ধর্ষণ

অভিযোগ প্রমাণিত হলে পিতা কী বলবেন?

Looks like you've blocked notifications!

ছেলেদের নষ্টামিকে আমরা ‘দুষ্টুমি’ বলে প্রশ্রয় দিই। যৌন হয়রানি, নিপীড়নকে রোমান্টি সাইজ করে বলি ‘ইভ টিজিং’। ফিল্মে এই দৃশ্য তো প্রায় প্রতিষ্ঠিত, উত্ত্যক্ততা, যৌন ইঙ্গিত, রীতিমতো হয়রানি থেকে প্রেমের সূচনা।

বনানীর ‘দ্য রেইন ট্রি’ হোটেলে জন্মদিন পালনের নামে ধর্ষণের যে অভিযোগ উঠেছে, তা এখন টক অব দ্য টাউন। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর ও বাদীর অভিযোগ থেকে জানা যায়, জন্মদিনকে উপলক্ষ করে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই বান্ধবীকে নিমন্ত্রণ করে এনে, কজন মিলে তাঁদের ধর্ষণ করে। আসলে ধর্ষণই ছিল ওই তরুণদের লক্ষ্য, কথিত জন্মদিন উপলক্ষ ছিল মাত্র।

তাই যদি না হবে, তবে আসামিরা ছাড়া তাদের অন্য বন্ধুরা ছিল না কেন সেখানে? আর জন্মদিনের আয়োজনই বা ছিল কোথায়? যে বর্ণনা পাওয়া যায়, সে তো ধর্ষণের আয়োজনই।

এ ঘটনা সামাজিক বিকৃতি ও অসুস্থতাকে ইঙ্গিত করে। এ শহর যেন অপ্রকৃতস্থ মাতালের পায়ে টলছে। পার্টি বলে এখানে অনেক ক্ষেত্রেই যা হয়, তা নেহাত বিকৃতি ভিন্ন কিছু বলার সুযোগ নেই। মডার্নিটির অদ্ভুত সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছি আমরা। এ দায় নিতে হবে আমাদেরই। শুধু রাজধানী নয়, আশপাশেও গড়ে উঠেছে রিসোর্ট, গেস্টহাউস, সেখানে বিকৃতি, অসুস্থতার ছড়াছড়িকে আমরা বলছি পার্টি। গেট টুগেদার। হ্যাঙ্গ আউট। আউটিং। যেখানে মদ ছাড়া, যৌন অনাচার ছাড়া কিছু নেই।

দু-একটা পার্টির কথা বলব, হয়তো চমকে উঠবেন অনেকেই। হ্যাঁ, এই শহরেই গড়ে উঠেছে এসব পার্টি। পার্টি শুরুই হয় আফটার টুয়েলভ, রাত ১২টার পর। রাত ১২টা এদের কাছে ‘ভেরি মাচ আরলি ইভিনিং’। সবেমাত্র সন্ধ্যা। কাউন্টারে এসে টিকেট নিতে হয়। টিকেট বাইরের নির্ধারিত জায়গা থেকেও নেওয়া যায়। হাতে দেওয়া হয় রিবন। প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত, সবার অনুমতি নেই। সঙ্গে দেওয়া হয় মুখোশ। ডান্স, মুখোশ পরা প্রত্যেকে, একে একে পোশাক কমতে থাকে সবার। রাত বাড়ে, উত্তেজনা বাড়ে, উন্মাদনা বাড়ে। বাকি বর্ণনাতে না যাওয়াই ভালো, সে বর্ণনা বিচ্ছিরি রকমের অশ্লীল।

অশ্লীলতাকে, অসভ্যতাকে, অমানবিকতাকে ‘মডার্নিটি’ বলে ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছি আমরা। আধুনিকতা মদ খাওয়া, হাল ফ্যাশনের পোশাক পড়ায়, দামি গ্যাজেট ব্যবহারে, দামি ব্র্যান্ড ব্যবহারের মধ্যে নেই। আধুনিকতা চিন্তায়, মগজে থাকে। মনন উন্নত না হলে, সমৃদ্ধ না হলে, মানবিক না হলে তা আধুনিক হয় কী করে? মদের পার্টি, যৌন অনাচারের পার্টি মডার্নিটি হয় কী করে, স্টুপিডিটি নেহাত। এতে প্রগতি নেই, এগিয়ে যাওয়া নেই, আছে পিছিয়ে যাওয়া। আছে অন্ধকার, আছে আদিম যুগে পৌঁছে যাওয়া।

ভুল বুঝবেন না। আমি কখনোই যৌনতার বিপক্ষে নই, তবে যৌন অযাচারবিরোধী। পশ্চিমের অনেক ভালো কিছু আছে, আমরা সেসব নিই না। সেখানকার বর্জ্য-আবর্জনাকে কেবল গ্রহণ করতে আগ্রহী। ইংরেজিতে ‘ড্রাংক’ শব্দটিও কিন্তু গালি। ‘পলিয়ামুরিয়া’ বলে একধরনের সেক্স নেটওয়ার্ক রিলেশনশিপ রয়েছে, যা সেখানেও নিরুৎসাহিত করা হয়। বহুগামিতা, অনাচার, অযাচার কোথাও গ্রহণযোগ্য নয়।

ধর্ষণ কোনো স্বাভাবিকতা নয়। স্বাভাবিক যৌন আচরণও নয়। বিকৃতি। ধর্ষণ বাড়লে বুঝতে হবে, সমাজে বিকৃতি বাড়ছে। বিকৃত আনন্দ বাড়ছে। অনেকবার বলেছি, কেউ যদি ধর্ষণকে যৌন আচরণ, যৌন আনন্দ ভেবে থাকেন, সেটা ভুল। ধর্ষকেরা যৌনতায় আনন্দ পায় না। আনন্দ পায় ধস্তাধস্তি, জোরাজুরি, চিৎকারে। এটি একটি সাইকো সেক্সুয়াল ডিজঅর্ডার বা মনোযৌন ব্যাধি।

এ ঘটনার সবচেয়ে বিপর্যয়ের যে জায়গা সেটি হলো, ধর্ষণের অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, সেই সাফাতের বাবা, দিলদার আহমেদের মন্তব্য। তিনি একজন খ্যাতিমান মানুষ, ব্যবসাসফল ব্যক্তিত্ব। আপন জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী। ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি সফল হলেও পিতা হিসেবে তিনি ব্যর্থ। তিনি যখন মন্তব্য করেন, ‘যা ঘটেছে সমঝোতার ভিত্তিতেই ঘটেছে’, বিপর্যয়টি ঘটে তখনই। সমঝোতায়ই যদি হবে, তবে ভিডিও করা হলো কেন? মানুষ কি ব্যক্তিগত যৌনদৃশ্য কেউ ভিডিও করে রাখে? আবার আসামিদের পালিয়ে যাওয়াও ভালো লক্ষণ নয়। যদিও ঘটনার প্রায় ৪০ দিন পর মামলা হয়েছে। কিন্তু বনানী থানা সেই মামলাও প্রথম নিতে চায়নি, ৪৮ ঘণ্টা পর নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন দুই ধর্ষিতা তরুণী। সে সঙ্গে নানাভাবে এ মামলাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হয়েছে, এমন অভিযোগও উঠেছে।

সাফাতের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আদালতে প্রমাণ হবে। তার বাবা সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে প্রথমে ‘সমঝোতায় হয়েছে’, পরে ‘ব্ল্যাকমেইলিং’ এমন মন্তব্য অনভিপ্রেত। এমন মন্তব্য ধর্ষণে উৎসাহ জোগায়, সমর্থন দেয়, পৃষ্ঠপোষকতা করে। শেষ বিচারে এ ঘটনা যা-ই হোক, এ মন্তব্য ধর্ষণের পক্ষে একজন ব্যক্তির অবস্থান স্পষ্ট করে। তাও আবার সেটি যদি হয় আসামির পিতা।

‘পিতা’ শব্দটির সমাজে যে ইমেজ নৈতিক, আদর্শিক, সেই চরিত্রটিতে একজন দিলদার আহমেদ কোনোভাবেই আর অবস্থান করেন না। তিনিও অপরাধের সমর্থকে পরিণত হন। নৈতিকতার জায়গাটিতে ছেলের হাত ধরে তিনিও যে শূন্যের কোঠায় নেমে আসেন, তা একটি বারের জন্য ভাবেন না।

এ বড় লজ্জার!

লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা