অভিমত

অপরাধ ও শাস্তি

Looks like you've blocked notifications!

সম্প্রতি খবরের কাগজ কি আকাশ খবরের পর্দা খুলিলেই দেখা যায়, দেশে বড় বড় অপরাধ যেমন ঘটিতেছে তেমনই মুড়ি-মুড়কির মতন মৃত্যুদণ্ডও আকছার বাঁটিয়া দেওয়া হইতেছে। আমাদের দেশে এখনও যে বিলিতি আইনের চল আছে তাহার অন্তর্গত নীতি এই যে বরং দুইজন অপরাধী ছাড়া পাক, কোন নিরপরাধ যেন অকারণ দণ্ড না লাভ করে। আইনের ফোকর দিয়া বহু দাগী অপরাধী ছাড়া পাইয়া যাইতেছে—একথা অসত্য নয়। বড় বড় অপরাধীপ্রবর মধ্যে মধ্যে দেশাহিতৈষীর বেশে দাঁড়াইয়া ওয়াজ-নসিহতও করিতেছেন। আমরা তো একপ্রকার মানিয়াই লইয়াছি—অপরাধ দুই চারিটা হইলে হউক, উন্নতির অগ্রযাত্রা যেন ব্যাহত না হয়।

দেশে বিচার আচার যে কম হইতেছে—তাহাও নয়। প্রতিদিন কাগজের পর্দা সরাইলেই খবর পাওয়া যায় দুই কি চারিটা মৃত্যুদণ্ড বিতরণ করা হইয়াছে। আমাদের দেশে গণতন্ত্র নাই—এমন গুজব যাঁহারা ছড়াইতেছেন তাঁহাদের ভাবিয়া দেখিতে বলি দেখুন, আমাদের বিচার-ব্যবস্থায় অন্তত গণতন্ত্র বিরাজমান। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই মৃত্যুদণ্ডের স্বাদ ভোগ করিতেছেন। মাঝে মধ্যে দেওয়ালে সাঁটা পোস্টারও দেখি দুইদশটা। এই বা সেই অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড দাবি করা এইসব পোস্টারে কথিত অপরাধীর ফাঁস-আটা মুখচ্ছবিও দেওয়া থাকে। একদণ্ড ভাবিলেই বোঝা যায়, মৃত্যুদণ্ড জিনিশটা আমাদের সাধ্যের মধ্যে আসিয়া গিয়াছে। আমি এই নিবন্ধে সাহস করিয়া বলিতে চাই—এখন মৃত্যুদণ্ড একটা সাধের বস্তুও হইয়া উঠিয়াছে। সত্য বলিতেছি, দেওয়ালেরও চোখ আছে।

১৯৭১ সালের পরের কোন একসময় আমাদের প্রবীণ বন্ধু আবু সালেহ একটি ছড়ায় বলিয়াছিলেন, ‘ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কথা। রক্ত দিয়ে পেলাম শালার মরার স্বাধীনতা।’ কথাটা এতদিনে বুঝি আক্ষরিক সত্য হইয়া উঠিতেছে। কাহারও কাহারও জন্য স্বাধীনতা পাইবার একমাত্র পথ মৃত্যুদণ্ড লাভ করা। আর কাহারও জন্য বা মৃত্যুদণ্ড পাইবার একমাত্র পথ স্বাধীনতা লাভ করা।

এক্ষণে একটা প্রশ্ন আমাদের জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন দেখা দিয়াছে—এই যে আমরা এত ঘন ঘন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করিতেছি, তাহাতে কি অপরাধের মাত্রা বা অপরাধ-প্রবণতা আদৌ কমিতেছে? এ বিষয়ের সঠিক উত্তর পাওয়া অসম্ভব। কেননা এহেন সস্তায় মৃত্যুদণ্ড বিতরণ না করিলে—যে কেহ যুক্তি দেখাইতে পারেন—দেশে খুন, অপহরণ, রাহাজানি বা ধর্ষণক্রমে শত অপরাধ আরো হাজারগুণে বাড়িয়া যাইত। আমরা শুদ্ধ ভয়ে ভয়ে বলিতেছি, এত যে মৃত্যুদণ্ড ‘বিক্রয়’ করিতেছেন তাহাতেও কি অপরাধ কিছু পরিমাণে কমিয়াছে? তাহা হইলে উপায়?

আমরা স্বীকার করিয়া বলিব, এই প্রশ্নের সত্য উত্তর বলিয়া কিছু নাই। একটা উত্তর অবশ্য গ্রহণ করা যায়। মৃত্যুদণ্ডসহ এই দুনিয়ার সকল শাস্তির লক্ষ্য কিন্তু অপরাধ দূর করা নয়, অপরাধকে খানিক তফাতে রাখা। কে না জানে, এইভাবে অপরাধ রোধ করা যায় না। তাহাকে তাঁবে রাখা যায় বড়জোর। কথাটা খুলিয়া বলিতে হয়, মুষ্টিভিক্ষায় যেমন দারিদ্র দূর হয় না, তেমনি মৃত্যুদণ্ডেও অপরাধ পায়ে হাঁটিয়া চলিয়া যায় না। তো আমরা প্রতিদিন এহেন শাস্তির বিধান রাখিতেছি কেন? এক কদম আগাইয়া বলি, দিন দিন মনে হয় দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান জনপ্রিয় হইতেছে।

সৃষ্টির আদি হইতেই শাস্তির একটা লক্ষ্য বলা হইয়া থাকে অপরাধ দমন। কিন্তু আরেকটা লক্ষ্য সমানেই জারি আছে—ইহার নাম প্রতিশোধ গ্রহণ। কেহ কেহ ‘প্রতিশোধ’ শব্দটার সংশোধন করিয়া ‘প্রতিকার’ বলিয়া একটা মতবাদও খাড়া করিয়াছেন। ইঁহাদের মধ্যে এমানুয়েল কান্টের মতন বড় বড় জগদ্বিখ্যাত তত্ত্ববিজ্ঞানীও আছেন—একথা আমরা ভুলি নাই। তাহা হইলে এই দুঃখের শেষ কোথায়? আরও বলি—শেষ বলিয়া আদৌ কিছু আছে কি?

এখন হইতে আনুমানিক পাঁচশত বৎসর আগের কথা। যে দেশ পৃথিবীব্যাপী সাম্রাজ্যবিস্তার করিবার পর এতদিনে বৃদ্ধ হইয়া ঘাগু সিংহের মতো নিজের গুহায় ঝিমাইতেছে সেই প্রবীণ ইংলন্ড দেশের কথা। সেকালে ঐদেশের প্রবীণ তত্ত্বজ্ঞানী স্যার টমাস মোর (১৪৭৮-১৫৩৫) ‘এয়ুটোপিয়া’ বা ‘কল্পলোক’ নামে একটি উপন্যাস (১৫১৬-১৭) লিখিয়াছিলেন। ঐ উপন্যাসের গোড়ায় তিনি ইংলন্ডের তৎকালীন বিচারব্যবস্থার এক অবিস্মরণীয় ছবি আঁকিয়াছিলেন। স্যার টমাস মোর ছিলেন গ্রিক তত্ত্বজ্ঞানী প্লাতোন ওরফে আফলাতুনের পরম অনুরাগী। আফলাতুনের অনুকরণে দুই পণ্ডিতের সংলাপ আকারে টমাস মোরও তাঁহার উপন্যাসটা ফাঁদিয়াছিলেন।

‘কল্পলোক’ উপন্যাসের এক জায়গায় জনৈক আইনজীবী বলিতেছেন, ইংলন্ডের আইনই এই দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ আইন, কেননা ইংলন্ডের আইনে কোন চোর-ছ্যাঁচড়কেও একরত্তি ছাড় দেওয়ার অবকাশ হয় না। প্রমাণস্বরূপ তিনি এক আইনের নজির দেখাইলেন। তখন সে দেশের সব জায়গায় চোর ধরা পড়িবামাত্রই ফাঁসি দেওয়া হইতেছিল। তিনি জানাইলেন, একই ফাঁসির কাঠ হইতে কখনো কখনো একযোগে বিশজন করিয়া চোরও ঝোলানো হইতেছে।

এইটুকু বলিয়াই ভদ্রলোক ক্ষান্ত হন নাই। তিনি আরো একটা কথা বলিলেন, ‘অবাক কাণ্ড কি জানেন, যেখানে হাতে গোনা দুইচারিজন বাদে প্রায় সকল চোরকেই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হইতেছে সেখানে কোথা হইতে জানি না এত এত চোর গজাইয়া উঠিতেছে।’ এই প্রস্তাবের উত্তরে টমাস মোরের নায়ক—ইঁহার নাম রাফায়েল হিথলোদে আর ইনি ভুবন পর্যটকও বটেন—বলিলেন, ‘এখানে তো অবাক হইবার কিছু নাই : চোর-ছ্যাঁচড়ের শাস্তিস্বরূপ এইভাবে মৃত্যুদণ্ড বাঁটিয়া দেওয়াটার মধ্যে আর যাহাই থাকুক ন্যায়-বিচার আদৌ নাই। আর সবচেয়ে বড় কথা ইহাতে দেশের ও দশের কোন উপকারও হইতেছে না। শাস্তির মধ্যে মৃত্যুদণ্ডই হইল সবচেয়ে বড় শাস্তি, অথচ অপরাধ দমনের ওষুধ বিচারে এই দণ্ড তো মোটেও কাজে আসিতেছে না।’

রাফায়েল হিথলোদে কথাটার আরো একটু ব্যাখ্যা যোগ করিলেন, ‘সাধারণ ছিঁচকা চুরিও অপরাধ বটে—একথা সত্য। কিন্তু এই লঘু অপরাধে মানুষের মাথা কাটিবার মতন গুরুদণ্ড দেওয়া তো সমীচীন নয়। তদুপরি, যাহাদের জীবনধারণের কোন উপায়-উপকরণ নাই তাহারা চুরি বা ডাকাতি তো করিবেনই—শাস্তিটা যত কঠিনই হোক, যত নির্দয়ই হোক, তাহাতে কেহ চুরি কিংবা ডাকাতি রোধ করিতে পারিবেন না।’ উপন্যাসের কাহিনী অনুসারে, রাফায়েল হিথলোদের বাড়ি পর্তুগাল দেশে। তিনি ভুবন ভ্রমিয়া শেষে টমাস মোরের দেশে আসিয়াছেন। তিনি একাধারে তত্ত্বাবিশরাদ এবং অভিজ্ঞ নাবিক।

রাফায়েল বলিলেন, ‘এই অপরাধ ও শাস্তি বিষয়ের এস্তেমাল করিতে বসিয়া আপনারা—এই ইংলন্ডদেশীয় বিজ্ঞলোকেরা—কোন কোন আজেবাজে শিক্ষকের মতো আচরণ করিতেছেন। বাজে শিক্ষকরা কি করেন, তাঁহারা ছাত্র-ছাত্রীদের না পড়াইয়া উল্টা তাহাদের ধরিয়া ধরিয়া ঠ্যাঙানি দেন। আপনারাও চুরির মতন সামান্য অপরাধে কঠিন কঠিন ও ভয়ানক শাস্তির আইন বানাইয়াছেন। অথচ তাহা না করিয়া আপনারা এমন ব্যবস্থা তো করিতে পারিতেন যাহাতে দেশের সকল মানুষ যে যাহার জীবিকা হয় মতো আয়-উপার্জন করিতে পারেন। অথচ এখন কিনা তাহারা বাঁচিয়া থাকিবার ভয়াবহ দায়ে পড়িয়া প্রথমে করিতেছেন চুরি আর পরে পরিণামে—চুরির দায়ে—মারা পড়িতেছেন।’

আলাপের এই পর্যায়ে আইনজীবী মহোদয় বলিলেন, ‘সে ব্যবস্থা তো আছেই। দেশে কাজের অভাব নাই। ইচ্ছা করিলেই তাহারা একটা না হোক আরেকটা কাজে নামিয়া পড়িতে পারেন—দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য আছে না? চাষবাসের কাজ তো পড়িয়াই আছে। ইহারা ইচ্ছা করিয়াই বদমায়েশি করিতেছে।’

রাফায়েল তখন বলিলেন, ‘এইভাবে যুক্তি দেখাইয়া তো আপনি পাড় পাইবেন না। যাহারা বিগত দুই দুইটা যুদ্ধে—একটা দেশের ভিতরের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায়, অন্যটা ফ্রান্সের রাজার সহিত যুদ্ধে—এই ইংলন্ডেই না কত লোক যে আহত ও পঙ্গু হইয়া ফিরিয়াছে। বিদ্যার মধ্যে ইহারা জানিতেন একটাই—সেই যুদ্ধবিদ্যা—এখন যুদ্ধে তাহাদের কাজ কি! এদিকে এই বয়সে নতুন কোন বিদ্যাশিক্ষার মুরোদও তাহাদের নাই।’ রাফায়েলের মতে, এই ছাঁটাই হওয়া সৈনিকেরাই দেশের একটা বিরাট বোঝা হইয়া দাঁড়াইয়াছেন। চুরি-ডাকাতি ছাড়া তাহাদের আর উত্তম কোন পেশা নাই।

তাহা ছাড়া দেশের বড়লোকেরা তো রহিয়াছেনই। তাহাদের মধ্যে যাঁহারা জমিদার তাহার দিনকে দিন জমির খাজনা বাড়াইতেছেন আর গরিব চাষীদের সুযোগ পাইলেই কৃষিজমি হইতে উচ্ছেদ করিতেছেন। বড়লোকদের থাকে পাইক পেয়াদা বরকন্দাজ লাঠিয়াল। কখনো যদি এক জমিদারের মৃত্যু হয়, তখন অনেক পাইক পেয়াদা চাকরি হারায়। তখন ইহাদের চোর-ডাকাতের দলে যোগ দেওয়া ছাড়া অন্য পথ থাকে না। কারণ দেশে ততদিনে পরিবর্তন ঘটিতেছে। পুঁজির প্রাথমিক সঞ্চয়ন শুরু হইয়াছে।

স্যার টমাস মোর—রাফায়েলের মুখ দিয়া—পরিশেষে বলিলেন, ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে ইংলন্ডে ভেড়ায় মানুষ খাওয়া শুরু করিয়াছিল। কারণ জমির মালিকেরা পশমের চাষ করিবার মতলবে হাজার হাজার কৃষকের জমি কাড়িয়া লইতেছিলেন। আর সেই জমিতে ফসলের চাষ না করিয়া পশম ছাঁটিবার উপযোগী ভেড়া চরাইতে শুরু করিয়াছিলেন তাঁহারা। এইভাবে ভূমি হইতে উচ্ছেদ হইয়া চাষীসমাজের একাংশ চুরি-ডাকাতির পথ বাছিয়া লইতে বাধ্য হইয়াছিলেন। উনিশ শতকের একজন বিখ্যাত গবেষক—রাফায়েল হলিনশেড—দেখাইয়াছেন একা অষ্টম হেনরি নামক এক রাজার রাজত্বকালেই (১৫০৯-১৫৪৭) ইংলন্ড দেশে ৭২,০০০ চোরকে ফাঁসিতে ঝোলানো হইয়াছিল। তাহাতে চুরির প্রকোপ দুই আনাও কমে নাই।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ।

(বি. দ্র. : রচনায় লেখকের বানানরীতি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে—ফিচার সম্পাদক)