকো প্রশ্নের অবতারণা করুক তা চান না। ফলে চুপচাপ বিয়ে করে ফেলা। গোপনে বিয়ে করার আরেকটি দিক আছে। যদি প্রতারণা করার ইচ্ছে থাকে তবে এটি বেশ কাজের। একদিকে এই মেয়েটিকে (বা ছেলেটিকে) পাওয়া গেল। আবার অন্যান্য একাধিক প্রেমের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখারও সুবিধা আছে। কেউ কারো বিষয়ে জানতে পারছে না। যাদের হৃদয় যথেষ্ঠ বড়, একজনে ভরে না, তারা এমনটা করে থাকে। বেশি বকা দিয়ে লাভ নেই। এটা মানব চরিত্রও বটে।
গোপনে বিয়ে করা একটি সামাজিক চল। এটিকে কোনোভাবেই কোনো অসুখ বিসুখ বা বেআইনি কিছু বলা যাবে না। এর কিছু সুবিধা আছে, আর কিছু অসুবিধাও আছে। আমার কাছে সমাজের সব উদাহরণ নেই। আছে শুধু অসুস্থ উদাহরণগুলো। কাজেই আমার কথায় ভুল বুঝবেন না। তবে এই উদাহরণগুলো মাথায় রাখলে আমরা সতর্ক হতে পারব। শুধু এইটুকুই।
একজনের কথা মনে পড়ে। মেয়েটি তার প্রেমিকের সঙ্গে গোপনে বিয়ে করে ফেলেছিল। পরে বিষয়টি প্রতারণায় গড়ায়। বিয়ের কোনো দলিল মেয়েটির কাছে ছিল না। স্বাক্ষীও সব ছেলের বন্ধু যারা বিয়ে প্রমাণ করার কোনো প্রয়োজনই বোধ করবে না। এদিকে বিয়ের পর স্বাভাবিকভাবে শারীরিক সম্পর্কও হয়ে গিয়েছিল। ছেলেটি কিছুদিন পর অন্যত্র বিয়ে করে ফেলল ও পুরো সম্পর্কটি অস্বীকার করে মেয়েটিকে ভয়-ভীতি দেখাতে শুরু করল। মেয়েটি বেশ প্রাচীনপন্থী মানসিকতার ছিল। তার শরীরে ব্যাখ্যার অতীত ব্যথা-বেদনা শুরু হয়ে গেল। আমরা এই রোগটিকে বলি সাইকোসোমাটিক ডিজঅরডার।
আরেকটি ঘটনায় ছেলে একব্যক্তিকে কাজি সাজিয়ে নিয়ে এসেছিল যে আসলে বন্ধু ছিল। একটি মোটা খাতায় যেনতেন লিখে মেয়েটিকে বোঝানো হয়েছিল যে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। মেয়েটিরও বয়স কম ছিল। সে তার বয় ফ্রেন্ডকে গভীরভাবে ভালোবাসত এবং বিশ্বাস করত। অনেক সময় ছেলেমেয়ে দুজনেরই বয়স কম থাকে বা বয়স থাকলেও তারা দুজনই খুবই অপরিপক্ব থাকে। তখন গোপনে বিয়ে করার ফল আরো খারাপ হয়। এক মেয়ে ঠিক করেছিল সে তার বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করে নিবে। আর তার সংসারের খরচ চালাবে তার মামা। কারণ মামা তাকে অনেক স্নেহ করেন। আরেকজন দিনের খরচ হিসাব করে ফেলল এভাবে- সকালে একটি করে সিংগাড়া, দুপুরে ত্রিশ টাকার খাবার, রাত্রে একটি করে সিংগাড়া। যেহেতু হাতে গত ঈদের সময় ঈদী হিসাবে পাওয়া দুই হাজার টাকা আছে কাজেই কোনো অসুবিধা নেই। কয়েক মাস চলে যাবে।
বিশেষত এই খরচটা এখনই লাগছে না। আপাতত গোপনে বিয়ে করে রাখা হবে। পরে সময় এলে তখন এই টাকাটা প্রয়োজন পড়বে।
অতি অল্প বয়সে যখন আমাদের পছন্দ হয় তখন অনেক সময় গভীর টানের সৃষ্টি হয়। মুশকিল হলো পরে এই পছন্দ কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই বদলে যায়। কিন্তু বিয়ে করে রাখলে তা বদলানো আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটু জটিলই বটে। একজন হয়তো বাদ দিল। কিন্তু আরেকজন গভীরভাবে দুঃখিত হলো। তখন শুরু হয় সামাজিক সমস্যা। আমার উদাহরণের সবই অসহায় বোকা টাইপের মেয়েদের ও দুষ্ট ও শয়তান টাইপের ছেলেদের উদাহরণ। বছর দশেক আগে একটি জাতীয় দৈনিক এ বিষয়ে লিখেছিল। একটি প্রতারিত ছেলে তার দুঃখের কাহিনী টাইপ করে আমাকে বকা দিয়ে কয়েক পাতার একটি চিঠি দিয়েছিল। কাজেই সেই তখন থেকেই কোনো কোনো মেয়েও গোপন বিয়ের ক্ষেত্রে প্রতারণা করত। এখন তা আরেকটু বেড়ে থাকতে পারে।
প্রকাশ্যে বিয়ের সুবিধা হলো সমাজ ও পরিবার, আত্মীয়-বন্ধুর দল এক ধরনের দায়িত্ব নেয়। ইচ্ছে হলেই তখন স্বামী বা স্ত্রী একটা উল্টোপাল্টা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কিন্ত এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ব্যাপারে পরিবারের হস্তক্ষেপ অনেক বেশি হয়। আবার গোপনে বিয়ে করে রাখলে এটা থাকে না। কিন্তু থাকে সামাজিক অনিশ্চয়তা। যদি আপনি গোপনে বিয়ে করেন, তবে আপনাকে যথেষ্ট বিবেচক হতে হবে, থাকতে হবে ভালো পরিকল্পনা এবং কোনো ঝামেলা হলে কাঁদতে বসা চলবে না। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে হবে এবং সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে হবে।
প্রকাশ্যে, গোপনে, সামাজিকভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে, যেভাবেই বিয়ে করুন, ভালো থাকুন, সুখী হোন- সেই প্রত্যাশায় শেষ করছি।
লেখক : অ্যাসিট্যান্ট প্রফেসর অব ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, শেরে বাংলানগর, ঢাকা।