অভিমত

চলচ্চিত্রের অবনতি ঘটাবে এইচডি প্রজেক্টর

Looks like you've blocked notifications!

সংবাদমাধ্যমে জানতে পারলাম, তথ্য মন্ত্রণালয়ে চলচ্চিত্র পরিবারের নেতাদের সঙ্গে তথ্যমন্ত্রীসহ অন্য উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের এক সভায় যৌথ প্রযোজনার নীতিমালা পুনরায় সংশোধন না করা পর্যন্ত যৌথ প্রযোজনা বন্ধ রাখাসহ আরো কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ছে। আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি  বিষয় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

জাজের একচেটিয়া প্রজেক্টর ভাড়া দেওয়া তথা সিনেমা হলের ওপর কর্তৃত্ব বন্ধ করার জন্য নাকি সরকার বিএফডিসির তত্ত্বাবধানে সারা দেশে আপাতত ৫০টি সিনেমা হলে এইচডি প্রজেক্টর বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা একটা আত্মঘাতী এবং জনগণের ট্যাক্স-ভ্যাটের টাকার চরম অপচয়ের ব্যবস্থা মাত্র। যদি এটা হয় তাহলে এফডিসিতে যাঁরা নিয়মিত ঠিকাদারি করেন অর্থাৎ ইকুইপমেন্টস সরবরাহ করেন, তাঁরাসহ কিছু কর্মকর্তা লাভবান হবেন কিন্তু প্রতারিত হবে জনগণ। কারণ, এইচডি প্রজেক্টর ডিজিটাল সিনেমার জন্য মানসম্পন্ন নয়। এইচডি প্রজেক্টর দিয়ে প্রদর্শিত চলচ্চিত্রকে সারা বিশ্বে বলা হয় ইলেকট্রনিকস সিনেমা বা ই-সিনেমা। এই প্রযুক্তি ডিজিটাল সিনেমা বা ডি-সিনেমার সমকক্ষ নয়। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে হলে, সারা বিশ্বের ডিজিটাল সিনেমার মান নিয়ন্ত্রণের জন্য গঠিত সংস্থা ডিসিআই বা ডিজিটাল সিনেমা ইনেসিয়েটিভের কারিগরি নিয়মবদ্ধ বিবরণ গুগল থেকে ডাউনলোড করে যে কেউ জানতে পারবেন। অথবা আমার লেখা বই- ডিজিটাল সিনেমা, নির্মাণ থেকে প্রক্ষেপণ পড়লেই অনেক তথ্য পাওয়া যাবে।

বর্তমানে ভারত, মিয়ানমার এমনকি নেপালসহ সারা বিশ্বের সিনেমা হলে সত্যিকার ডিজিটাল প্রক্ষেপণের জন্য 2K প্রজেকশন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। কারণ, একমাত্র 2K প্রজেকশনকেই ডিজিটাল প্রজেকশন বলে গণ্য করা হয়, অন্য কোনো ফরম্যাটকে না। ডিসিআইর বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী, ন্যূনতম 2K রেজ্যুলেশন শুটিং,  ন্যূনতম 2K রেজ্যুলেইশনে সম্পূর্ণ পোস্ট প্রডাকশন এবং ন্যূনতম 2K রেজ্যুলেশন ছবি প্রক্ষেপণ করলেই তাকে ডিজিটাল সিনেমা বলা যাবে বা ডিজিটাল সিনেমা বলে গণ্য করা হবে। এর ব্যতীত অন্য যে কোনো রেজ্যুলেশন ছবি নির্মাণ করলে তাকে বলা হয় ইলেকট্রনিক সিনেমা।

ডিজিটাল প্রযুক্তিতে শুটিং এবং প্রক্ষেপণ করার জন্য প্রতিটি ফ্রেমে থাকে নির্দিষ্ট সংখ্যক পিক্সেল অথবা পিকচার অ্যালিমেন্টস বা ছবির উপাদান। চারকোনা আকারের প্রতিটি ক্ষুদ্র পিক্সেলের মধ্যে থাকে রং ও আলোর তথ্য। প্রতিটি পিক্সেল ডিজিটাল ছবির ক্ষুদ্র প্রতিনিধিত্ব করে। একটি ছবিতে যত বেশি পিক্সেল, ছবি তত বেশি ঝকঝকে, উজ্জ্বল এবং তার রং বাস্তবের তত কাছাকাছি। 2K মানে প্রতিটি ফ্রেমে আছে 2048x1080 পিক্সেল। অন্যদিকে এইচডি ফরম্যাটে আছে 1920x1080 পিক্সেল। সংখ্যার দিক থেকে 2K-তে যেমন পিক্সেল বেশি তেমনি এর সাইজও বড় এবং কালার ও লাইট ইনফরমেশন ধারণ করার ক্ষমতাও অনেক বেশি। অতএব 2K ফরম্যাটে ছবির ধারণ ও প্রক্ষেপণ মান অনেকগুণ উন্নত। তা ছাড়া 2K প্রজেক্টরে আলো উৎপন্ন করার ক্ষমতাও অনেক বেশি। এই আলো পরিমাপ করা হয় লুমেন্সের মাধ্যমে। একটি 2K প্রজেক্টরে গড়ে আলো উৎপন্ন হয় ২০ হাজার লুমেন্স, অন্যদিকে জাজের ব্যবহৃত প্রজেক্টরগুলোতে গড় আলো তৈরি করে ছয় হাজার লুমেন্স। অতএব ছবি তুলনামূলক অন্ধকার এবং ঘোলাটে।

আমাদের মূল ধারার চলচ্চিত্রে সাত-আট বছর ধরে বেশির ভাগ চলচ্চিত্রই ন্যূনতম 2K রেজ্যুলেশন শুটিং এবং পোস্ট প্রডাকশন করা হয়। কিন্তু প্রদর্শনের বেলায় শুধু স্টার সিনেপ্লেক্স এবং ব্লকবাস্টার ছাড়া সব সিনেমা হলেই এইচডি প্রজেক্টর দিয়ে ছবি প্রদর্শিত হয়। উপজেলা অথবা গ্রামেগঞ্জে আরো নিম্নমানের প্রজেক্টর, যেমন- মাল্টি মিডিয়া লেজার প্রজেক্টর দিয়ে ছবি দেখানো হয়, যার গুণগত মান অত্যন্ত দুঃখজনক।  এভাবে প্রায় এক দশক ধরে ডিজিটাল সিনেমার নামে সিনেমা প্রদর্শকরা দর্শকদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে এবং ফলে আপামর দর্শকদের তথাকথিত এই ডিজিটাল সিনেমার স্পষ্টতা এবং রং ও শব্দের প্রতি অভক্তি চলে এসেছে। 

বারকো কোম্পানির চায়নার তৈরি RLMW-6 মডেলের প্রজেক্টর এবং স্থানীয়ভাবে তৈরি সার্ভার দিয়ে একশোর বেশি সিনেমা হলে ছবি প্রদর্শন চালু করে। এই প্রজেক্টরের দাম আনুমানিক ১০ হাজার ডলার অর্থাৎ আট-সাড়ে আট লাখ টাকা এবং সার্ভার বানাতে খরচ লাখ খানেক টাকা। এর ভাড়া বাবদ জাজ প্রতি সপ্তাহে প্রযোজকদের কাছ থেকে নিচ্ছে বারো হাজার টাকা, যা শুরুর দিকে ছিল ২০ হাজার টাকা। এই প্রজেক্টরের জন্য ব্যবহৃত সার্ভারে MP4 অথবা MOV ফাইল ব্যবহার করে ছবি প্রদর্শিত হয়। এই ফাইলগুলো সহজেই কপি করা যায়। যতই পাসওয়ার্ড দিয়ে একটা সিনেমার ফাইলকে সুরক্ষিত করা হোক না কেন, যে কোনো ছোট খাট হ্যাকার দিয়েই এই পাসওয়ার্ড হ্যাক করা যায়। তাই তো প্রায়ই সিনেমা পাইরেসি হয়ে যায়। আগে ৩৫ মিঃ মিঃ-এর আমলে ছবি পাইরেসি করতে চোরদের ভিডিও ক্যামেরা ভাড়া করে হলের লোকদের সঙ্গে চুক্তি করে পাইরেসি করতে হতো। এখন ছবি হার্ডডিস্ক অথবা পেনড্রাইভ দিয়ে খুব কম সময়ে কপি করে ফেলা যায় এবং একটি সিনেমা ঢাকার বাইরে পৌঁছানোর আগেই রাস্তায় বসেই কপি হয়ে যায়।

2K প্রজেক্টরের জন্য নির্ধারিত ফাইল হচ্ছে MXF ফাইল। এই ফাইল থাকে DCP মানে ডিজিটাল সিনেমা প্যাকেজ ফাইলের মধ্যে, যা পোর্টেবল হার্ডডিস্কের মাধ্যমে সিনেমা হলে পৌঁছে দেওয়া হয়। ডিসিপির মধ্যে সিনেমার ফাইলটি KDM মানে কি ডেলিভারি ম্যাসেজ নামের একটি এনক্রিপশন প্রযুক্তি দিয়ে লক করে সুরক্ষিত করা হয়। এই KDM কেউ হ্যাক করতে পারে না। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত কেউ পারেনি। সারা বিশ্বের সব বড় বড় ব্যাংকের লকারে এই একই KDM প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ব্যাংকের লকার যেহেতু হ্যাক হওয়ার ইতিহাস নেই অতএব ডিসিপিও হ্যাক হওয়ার কোনো ইতিহাস এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। অতএব ডিসিপি কপি করা যায় না। প্রযোজকের অনুমতি ছাড়া ডিসিপিতে সরবাহকৃত সিনেমা যে কয়টি শোয়ের জন্য দেওয়া হয়েছে তার বাইরে একটি ফ্রেমও চালানো যায় না। ডিসিপে দেওয়া ছবি পাইরেসি করা যায় না।

ডিসিপি চলে একমাত্র 2K প্রজেক্টরে। প্রকৃত ডিজিটাল প্রযুক্তি 2K উপেক্ষা করে, প্রযোজকদের ছবির নিরাপত্তা বারবার হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে কাদের পরামর্শে মন্ত্রণালয় এইচডি প্রজেক্টর বসানোর সিদ্ধান্ত নিল? 2K প্রজেক্টরের ঝকঝকে ছবি ও উজ্জ্বল আলো এবং চোখজুড়ানো রঙের বদলে এইচডি প্রজেক্টরের ঘোলাটে ও অনুজ্জ্বল ছবি দর্শকদের দেখানোর জন্য কেন মন্ত্রণালয়ের অভিজ্ঞ কর্তাব্যক্তিরা এইচডি প্রজেক্টর বসানোর জন্য একমত হলেন? কার স্বার্থে এই আত্মঘাতী এবং পশ্চাৎগামী সিদ্ধান্ত? যেখানে সারা বিশ্ব সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশের পলিসি মেকাররা কেন পেছানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন? জননেত্রী এবং জাতির জনকের যোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী যেখানে দিনরাত প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে, সেখানে কারা চাচ্ছে এ দেশের সিনেমা হলে ইলেকট্রনিকস প্রযুক্তি চালু করে ডিজিটাল বাংলাদেশে গড়ার পরিকল্পনাকে ধ্বংস করতে? এর পেছনে কাদের স্বার্থ জড়িত? অনুসন্ধান করে পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে কিছু কিছু স্বার্থ এখানে উল্লেখ করা যায়।

১. 2K প্রজেক্টরের বদলে এইচডি প্রজেক্টর বসালে সিনেমার পাইরেসি অব্যাহত থাকবে। মুখ থুবড়ে পড়বে একের পর এক ছবি। প্রযোজকরা ছবি বানানো বন্ধ করে দেবেন। চলচ্চিত্রশিল্প প্রযোজকশূন্য হয়ে যাবে। এফডিসি কর্মহীন হয়ে পড়বে এবং একসময় ওই ষোল একর জমি যাবে কোনো চ্যানেলের দখলে অথবা ডেভেলপার নামের ইটের জঙ্গল বানানোর কারিগরদের বাণিজ্য লুটপাটের অধীনে। 

২. বাংলাদেশে ডিজিটালের নামে ইলেকট্রনিকস সিনেমার নির্মাণ শুরু হয়েছে বেশ আগে। এইচডি প্রজেক্টর বসালে এই পদ্ধতি স্থায়ী হয়ে যাবে। বাংলাদেশের সিনেমা আর কখনই প্রকৃত ডিজিটালে রূপান্তর হবে না এবং সারা বিশ্ব থেকে আমরা সব সময়ই পিছিয়ে থাকব। কিন্তু লাভবান হবেন তাঁরা, যাঁরা এইচডি ফরম্যাটে ছবি বানান অর্থাৎ টিভি মিডিয়ার কিছু নিম্নমানের নির্মাতা যাঁরা সিনেমার নামে বড়পর্দায় নাটক বানান।
৩. সরকার নিজেই এইচডি ফরম্যাট চালু করলে মফস্বলের সিনেমা হলগুলোতেও এই পদ্ধতি বসাতে উৎসাহী হবে এবং এই সুযোগে ভারত থেকে গণহারে পুরোনো এইচডি প্রজেক্টর সীমান্ত পেরিয়ে আসতে থাকবে। কারণ, ভারতের কিছু প্রতিষ্ঠান যারা একসময় প্রচুর এইচডি প্রজেক্টর বসিয়েছিল এবং কয়েক বছর ধরে 2K-তে রূপান্তরিত হচ্ছে, তারা তাদের পুরোনো রদ্দিমালগুলো এ দেশে গেলাতে মরিয়া হয়ে উঠবে। এ ব্যাপারে এরই মধ্যে বিজয় খ্যামকা এবং জয় খ্যামকা নামে দুই মাড়োয়ার ভাই ঢাকার সিনেমাপাড়ায় ঘুরঘুর করছেন এবং বেশকিছু সিনেমার লোক ও সরকারি পর্যায়েও মিটিং করেছেন। 

৪. যেসব সিনেমা হলের লোক অথবা কাকরাইলপাড়ার চলচ্চিত্র প্রতিনিধি বা বুকিং এজেন্টরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাইরেসির সঙ্গে জড়িত, তারা কখনই 2K সমর্থন করবে না। কারণ 2K এলে পাইরেসি বন্ধ হয়ে যাবে।
৫. 2K প্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্ত আরো অনেক সুবিধা প্রযোজকরা পাবেন। যেমন-থিয়েটার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (TMS) সফটওয়্যারের মাধ্যমে একজন প্রযোজক তাঁর অফিসে বসে ল্যাপটপে অথবা যেকোনো জায়গায় বসে এন্ড্রয়েড ফোন অথবা আইফোনে দেখতে পাবেন টোটাল সেল, দর্শকসংখ্যা, শো টাইমসহ আরো অনেক বিষয়। এমনকি তিনি দূরে বসেই এসব নিয়ন্ত্রণও করতে পারবেন। নিশ্চয়ই সিনেমা হলের মালিকরা এগুলো পছন্দ করবেন না।

৬. জাজ মাল্টিমিডিয়াও 2K-র বিরোধিতা করবে। কারণ, ৫০টি সিনেমা হলে 2K প্রযুক্তি বসালে বাণিজ্যিক প্রতিযোগীয় টিকে থাকতে তাদেরও 2K প্রজেক্টরে নতুন করে বিনিয়োগ করতে হবে। যেটা হবে তাদের জন্য বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ। পাশাপাশি তাদের এইচডি প্রজেক্টরগুলো অকেজো হয়ে যাবে এবং তারা হবে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। অতএব জাজকে রক্ষা করতে কিছু কর্তাব্যক্তির দুরভিসন্ধি হতে পারে এইচডি প্রজেক্টর আনার পরিকল্পনা।

আমরা আর কত পিছিয়ে থাকব? যখন ৩৫ মিঃমিঃ-এর সময় প্রায় শেষ, তখন বিএফডিসি কর্তৃপক্ষ কোনো প্রযোজক, পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা না করেই একটা সাব-টাইটেল মেশিন আনল। মাত্র সাত থেকে আটটি ছবি সাব-টাইটেল করা হয়েছে সেই মেশিনে। তার পর থেকে প্রায় দুই কোটি টাকার মেশিনটি নিথর পড়ে আছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি আসার প্রাক্কালে কোটি টাকা খরচ করে ৩৫ মিঃমিঃ-এর জন্য একটি হেজেলটাইন মেশিন আনা হয়েছে। সেটিও পড়ে আছে বছরের পর বছর। কার স্বার্থে কর্তৃপক্ষ এ অপচয় করে? সম্প্রতি এফডিসির সাউন্ড কমপ্লেক্সে কোটি টাকা খরচ করে বসানো হয়েছে ক্রিস্টি কোম্পানির একটি 4K প্রজেক্টর ও সার্ভার। যে দেশে এখন পর্যন্ত 2K প্রজেকশনই নিশ্চিত করা যায়নি, যেখানে মাত্র দুটি সিনেমা হল বাদে সব হলেই এইচডি অথবা আরো নিম্নমানের প্রদর্শন পদ্ধতি, সেখানে শুধুমাত্র প্রিভিও প্রজেকশনের জন্য কোন যুক্তিতে, কার স্বার্থে 4K প্রজেক্টর বসানো হয় তা বোধগম্য নয়! এফডিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুখে এ নিয়ে কষ্টের কথা শোনা যায়। তাঁরা বলেছেন, আহারে! শুধু শুধু কোটি টাকা দামের মেশিন পড়ে আছে, যেখানে কালেভদ্রে একটি-দুটি ছবির প্রদর্শন হয়।

যখনই কোনো ইকুইপমেন্টস আমদানির প্রয়োজন হয়, তখনই বিএফডিসি বুয়েট থেকে লোক এনে ইকুইপমেন্টস তালিকা তৈরি করে এবং তার ওপরে ভিত্তি  করে প্রাক্কলন তৈরি হয়। এখানে আমাদের কখনো সম্পৃক্ত করা হয় না। অথচ আমরাই হচ্ছি এর ব্যবহারকারী বা গ্রাহক। ভাবখানা এমন, বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার হলেই উনি তাবৎ বিশ্বের প্রযুক্তি সম্পর্কে সব জানবেন। তাঁদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, চলচ্চিত্রবিষয়ক নতুন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আমরা যারা চলচ্চিত্রের কিছু মানুষ গবেষণা করি, পড়াশোনা করি, তাঁদের সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে আরো উদার হতে হবে। নইলে কিছু ঠিকাদার আর কিছু অসাধু কর্মকর্তার পকেট ভারী করতে অব্যাহতভাবে জনগণের ট্যাক্স-ভ্যাটের টাকা বিএফডিসি কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শ্রাদ্ধ হতেই থাকবে।

৫০টি এইচডি প্রজেক্টর আমদানির সংবাদ শুনে নিশ্চয়ই এফডিসির যারা নিয়মিত ঠিকাদার, যেমন- Rangs, উজ্জ্বল বাবু (যার নামে মান্না ডিজিটাল সাউন্ড কমপ্লেক্সে ইকুইপমেন্টস আমদানিবিষয়ক জালিয়াতির মামলা চলছে এবং তারপরও তিনি বিএফডিসিতে বহাল তবিয়তে ঠিকাদারি করে যাচ্ছেন) এতদিনে গোঁফে তেল দেওয়া শুরু করেছেন। কী আসে যায় তাদের? কী আসে যায় কার? চলচ্চিত্র ধ্বংস হলেই বা কার কী? গোল্লায় যাবে প্রযোজকদের কষ্টার্জিত টাকা, বেকার হবে শিল্পী, কলা-কুশলীরা, শূন্য হবে সরকারের কোষাগার আর ডিজিটাল সিনেমার নামে, গুণগত মানের ছবি ও শব্দের নামে প্রতারিত হবে অসহায় জনগণ। বেলা শেষে ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়াবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প আর আমরা যারা চলচ্চিত্রের হাজার হাজার স্বপ্নবাজ মানুষ আছি, তারা হব কর্মহীন।

এবার আসা যাক কত টাকা লাগে এইচডি প্রজেক্টরের বদলে 2K বসাতে?

বিশ হাজার লুমেন্সের বারকো কোম্পানির 2K প্রজেক্টর ও সার্ভার আনুমানিক ৪৫ থেকে ৫০ লাখের মধ্যে বসানো সম্ভব। সে ক্ষেত্রে ৫০টি সিনেমা হলে খরচ পড়বে ২৫ কোটি টাকা। একটি রুগ্ণ শিল্পকে বাঁচাতে একটি সরকারের জন্য কি ২৫ কোটি টাকা অনেক বেশি? আমাদের সরকার কি অনেক প্রতিষ্ঠানকে পুনরুজ্জীবিত করতে এর চেয়েও শতগুণ বেশি টাকা খরচ করে না? মনে রাখতে হবে, হল মালিকদের 2K প্রজেক্টর বসাতে যেন অনুদান দেওয়া না হয়। অনুদানের টাকায় কেনা জিনিসের প্রতি কারো কোনো যত্ন থাকবে না। উদাসীনতা আর অযত্নে ওই প্রজেক্টর ছয় মাসের মধ্যে নষ্ট হয়ে পড়ে থাকবে। তা ছাড়া অনুদান পাওয়ার জন্যও শুরু হবে নানা ধরনের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং তদবির বাণিজ্য। এই টাকাটা যেন দেওয়া হয় বিনা সুদে এবং সহজ শর্তে। তাহলেই পেশাদারিত্ব বজায় থাকবে।

আমাদের চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেক মানুষের মুখেই শোনা যায়, আমাদের 2K দরকার নাই, এইচডি হলেই চলবে। সরকার যা দেয় তাতেই খুশি। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো ইত্যাদি। এই মানুষগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি ক্ষুদ্র এবং এরা প্রযুক্তি-কানা। এরা শুধু বর্তমান নিয়েই উত্তেজিত থাকে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে বিচলিত হয়ে পড়ে। এই ধরনের লোকগুলোর জন্যই এক রাস্তা দশবার ভাঙতে হয়। আমাদের প্রতিটি কর্মে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা থাকতে হবে। ভাবতে হবে পাঁচ বছর পরে কী হবে, কী প্রযুক্তি আসতে পারে। আমাদের তার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। তা ছাড়া সরকার আমাদের জন্য যা করছে তা কি জাকাত নাকি? সরকার যা করে তা তার জনগণের কল্যাণের জন্য করে এবং জনগণও তাদের এবং আগামী প্রজন্মের কল্যাণকে মাথায় রেখে সরকারের কাছ থেকে তাদের পাওনাটা বুঝে নেবে। এটাই গণতান্ত্রিক লেনদেন। এখানে কেউ কাউকে দয়া বা অনুগ্রহ করছে না।

পরিশেষে বলতে চাই, মন্ত্রণালয় যেন কোনো প্রযুক্তিকানা স্বার্থান্বেষী মহলের পরামর্শে আন্দোলনরত চলচ্চিত্র কর্মীদের খুশি করার জন্য কোনো ভুল সিদ্ধান্ত না নেয়। মন্ত্রী মহোদয়কে অনুরোধ করব, এইচডি প্রজেক্টরের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে উনি যেন 2K প্রজেক্টরের দিকে দৃষ্টি দেন। তাহলে আমরা সময়ের সঙ্গে একই গতিতে চলতে পারব। 2K প্রজেক্টরে ছবি দেখাতে হলে ডিসিপি বানাতে হয়। ডিসিপি তৈরির প্রযুক্তি ও লোকবলও এফডিসিতে আছে। অতএব প্রতিটি ছবি মুক্তির প্রাক্কালে ডিসিপি তৈরি বাবদ এফডিসি আয় করতে পারবে লক্ষ লক্ষ টাকা। এইচডি প্রজেক্টরে ডিসিপি লাগে না, তাই এ ক্ষেত্রে এফডিসি বঞ্চিত হবে আয় থেকে। বিষয়টা নিয়ে ভাবুন তারপর সিদ্ধান্ত নিন। আসুন আমরা সবাই মিলে বঙ্গবন্ধুকন্যার স্বপ্নসাথী হয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ি, চলচ্চিত্র ধ্বংসের সড়যন্ত্রকারীদের ইলেকট্রনিকস বাংলাদেশ নয়।

লেখক : চলচ্চিত্র পরিচালক