প্রতিক্রিয়া

হোমোসেক্সুয়ালিটির ফেসবুকীকরণ

Looks like you've blocked notifications!

সমলিঙ্গ বিয়ে নিয়ে ফেসবুক এখন বেশ সরগরম। একদল তো আনন্দে আত্মহারা—না জানি কী বিশাল বিজয় হলো। প্রভু দেশ আমেরিকা বলেছে, এই বিয়ে ‘জায়েজ’—তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই। অন্যদল যথারীতি ‘নৈতিকতা’, ‘প্রকৃতি-বিরুদ্ধ’, ‘সৃষ্টি ধ্বংস’ এসব গপ্পো দিচ্ছেন। যেকোনো টপিক নিয়ে বাঙালির বাড়াবাড়ি ব্যাপারটা সম্ভবত মজ্জাগত। এবং ফেসবুক সে ব্যাপারটা, চায়ের স্টল থেকে তুলে অনলাইনে এনে দিয়েছে।

গত কয়েক দিন ধরে নিউজফিডের উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ছিল, প্রোফাইল পিকচার রঙিন করা থেকে শুরু করে সমলিঙ্গ বিয়ে যে বেশ প্রাকৃতিক একটা ব্যাপার, এই ব্যাখ্যাসংবলিত তথ্য। পক্ষে ও বিপক্ষের ব্যাখ্যা কমবেশি একই। বলা যায়, ‘কপি অ্যান্ড পেস্ট’। কেউ ভদ্র ভঙ্গিতে বলছেন, কেউ অপর পক্ষকে কটাক্ষ করে। একদল বোঝাতে চাইছে, হোমোসেক্সুয়ালিটি শুরু হলে মানব প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে, অর্থাৎ আমেরিকা যেহেতু ‘জায়েজ’ বলেছে, তাই আপামর জনসাধারণ কাল থেকেই এই পথে গমন করবেন। অন্যদল ব্যাপারটাকে ব্যক্তিগত অধিকার বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন।

সমলিঙ্গ বিয়ের পক্ষের ও বিপক্ষের বক্তব্যগুলো পড়তে বেশ মজাই পাচ্ছি। বিপক্ষের জন বলছেন, এটি প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। যুক্তিটি ছোঁ মেরে নিয়ে নিলেন পক্ষের জন। ‘সে তো প্রকৃতি মানুষকে ক্ষমতা দেয়নি আকাশে ওড়ার, তাও তো মানুষ উড়ছে। অন্ধকেও তো প্রকৃতি অনুমতি দেয়নি চোখে দেখার, তাও তো কর্নিয়া ট্রান্সপ্লান্ট করে সে দেখছে।’ এর পরে শুরু হয়ে যাচ্ছে মহান সব সমকামীর লিস্টি এবং জগৎকে দেওয়া সেসব সমকামীর উপহারের ফিরিস্তি। কেউ কেউ আবার এর সঙ্গে ধর্মকে টানছেন। ধর্মে বারণ, একজন আবার ছবি দিয়েছেন একজন সমকামী ইমামের। বলা যায়, এ বিষয়ে চিন্তাশীল মানুষের চিন্তায়, ফেসবুক এখন রীতিমতো জমজমাট।

এই ঝগড়া নিয়ে আমার খুব বেশি মাথাব্যথা নেই। লেখাগুলো পড়ছি, যুক্তিগুলো শুনছি—এই যা। তবে সম্প্রতি আমার একজন শিক্ষক এবং চিকিৎসক ডা. এ আর এম সাইফুদ্দিন একরাম স্যারের একটি স্ট্যাটাস বেশ ভালো লাগল। তিনি বেশ গুছিয়ে সমকামীদের এই বিজয়ের কিছু ইতিহাস লিখেছেন। এখানে তার কিছুটা উল্লেখ করছি।

‘অবশেষে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট গত ২৬ জুন সমলিঙ্গের মধ্যে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকে আইনগত বৈধতা দান করল। ১৯৯৬ সালে মার্কিন কংগ্রেস এবং প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সম্মতিক্রমে সমলিঙ্গের বিয়ে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ ছিল। প্রায় দুই দশক আন্দোলন করে সমকামীরা শেষ পর্যন্ত তাদের দাবি আদায়ের পথে সুপ্রিম কোর্টের সমর্থন পেল। এত দিন আন্দোলনের মুখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৬টি রাজ্যে কোনো না কোনোভাবে সমলিঙ্গের বিয়ে বৈধ ছিল। নতুন আইনের ফলে সবকটি রাজ্যেই তা বৈধতা পাবে। এর আগে দুনিয়ার আরো ২০টি দেশে সমলিঙ্গের মধ্যে বিবাহ বন্ধন আইনগত বৈধতা দান করা হয়েছে। মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের নতুন পাস করা আইনের ফলে এখন সমলিঙ্গের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ দম্পতিরা স্বাভাবিক নারী-পুরুষের বিয়ের মতোই আইনি সুবিধা পাবে, সরকারি নথিপত্রে তাদের জন্ম-মৃত্যুর হিসাব রাখা হবে এবং উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি অর্জনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।’

সমকামিতা পূর্বেও ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এ আইনের ফলে যা ঘটল, তা হচ্ছে সমকামীদের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বিবাহ বিচ্ছেদে ক্ষতিপূরণ কিংবা সম্পদের উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু আইনি সুবিধা এনে দিল। সবাই এর সঙ্গে নীতি কিংবা ধর্মকে কেন মেলানোর চেষ্টা করছেন, আমার তা খুব বেশি বোধগম্য হচ্ছে না। সমাজ, সামাজিকতা এসব বলে ব্যাপারটার একটা ‘ঠিক’ কিংবা ‘বেঠিক’ লেবেল দেওয়ার চেষ্টারও তো আমি কোনো অর্থ দেখি না।

আর ফেসবুকে যেহেতু বিতর্কে কেউ হারে না, তাই এই বিতর্ক থামবে বলে মনে হয় না। একসময় এরা এমনিতেই থামবে কিংবা হয়তো গ্রিসের সমস্যা নিয়ে বিতর্কে মেতে উঠবে। এবং আবার শুরু হবে, ‘তুই আমার চেয়ে বেশি জানিস?’  এই বিতর্ক কেন করছি? ‘নেই কাজ তাই খৈ ভাজ?’ হয়তো। আবার বলা যায়, আমরা সবাই নিজেকে সমাজের কিংবা নৈতিকতার পাহারাদার ভাবছি। তবে যা-ই ভাবি বা করি, পরিণাম একটাই হচ্ছে—কিছু বিনোদন। আমার নিজের এই লেখাটাও সেই একই কারণে।