সৌদি আরব

আগ্রাসী এক যুবরাজের উত্থান

Looks like you've blocked notifications!

মণীষী মার্কস ‘দ্বন্দ্বগত বস্তুবাদ’ এর মাধ্যমে পৃথিবীর তাবৎ ঘটনাবলীর নানা ধরনের বিশ্লেষণ করেছেন। রাজা- রাজধানীর উত্থান-পতনে এই দ্বন্দ্ব বিগ্রহ আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়- ক্ষমতার রাজনীতি কত নির্মম নিষ্ঠুর এবং পৈশাচিক। ক্ষমতার রাজনীতিতে নিয়মনীতি,  নৈতিকতা ও মানবিকতার কোনো স্থান নেই। এখানে পিতা পুত্রকে হত্যা করে, পুত্র পিতার বিরুদ্ধে যায়, ভাই ভাইয়ের জীবন কেড়ে নেয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানি হিউম বলেন, ‘Politics is seen to be about might rather than right’। শক্তি ক্ষমতার বৈধতার সৃষ্টি করে, কারণ ক্ষমতা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কর্তৃত্ব দেয়।

বিশেষত যেখানে গণতন্ত্রের লেশ মাত্র নেই, সেখানে উত্তারাধিকার অথবা ‘প্রাসাদ ষড়যন্ত্র’ ই একমাত্র ক্ষমতা বদলের মাধ্যম। বর্তমান বিশ্বে গণতন্ত্রের প্রাবল্যে মধ্যপ্রাচ্যের সামান্তবাদী দেশগুলো একমাত্র ব্যতিক্রম যেখানে রাজা-বাদশাহ , আমীর-ওমরাহ এবং শাহ-সুলতানরা প্রবল পরাক্রমে আজও ‘শাসন করেন ও রাজত্ব করেন’। এসব ব্যাকরণিক পরিপ্রেক্ষিতে সৌদি রাজতন্ত্রের সাম্প্রতিক পরিবর্তন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

গত ২২ জুন একটি আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থার খবরে বলা  হয় সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান তার উত্তরসূরির পদ থেকে নিজের ভাইপো মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে দিয়ে ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে বসিয়েছেন। সৌদি বাদশাহী ফরমানে এ ঘোষণা প্রদান করা হয়। এ ফরমানের মাধ্যমে প্রবল ক্ষমতাশালী বিন নায়েফ ক্ষমতাচ্যুত হলেন। তিনি ভবিষ্যৎ বাদশাহ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে দৃশ্যত বিদায় নিলেন। নতুন যুবরাজ ৩১ বছর বয়সী বিন সালমান উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। পাশাপাশি প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করবেন। আর ৫৭ বছর বয়সী বিন নায়েফকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

সৌদি বার্তা সংস্থা : সৌদি প্রেস এজেন্সি- এসপিএ জানিয়েছে বিন নায়েফ নতুন যুবরাজকে সহযোগিতার অঙ্গীকার করেছেন। সৌদি রাজতন্ত্রের লৌহ কঠিন ব্যবস্থা থেকে সাবেক যুবরাজের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ একরকম অসম্ভব। বিবিসির বিশ্লেষণে বলা হয়, ৮১ বছর বয়স্ক বাদশাহ শারীরিক ভাবে অসুস্থ। বিগত দিনগুলোতে তিনি ক্রমশ নিজ পুত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছিলেন। উল্লেখ্য,  সৎভাই আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজের মৃত্যুর পর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে বাদশাহ সালমান সৌদি সিংহাসনে আরোহণ করেন। দেশটিতে সচরাচর ৭০ বছরের বেশি বয়স্ক ব্যক্তিরা বাদশাহ হয়ে আসছেন। সে হিসাবে প্রিন্স সালমানের দ্রুত উত্থান একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে। অনুসৃত নীতি অনুযায়ী সৌদি রাজতন্ত্রের প্রবীণ ব্যক্তিরা উত্তরাধিকার নির্ণয় করেন। বাদশাহর ছেলেই বাদশাহ হবেন- এ নিয়ম সৌদি রাজতন্ত্রে কার্যকর নয়। বরং এত দিন কনসেনসাস বা সার্বিক সমঝোতার ভিত্তিতে উত্তরাধিকার বিবেচিত হয়ে আসছিল। বিন সালমানকে একক সিদ্ধান্তে রাজতন্ত্রের উত্তরাধিকারী নির্ধারণ সেক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা।

যুবরাজ বিন সালমানের জন্ম ১৯৮৫ সালের ৩১ আগস্ট। তার মা ফাহদাহ বিনতে ফালাহ বিন সুলতান তৎকালীন প্রিন্স সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের তৃতীয় স্ত্রী। রাজধানী রিয়াদের কিংসৌদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তার বাবা যখন রিয়াদের গভর্নর ছিলেন তখন বিন সালমান গভর্নরের বিশেষ পরামর্শক নিযুক্ত হন। ২০১৩ সালে তিনি মন্ত্রী পদ মর্যাদায় দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তাঁকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়। যুবরাজ মনোনীত হওয়ার আগে থেকেই বিন সালমান প্রভাবশালী হিসেবে আবির্ভূত হন। অতি রক্ষণশীল রাজতান্ত্রিক দেশটিতে অর্থনৈতিক ও সামজিক সংস্কার আন্দোলনের নানা উদ্যোগে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। ২০১৫ সালে উপযুরাজের পদ পাওয়ার পর থেকেই ক্ষমতার আওতা সম্প্রসারণে তিনি যত্নবান ছিলেন। তিনি অতিমাত্রায় রক্ষণাত্মক এবং আগ্রাসী বলে ইতিমধ্যে বিশেষত্ব অর্জন করেছেন। যুবরাজ সালমানই সেই ব্যক্তি যিনি ‘জাজিরাতুল আরব’ বা ‘আরব উপদ্বীপে’ ইরান তথা অন্য যেকোনো শক্তির উপস্থিতি অবদমনে অগ্রসর হন।

বাদশাহ সালমানের ছেলে বিন সালমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে প্রথম যে কাজটি করেছিলেন,  সেটি ছিল ২০১৫ সালের মার্চে  ইয়েমেনে মাসরিক অভিযানের সূচনা। এ অভিযানের মাধ্যমে সৌদিআরবের আগের চেয়ে বেশি আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনার আভাস পাওয়া যায়। যুবরাজ সালমান সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক স্থবিরতা দূরীকরণে এক ধরনের নীতি পর্যালোচনার পক্ষপাতী বলে বার্তা সংস্থার খবরে জানা গেছে। সার্বিকভাবে তেলের ওপর নির্ভরতা হ্রাসে তিনি উদ্যোগী। বিকল্প সম্পদ সন্ধানে তিনি মনোযোগী। সৌদিআরবের বিশাল সমুদ্র উপকূলে সাগর সম্পদ আহরণে তিনি বিবিধ পরিকল্পনা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া নানা রকম অর্থনৈতিক সংস্কারে তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ী। তিনি যেহেতু পশ্চিমা বিশ্বের অধিকতর আস্থাশীল,  সে জন্য তাঁর ইমেজ গড়ার জন্য পশ্চিমা গণমাধ্যম উপযুক্ত ইতিবাচক মন্তব্য প্রদান করছেন বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা।

৯/১১-এর বিপর্যয়ের পর মার্কিন যুক্তরাষ্টের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক শীতল হয়ে আসে। বারাক ওবামার সময়কালে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলেও ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তিতে বেজায় ক্ষিপ্ত হয় সৌদি আরব। ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে সবসময় শঙ্কিত থেকেছে সৌদি রাজতন্ত্র। ইরান যেহেতু রাজতন্ত্রবিরোধী এবং শিয়া মতাবলম্বী তাই সৌদিরা ইরানকে তাদের সিংহাসনের প্রতি সবচেয়ে বড় হুমকি বলে মনে করে। এ ছাড়া ‘আরব বসন্ত’ তথা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভয়ে সৌদি রাজতন্ত্র ভীত হয়ে আছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প চরম ইসলাম বিদ্বেষী হওয়া সত্ত্বেও ওবামার শাসন অবসানের পর শুধু ক্ষমতা রক্ষায় সৌদিরা নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সম্প্রীতির সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে উন্মুখ হয়ে পড়ে। নতুন যুবরাজ বিন সালমান ছুটে যান ওয়াশিংটনে। গোপন দেন-দরবার করে আস্থা অর্জনের চেষ্টা করেন।

বিগত মার্চ মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কূটনীতিকদের ধারণা এর ফলেই ট্রাম্প সর্বপ্রথম সৌদিআরব সফর করেন। এই সফরের সময়ে সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে বড় ১০ বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সৌদি আরব ইরানের বিরুদ্ধে ‘ব্লাঙ্ক চেক’ লাভ করে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন- ডোলান্ড ট্রাম্পের সফরের ১৫ দিন পর সৌদি আরব এবং তার মিত্ররা নিরপেক্ষ কাতারের বিরুদ্ধে যে সর্বাত্মক অবরোধ ঘোষণা করে তা ট্রাম্পের সফরের ফল স্বরূপ। আর এর কৃতিত্ব খানিকটা নতুন যুবরাজের কাঁধেই বর্তায়। স্মরণ করা যেতে পারে যে ট্রাম্পের সৌদি আরব সফরের সময় সাবেক যুবরাজ বিন নায়েফকে নিষ্প্রভ দেখা গেছে। কোনো কোনো বিশ্লেষক সন্দেহ পোষণ করেন যে পরিবর্তনটি মার্কিন শর্ত অনুযায়ী হয়েছে কি না। মিডল ইস্ট মনিটর বাদশাহ হওয়ার জন্য ‘মার্কিন শর্ত’ প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, জার্মানিতে বসবাসরত সৌদি প্রিন্স খালিদ বিন ফারহান আল সৌদ বাবার অবর্তমানে মোহাম্মদ বিন সালমানকে সৌদি বাদশাহ হতে সহায়তা করার জন্য মার্কিন শর্তাবলীর কথা প্রকাশ করেছেন। এক টুইটে খালিদ লিখেছেন, সৌদি আরবের ক্ষমতাসীন রাজপরিবারের এক সূত্রে তিনি শর্তসমূহ জানতে পেরেছেন। এসব শর্তাবলীর মধ্যে রয়েছে :

১. যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে এবং তারা যা বলবে পালন করতে হবে।

২. গাজার সব ফিলিস্তিনিকে সৌদি আরব ও আমিরাতের অর্থায়নে বিকল্প আবাসস্থল হিসেবে উত্তর সিনাইয়ে পুনর্বাসিত করার পক্ষে কাজ করা।

৩. হামাসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করা।

৪. মিসরের কাছ থেকে সানাফি দ্বীপ ফেরত পাওয়া।

রাজতেন্ত্র বা সৌদি ধরনের নিয়ন্ত্রিত সমাজে ঘটনার সত্যতা বা নেপথ্যের খবর জানা খুবই কঠিন। ইতিমধ্যে বিন নায়েফকে গৃহবন্দি করা হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। যথারীতি সৌদি কর্মকর্তারা তা অস্বীকার করেছেন। সৌদি রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের খবরও উড়িয়ে দিয়েছেন ওই কর্মকর্তা। নিউইয়র্ক টাইমস প্রথম ওই বন্দিত্বের খবর প্রকাশ করে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী সাবেক যুবরাজ নায়েফকে লোহিত সাগরীয় নগরি জেদ্দার রাজপ্রাসাদে আটকে রাখা হয়েছে এবং তাঁকে দেশের বাহিরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। পর্যবেক্ষক মহল মন্তব্য করছে, ‘নতুন যুবরাজের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের বিরোধিতা সীমিত রাখতে ওই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। রাজ পরিবারের মধ্যে যে নিরঙ্কুশ সংহতি নেই- নায়েফের পদচ্যুতি এর বড় প্রমাণ। সৌদি রাজপরিবারে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে তার ছিটেফোঁটা সংবাদ ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ বার্নাড হেইকেল মনে করেন, ‘তাঁকে (বিন সালমান) যুবরাজ পদে নিয়োগ দিয়ে বাদশাহ সালমান কার্যত মরহুম বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে সৌদের ছেলেদের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তোলার কয়েক দশকব্যাপী ঐতিহ্য থেকে সরে আসার একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিলেন।’ এত দিনের প্রচলিত ঐতিহ্যের ব্যতিক্রম এই যে একটি ঐক্যের আবহাওয়া থেকে একক কর্তৃত্বের রেওয়াজ চালু হলো। কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার ইতিবাচক দিক হলো- ব্যক্তি যদি ন্যায়বান এবং নাগরিক কল্যাণকামী হয় তা দেশের জন্য শান্তি ও স্বস্তি বয়ে আনে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একে বলে ‘বেনি ভোলেন্ট ডিকটেটর শিপ’। আর যদি এর বিপরীত হয়, শাসক হয় অন্যায়-অত্যাচারী, নির্মম- নিপীড়নকারী, সহিংস-স্বৈরাচারী এবং দলবাজ-চাদাঁবাজ-দূর্নীতিবাজ, তাহলে মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। এভাবে নিরঙ্কুশ ক্ষমতাশালীদের সম্পর্কে বলা হয়- Absolute power corrupts, absolutely’। সৌদি আরবের জন্য বাংলাদেশের মানুষের ব্যাপক আবেগ রয়েছে। অফুরন্ত আবেগ দিয়ে আমরা প্রার্থনা করি এ পরিবর্তন  সৌদি জনগণের জন্য সতত শান্তি, স্বস্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনুক।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়