প্রতিক্রিয়া
জলাবদ্ধতা রুখতে প্রয়োজন সচেতন প্রয়াস
গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপদাহের পর আসে বৃষ্টি। জনমনে আসে শান্তির বার্তা। স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে মাঠে-ঘাটে। কিন্তু এই শান্তির বৃষ্টিই অশান্তির কারণ হয়, যখন আমাদেরই কৃতকর্মের জন্য সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা।
বর্ষাকালে যখন বৃষ্টির পানি বেরিয়ে যাওয়ার কোনো রাস্তা পায় না, তখন বাধ্য হয়েই এই অতিরিক্ত পানি আশ্রয় নেয় রাস্তাঘাট, বাড়ির উঠান আর লোকালয়ে। কখনো এই পানি বেড়ে হয় হাঁটুপানি, কখনো কোমরপানিতে নিমজ্জিত হয় লোকালয়। জলাবদ্ধতার কারণে একদিকে যেমন চলাচল ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়, অন্যদিকে ম্যানহোল, ভাঙা রাস্তা, গর্ত ইত্যাদির কারণে অহরহ ঘটে নানা দুর্ঘটনা। ভোগান্তির অন্ত থাকে না এলাকাবাসীর।
জলাবদ্ধতার পেছনে মূল কারণ হলো—১. অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ২. আমাদের অসচেতনতা। আমাদের দেশে ঢাকাসহ বড় বড় নগরী গড়ে উঠেছে কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা ছাড়াই। ইউনেস্কোর ‘বাংলাদেশের নগরকেন্দ্র : প্রবণতা, ধরন ও বৈশিষ্ট্য’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে শহর এলাকার সংখ্যা ছিল ১০৮টি, যা ১৭ বছর পর ১৯৯১ সালে দাঁড়ায় ৫২২টিতে এবং তারও ২৪ বছর পর ২০১৫ সালে বাংলাদেশে শহরের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫৩৩টি। যার ভৌগোলিক আয়তন ১১ হাজার ২৫৮, যা দেশের আয়তনের ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
‘জাতীয় নগর নীতিমালা-২০১৪’ অনুযায়ী পাঁচটি ধাপে নগরকে বিন্যস্ত করা হয়—মেগাসিটি, মহানগর, মাঝারি শহর, উপজেলা শহর ও কমপ্যাক্ট টাউন। নগর গঠনের পূর্বশর্ত হচ্ছে, সেখানে আবাসন ও কাঠামোগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বর্জ্য ও পানি নিষ্কাশনের বিষয়টি কাঠামোগত ব্যবস্থার মধ্যে পড়ে। এই নীতিমালায় নগরের বিন্যাস প্রক্রিয়ায় নগরীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান, বস্তি উন্নয়ন, নগর অবকাঠামো ও সেবা, নগর পরিবহন ব্যবস্থা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় থাকলেও পানি নিষ্কাশনের জন্য সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়নি। বাস্তবায়ন পদক্ষেপের তালিকায় বিনোদনের ব্যবস্থা, খেলার মাঠ, পার্ক, উন্মুক্ত স্থান, জলাশয়, কবরস্থান, এমনকি শ্মশানঘাট সংরক্ষণের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত; কিন্তু অতি গুরুত্বপূর্ণ ড্রেনেজ সিস্টেম সংস্কার ও এর উন্নয়নের বিষয়টি সবার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। ফলে সংস্কারের অভাবে ও অসচেতনতার কারণে ড্রেনগুলো বন্ধ হয়ে গিয়ে পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত করছে। সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। শহরগুলোতে একের পর এক বড় বড় দালান নির্মিত হয়েছে ঠিকই; কিন্তু একবারও কেউ ভাবেনি, কোনো রাস্তা ছাড়াই কীভাবে এসব এলাকার বৃষ্টির পানি বেরিয়ে যাবে। রাস্তার পাশে ড্রেনের ব্যবস্থা আমাদের দেশে থাকলেও শহরগুলোতে জমে ওঠা পানি অপসারণে তা যথেষ্ট নয়। তার ওপর সেই ড্রেনগুলোর বেশির ভাগই আবর্জনা দ্বারা এমনভাবে রুদ্ধ যে, তার মধ্য দিয়ে পানি বেরিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আর পানি বেরিয়ে যাবেই বা কোথায়? অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে আমরা এরই মধ্যে শহরের বেশির ভাগ লেক, খাল-নালা, পুকুর, ডোবা ইত্যাদি জলাশয় দখল করে ভরাট করে ফেলেছি। দখলের হাত থেকে রক্ষা পায়নি তুরাগ আর বুড়িগঙ্গাও। ‘নগর নীতিমালা-২০১৪’-এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ৩ দশমিক ৪ নম্বর ক্রমে বলা হয়েছে, নগর নীতিমালার উদ্দেশ্য হলো, ‘অবৈধভাবে দখলকৃত জলাধার, পানির প্রবাহ, পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ’, যা আজো বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে নিরসন সম্ভব হচ্ছে না নগরীর জলাবদ্ধতা সমস্যার।
প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ মানুষের আবাসন একমাত্র ঢাকা শহর। পরিসংখ্যান ছাড়াই প্রতিবছর প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে মানুষ ও নতুন নতুন দালানের সংখ্যা। সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে রাস্তাঘাট ও ড্রেনের জায়গা। ঢাকা পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বসবাস অযোগ্য শহরে। একে তো রাস্তার সংকীর্ণ পরিসরে চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, তার ওপর পানির লাইন সংস্কার, টেলিফোন ও গ্যাসের লাইন সংস্কারের নামে রাস্তা খোঁড়ার কারণে একদিকে যেমন পানি আটকে বাজে অবস্থা সৃষ্টি করছে, অন্যদিকে খোঁড়া গর্তে পানি আটকে সৃষ্টি করছে জলাবদ্ধতা। গত ২৫ থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত টানা বৃষ্টিপাতের কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে রাজধানীর মিরপুর, শেওড়াপাড়া, মগবাজার, শান্তিনগর, মালিবাগসহ আরো অনেক স্থানে। বৃষ্টির আগে যত্রতত্র পলিব্যাগ আর আবর্জনা ফেলার কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া ড্রেন ও রাস্তা সংস্কারের জন্য এই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। যার দায়ভার শুধু কর্তৃপক্ষের নয়, আমাদেরও। কারণ, একদিনে ড্রেনগুলো বন্ধ হয়ে যায়নি। দীর্ঘদিনের অসচেতনতার ফল আজ বিরাটাকার ধারণ করে আমাদের গ্রাস করছে। যদি বৃষ্টি তিন দিনের স্থানে সাত দিন স্থায়ী হয়, তবে নগরীর কী ভয়াবহ পরিণতি হবে, তা সহজেই অনুমেয়।
আমাদের উচিত, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজ নিজ এলাকার কর্তৃপক্ষের সহায়তায় সব পানি নিষ্কাশন ড্রেনের আবর্জনা পরিষ্কার করে পানি বেরিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করা এবং পুনরায় যাতে ড্রেনগুলো ভরাট না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা। আমাদের মনে হারানো উচিত নয় যে নগরের পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব যেমন কর্তৃপক্ষের, তেমনি এর দায়ভার আমাদেরও। জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে তাই যেমন কর্তৃপক্ষকে সচেতন হতে হবে, তেমনি প্রয়োজন আমাদের সচেতন থাকাটাও।
লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়।