আন্তর্জাতিক

যে কারণে রুহানি আবার নির্বাচিত

Looks like you've blocked notifications!

ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উগ্রবাদী রক্ষণশীলদের হারিয়ে আবারও বিজয়ী হলেন দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। ১৯ মে দেশের চার কোটি ভোটারের মধ্যে ৫৭ শতাংশ বা দুই কোটি ৩০ লাখ ভোটার রায় দেন রুহানির পক্ষে। উৎসবমুখর অবস্থায় ভোটারদের অভাবনীয় উপস্থিতিতে তাঁদের অনুরোধেই ভোটদানের সময় বাড়ানো হয় এবং গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করা হয়। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার সমর্থনপুষ্ট কট্টরপন্থীরা উদারপন্থী রুহানির বিজয় ঠেকাতে তাদের সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। তবুও রুহানির বিজয়ই সুনিশ্চিত হয়েছে।

ধারণা করা যায়, জনতার এ অভাবিত রায়টি উগ্রবাদের বিরুদ্ধে তাদের ভেতরে জমে থাকা প্রবল প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ। এবারের নির্বাচনে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির অবস্থান নিয়ে অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন রুহানি। কারণ, রুহানির প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক বিচারপতি ইব্রাহিম রাইসি এই ধর্মীয় নেতার ঘনিষ্ঠজন। উল্লেখ্য, মূলত রেভলিউশনারি গার্ড বাহিনী ৫৬ বছর বয়সী কট্টরপন্থি ও রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত ইব্রাহিম রাইসিকেই চরমভাবে সমর্থন করেছিলেন। শক্তিশালী রেভলিউশনারি গার্ড বাহিনীসহ একাধিক রাষ্ট্রযন্ত্র নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রয়েছে এই ধর্মীয় সর্বোচ্চ নেতার। অন্যদিকে, মজলিস বা সংসদের সীমিত ক্ষমতা রয়েছে। অতএব, প্রেসিডেন্ট পদের জন্য সীমিত ক্ষমতা অবশিষ্ট থাকে। তা সত্ত্বেও এই পদের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। প্রকাশ্যে না বললেও স্বয়ং খামেনি রাইসিকেই সমর্থন করেছিলেন। এর পরও রুহানির রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, নেতৃত্ব, যোগ্যতা ও দূরদর্শিতা তাঁকেই বিজয়ী করেছে। 

নির্বাচনের ফল বিবেচনায় অনেকটা পরিষ্কার ধারণা করা যাচ্ছে, সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি একটি শক্তিশালী নেতৃত্ব গড়ে তুলতে যাচ্ছেন। নির্বাচনের এই ফল দেশটির ইতিবাচক ভবিষ্যৎকে ইঙ্গিত করছে নিশ্চিতভাবে। বিশ্ব রাজনীতিতে ইরানের অর্থনীতি পুনর্নির্মাণের লক্ষ্যে রুহানির বিশেষ প্রচেষ্টার ফল হিসেবে এই নির্বাচনের ফলকে বিবেচনা করা যেতে পারে। 

ইরানের আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা কমানোর প্রতিশ্রুতিতে রুহানি চার বছর আগে ক্ষমতায় বসেছিলেন। বিশেষত, ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে ইরানের স্বাক্ষরিত পরমাণুবিষয়ক চুক্তি এবং দেশটির ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জনমতকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের সাফল্য তুলে ধরতে হাসান রুহানি ২০১৫ সালে ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে ইরানের স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তির কথা উল্লেখ করছেন নানা সময়ে। এসবের প্রেক্ষাপটে বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি নির্বাচিত হয়েছেন বলে ধারণা করা যায়। দেশটির জটিল রাজনৈতিক কাঠামোয় একাধিক ক্ষমতাকেন্দ্র রয়েছে। 

রুহানি একজন বাস্তববাদী ও অপেক্ষাকৃত নরমপন্থী বলে পরিচিত। আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রায় একঘরে হয়ে থাকা দেশটিকে অনেকটাই উন্মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।

বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সমাজের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর করায় ইরানের ওপর অনেক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হচ্ছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রেও তিনি বেশ সক্রিয় রয়েছেন।

মূলত নির্বাচনী প্রচারণায় রুহানি ভোটারদের বিভিন্ন বিষয়ে বারবার সতর্ক করেছিলেন। বিশেষ করে রাইসি ক্ষমতায় এলে দেশ আবার কয়েক বছর পিছিয়ে যাবে এবং অর্থনীতির আরো ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছিল রুহানির চিরন্তন স্লোগান। এ জন্যই হয়তো ইরানিরা রুহানিকে নির্বাচিত করেছেন। ১৯৮১ সাল থেকে ইরানে সব প্রেসিডেন্টই দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছে। এবারও এর ব্যতিক্রম হলো না।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রেভলিউশনারি গার্ড বাহিনী ও তাদের আজ্ঞাবহ বাসিজ মিলিশিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত বিতর্কিত ছিল। ২০০৯ সালে তারা ভোটগণনার ক্ষেত্রে কারচুপি করে মাহমুদ আহমেদিনিজাদকে জিতিয়ে দিয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। ফলে গোটা দেশে প্রায় নয় মাস ধরে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ দেখা গিয়েছিল। 

নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল ইরানের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। বিশেষত, এবারের নির্বাচন প্রেসিডেন্ট রুহানির জন্য অগ্নিপরীক্ষা ছিল। ট্রাম্প-যুগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন তাঁর জন্য হবে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। 

২০১৩ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর বেকারত্ব হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়ন এবং পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের মতো পদক্ষেপে জনপ্রিয়তা বেড়েছে বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির। এবার নির্বাচনী ইশতেহারে তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায়। রক্ষণশীলদের দাবি, পরমাণু চুক্তির ফলে পিছিয়ে পড়েছে ইরানের অর্থনীতি। তবে সংস্কার ও উদারপন্থী ছাড়াও নারী সমাজের বড় অংশই রুহানির পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। 

পরিশেষে যে কথাটি না বললেই নয়, রুহানিকে দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দৃঢ়করণের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্লোগানকে মজবুত করা সম্ভব হবে। মূলত এ লক্ষ্যেই রুহানি সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন—এটি সবার প্রত্যাশা। বিশেষ করে বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ইরানের আগামীর সামগ্রিক যাত্রা গঠনমূলক ও ইতিবাচক হবে বলেই স্পষ্ট ধারণা করা যাচ্ছে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।