নীল পদ্ম বনাম ফুটন্ত গোলাপ

আমি গ্রামের ছেলে। বলতে পারেন অজ-পাড়াগাঁয়ের। হ্যারিকেনের আলোয় পড়েছি। বর্ষাকালে কাঁচা রাস্তা দিয়ে ভীষণ কাদা ভেঙে স্কুলে গিয়েছি। কখনো বৃষ্টিতে ভিজে আবার কখনো পুকুর বা খালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবিয়ে জ্বর বাঁধিয়েছি। ক্রিকেট, ফুটবল, দাঁড়িয়াবান্ধা, বৌচি, সাতচাড়া, বোমবাস্টিক, হদাগদা, মার্বেল, চাড়ামারি আরো আরো সব খেলেই দিন কাটিয়েছি। পাঠ্যবইয়ের বাইরে কোনো পড়া আছে কমই শুনেছি। গল্প-উপন্যাস কবিতা ক্লাসের বইয়ে যা আছে, তা শেষ করতেই জান শেষ।
২০০০ সালে আমি ম্যাট্রিক পাস করি। আর সে অব্দি পাঠ্যবইয়ের বাইরে আমার পড়া বইয়ের সংখ্যা মাত্র তিন। আমার পষ্ট মনে আছে। বড় ভাইবোনরা, যারা বাইরে পড়াশোনা করত, হয়তো ভুলে কখনো রেখে গিয়েছিল। একটা ছিল ডেল কার্নেগির ‘লিংকন দ্য আননোন’। আমার খুব পছন্দ হয়েছিল বইটি। আর একটা ছিল শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’। বেশ লেগেছিল এটাও। আর একটা বই, যেটা বাঙালি মুসলমানের ঘরে ঘরে পাওয়া যায়, মোকছেদুল মোমেনিন। এই বইয়ের আবার আগ্রহের বিষয় ছিল স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য এবং এ বিষয়ক অন্যান্য আলোচনা।
এরপর ইন্টারমিডিয়েট পড়তে গেলাম জেলা শহরে। সেখানে গিয়েই আমি বুঝতে পারলাম, পাঠ্যবইয়ের বাইরেও আরো পড়া আছে। গল্প-উপন্যাস-কবিতা ইত্যাদি। যে পাঠ শহরের ছেলেমেয়েরা অনেক আগেই সেরে ফেলেছে, সেই তিন গোয়েন্দার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটল কলেজ জীবনে। আমরা চার-পাঁচজন বন্ধু মিলে হানা দিলাম কলেজ লাইব্রেরিতে। পড়তে থাকলাম বিষাদ সিন্ধু, গোরা’র মতো বই। শুরু করলাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কলেজ কর্মসূচি। এরপর ধীরে ধীরে পাঠের আওতা দিন দিন বেড়েছে। পরিচিত হয়েছি নতুন লেখক ও তাঁদের লেখার সঙ্গে।
এবার আবার একটু গ্রামে ফিরি। আমি যখন নতুন নতুন বই পড়ছি, আমারই অনেক বন্ধু তখন নানা বাস্তবতায় মাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে কাজে জড়িয়েছে। কেউ টেনেটুনে কলেজ অব্দি গেছে। খুব অল্পই আমরা উচ্চতর শিক্ষা শেষ করেছি। স্কুলে থাকতেই অনেক মেয়ে বন্ধুর বিয়ে হয়ে গেছে পর্যন্ত। বলতে পারবেন এদের পাঠের ইতিহাসটা শেষ পর্যন্ত কি? তাঁদের জীবনে কি কোনো সাহিত্যচর্চা নেই? তাঁরা কি কোনো গল্প-উপন্যাস পড়েন না? নাকি পড়তে নেই?
এখানেই বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চার অন্য অধ্যায়টা আমরা খুঁজে পাব। শহর কিংবা মফস্বলের লেখক ও পাঠকরা যেটি খুব কমই খোঁজার চেষ্টা করেছেন। পরিসংখ্যান বলে এখনো বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস করে। দেশের জনসংখ্যা ষোল কোটি ধরলে যা প্রায় চার কোটির মতো। বেনবেইসের দেওয়া শিক্ষা রিপোর্ট বলে, ২০১৫ সালের দেশের মাধ্যমিক পর্যায় থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০ শতাংশের মতো। সংখ্যার হিসাবে এটি প্রায় ১০ লাখের বেশি। এই হার আগে আরো বেশি ছিল।
এই আমাকেই ধরুন। যে গ্রামে মাধ্যমিকে পড়া অব্দি মাত্র তিনটা বই পড়েছিলাম, শহরে না গেলে, কলেজে না পড়লে, বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়লে আমার কাছে নতুন লেখার জগৎ কি উন্মুক্ত হতো? কিন্তু তাই বলে এই না যে, আমি সারা জীবনে আর কোনো বই পড়তাম না। হ্যাঁ, তখন এই আমার কাছে প্রিয় বই হলেও হতে পারত কাসেম বিন আবুবাকারের ‘বোরকা পরা সেই মেয়েটি’।
আমি কাসেম বিন আবুবাকারকে কোনোভাবেই ছোট করছি না। বলছি না যে, তাঁর বই শুধু কম শিক্ষিতরাই পড়েন। না এর বাইরেও তাঁর পাঠক অবশ্যই আছে। তবে এটা সত্য যে, কাসেম বিন আবুবাকার গ্রাম অঞ্চলেই বেশি পরিচিত। তাঁর ৭০-৮০ ভাগ পাঠক গ্রামেরই। সেটা এই লেখকই জানিয়েছেন।
আমরা এটা নিশ্চয়ই জানি, প্রত্যেক লেখকেরই একটা লক্ষ্য থাকে। তিনি কার জন্য লিখবেন? কোন ধরনের পাঠক তাঁর বই পড়বে। সে হিসেবেই একজন লেখক তাঁর ভাষারীতি তৈরি করেন। যেমন বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর পাঠক মূলত শিক্ষিত তরুণ-তরুণী। এরা আবার বেশির ভাগই শহরের। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর লেখায় এ বিষয়টা সব সময়ই মাথায় রেখেছেন। তাঁর হিমু শহরের রাস্তায়ই হাঁটে। তা!র মিসির আলী শহরের মানুষ। তাঁর বেশির ভাগ চরিত্র মধ্যবিত্ত।
আবার এই শহরেই এমন অনেক পাঠক আছেন, যাঁদের আবার হুমায়ূন আহমেদে ঠিক পোষায় না। এ বিষয়ে একট গল্প বলি। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে শরৎচন্দ্রের পাঠকপ্রিয়তা ছিল বেশি। এ নিয়ে শরৎচন্দ্রকে একবার এক পাঠক জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘রবীন্দ্রনানাথ লেখেন আমাদের জন্য, আর আমরা লিখি আপনাদের জন্য।’ মোদ্দাকথায়, প্রত্যেক লেখকেরই একটা পাঠকগোষ্ঠী থাকে। সেটা হয়তো সংখ্যায় কম-বেশি হয়। তার মানও আলাদা হয় বটে। কেউ বেশি জনপ্রিয় হন, কেউ কম। কেউ আবার জনপ্রিয় হন না।
এখন আমরা যদি আমাদের চেনা-জানা (মৃত বা জীবিত) লেখকদের দিকে তাকাই, তাহলে তাঁদের পরিচয় পাই শহরের লেখক হিসেবে। তাঁদের ভাষাই সেটা বলে দেয়। তিনি কোথায় বসে লিখলেন, সেটা বড় কথা নয়, কথা হলো তিনি কার জন্য লিখছেন। পদ্মা নদীর মাঝি কোনো একটা নির্জন চরের সুবিধাবঞ্চিত, শোষিত সম্প্রদায়কে নিয়ে লিখলেও তার ভাষাটা কিন্তু অত সহজ নয়। ঠিক যাদের নিয়ে লিখেছেন তাদের পক্ষে এটা পড়া সত্যি কঠিন বটে। হয়তো লেখক শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের এ দুঃখের গল্প বা বৈষম্যের গল্প জানানোর জন্যই লিখেছেন।
এখন এই গ্রামের পাঠকরা, যাঁরা নানা বাস্তবতায় পড়াশোনাটা বেশিদূর এগুতে পারেননি, যেসব মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে, যাদের কাছে শহুরে লেখকদের লেখা পৌঁছায়নি, যাদের কাছে ‘মানসম্পন্ন’ লেখকদের লেখা আজও দুর্বোধ্য ঠেকে, তাদের তো একটা সাহিত্যিক-শূন্যতা আছে, পাঠের শূন্যতা আছে। সেই শূন্যতাটাই পূরণ করেছেন কাসেম বিন আবুবাকার, এমডি মুরাদসহ আরো আরো লেখকরা। শহরের শিক্ষিত পাঠক-সমাজ যখন ‘একশ একটা নীল পদ্ম’ নিয়ে হুমায়ূন আহমেদে মেতছিলেন, তখন ‘ফুটন্ত গোলাপ’ হাতে গ্রামের পাঠকের দরজায় কড়া নেড়েছেন কাসেম বিন আবুবাকার।
তাই কাসেম বিন আবুবাকারের লেখায় ইসলাম কতটা এলো না গেল সেটা আসলে বড় কথা নয়। তিনি আসলে বিশাল পাঠকগোষ্ঠীর মনের তৃষ্ণা মিটিয়েছেন। তাতে উপাদান হিসেবে ধর্মও যেমন এনেছেন, তেমনি এসেছে যৌনতাও। আর যে যৌনতা নিয়ে এখন শহুরে শিক্ষিত ভদ্রলোকদের তাচ্ছিল্য দেখছি, তারা লুকিয়ে চুরিয়ে কতভাবেই এই যৌনতাকে উপভোগ করেন। আর তাঁরা এও নিশ্চয়ই জানেন, এ দেশের সব্যসাচী লেখকরাও তাঁদের লেখায় কীভাবে যৌনতা এনেছেন। কারো ভাষায় তা কখনো মাত্রা ছাড়িয়েছে। পার্থক্যটা দেখুন। চণ্ডিদাসের লেখা, ‘সই কেমনে ধরিব হিয়া? আমার বঁধূয়া আন বাড়ি যায় আমার আঙিনা দিয়া’ পড়ে ‘ভদ্রলোক’ পাঠকরা বাহ! বাহ! করিয়া ওঠেন। কি সাহিত্য, কি সাহিত্য বলিয়া তাদের চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। আর আমাদের লোকশিল্পী মমতাজ যখন গান, বন্ধু যখন বউ লইয়া, আমার বাড়ির সামনে দিয়া, রঙ্গ কইরা হাইট্টা যায়, বুকটা ফাইট্টা যায়’ তখন তার মান নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলে। বিশিষ্ট সমালোচকরা হয়তো বলবেন, এখানেই তো সাহিত্যের তাৎপর্য। বটে। আমরা শুধু সাহিত্যের তাৎপর্যই খুঁজলাম, পাঠকের সীমাবদ্ধতা বুঝলাম না। তাই বলি কাসেম বিন আবুবাকার গ্রামীণ বা সুবিধাবঞ্চিত পাঠকের কোনো অজ্ঞতা নয়, এটা তাদের সীমাবদ্ধতা। তাদের অপূর্ণতায় কিছুটা প্রাপ্তি।
শহর বা মফস্বলের শিক্ষিত পাঠক, যাঁরা আজ কাসেম বিন আবুবাকারকে তাচ্ছিল্য করছেন, কে এই লোক বলে নাক সিটকাচ্ছেন, তাঁরাই তো আহমেদ ছফার অলাতচক্রে, কিংবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামায় তৃপ্ত হতে না পেরে হুমায়ূন আহমেদে মুখ গুঁজেছিলেন। তাই এখন যাঁরা ফুটন্ত গোলাপের সমালোচনা করছি, তারা এতদিন কোথায় ছিলাম? আমরা কি ভেবেছি কী পড়ছেন আমার শেকড়ের মানুষগুলো? আপনি বা আমি যে সাহিত্যে বিনোদন লাভ করছি, তা কেন আমরা সেখানে পৌঁছাতে পারছি না?
কাসেম বিন আবুবাকার বা তাঁর মতো লেখকদের নিয়ে আমরা এখন যতই ফেসবুক সাহিত্য করি না কেন, এ সত্যটা আমাদের মানতে হবে যে, আমরা স্বার্থপরের মতো সুবিধাই নিয়েছি এতকাল। লেখকরাও লিখে গেছেন তাঁদের মতো। যে আল মাহমুদ গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছিলেন কবি হওয়ার জন্য, তিনি আর গ্রামে ফেরেননি কখনো। না শরীরে, না কবিতা, উপন্যাসে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হক তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে যথার্থই বলেছেন, কয়েকশ ক্যাসেট বেরোনোর পর ডমিনেন্ট মধ্যবিত্ত/মিডিয়া মমতাজকে আবিষ্কার করে। তিনি এখন শীর্ষ সংগীতশিল্পী। আমি নিজেও মমতাজের গান খুব পছন্দ করি। তাঁর কণ্ঠে যে পাওয়ার আছে, তা আর কারো কণ্ঠে নেই। কাসেম বিন আবুবাকারও আবিষ্কৃত হলেন শ’খানেক বই লিখে ফেলার পর, বিশেষত বিদেশে তাঁকে নিয়ে রিপোর্ট করার পর ...’।
শেষে নিজের আত্মসমালোচনা করেই শেষ করছি। মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে আমরা কয়েক বন্ধু মিলে আমাদের এক মেয়েবন্ধুকে তাঁর জন্মদিনে ভালো করে র্যাপিং করে একটা বই দিয়েছিলাম। সেটাও মনে হয় কাসেম বিন আবুবাকারেরই লেখা ছিল ‘ভুল করেছিলাম ছাত্রজীবনে তোমায় ভালোবেসে’। আজ ওই বন্ধুটির কাছেও ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ক্ষমা চাচ্ছি কাসেম বিন আবুবাকারের মতো লেখকদের কাছে। যাঁদের সব সময় আমরা তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই দেখেছি। কিন্তু এই লেখার ও পাঠের বাস্তবতা খুব কমই বোঝার চেষ্টা করছি। মান নিয়ে সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু ভদ্রলোকদের আলোচনার টেবিলে উঠতে তিনি বা তাঁর মতো লেখকরা উঠতেই পারবেন না, এই ছোঁয়াছুঁয়িতে অন্তত আমি বিশ্বাস করি না।
লেখক : জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।