শিক্ষা
একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি, প্রয়োজন আত্মসমালোচনা
একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবার এমন এক কাণ্ড ঘটাল- শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের দুর্ভোগের সীমা স্মরণকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেল এবং শেষ পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেই তাঁদের দায় এড়ালেন। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের সচিব অভিজ্ঞ ‘খেলোয়াড়’, তিনি ওই পথে না হেঁটে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করলেন। খেলাধুলায় ওনারা যে সিদ্ধহস্ত, সেটি খেলার মাঠ কিংবা ছেলেময়েদের জীবন হোক, সর্বত্র এই পারদর্শিতা তাঁরা দেখাতে পারেন। এ জন্য লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিচ্ছু ছেলেমেয়েদের মুল্যবান সময় ক্ষেপণ করে টি-টোয়েন্টিতে ছক্কা মারার কথা বলতে সাহস দেখান। আমরা মনে করি, এটি সচিব সাহেবের সাহসের প্রশ্ন, প্রশ্ন ধৃষ্টতারও।
সমগ্র জাতি যখন এমন জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লজ্জায় ডুবে ছিল, তরুণ ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের চোখেমুখে যখন আমরা বিপুল হতাশার ছবি দেখেছি ঠিক তখনই এ ধরনের নির্লজ্জ কথন আমাদের গালে যেন চপেটাঘাত করেছে। গণমানুষের চিন্তা এবং স্বার্থের সঙ্গে প্রকৃত অর্থে এই গোষ্ঠীর স্বার্থের ফারাক বিস্তর।
এখানে ভালো খবর হলো, শিক্ষামন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেছেন, এই দুঃখ প্রকাশ যথেষ্ট নয়, এ কথা আমরা সবাই জানি এবং মানি। কিন্তু এই অনিয়ম ও অরাজকতার যুগেও এটিকে আমরা একটি ভালো সংস্কৃতির উদাহরণ হিসেবে নিতে পারি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানান অনিয়মের কথা চারদিকে বিভিন্ন সময়ে চাউড় হয়। এখন সেখানে মন্ত্রী ও সচিবের মধ্যে সমন্বয়হীনতার খবর পত্রিকায় বেরিয়েছে। তাঁদের এই অভ্যন্তরীণ সংঘাতে বিপদে পড়েছি আমরা জনসাধারণ। কথিত স্মার্ট পদ্ধতিতে ভর্তি করতে গিয়ে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তিচ্ছুরাই যে কেবল বিপদে পতিত হয়েছে বিষয়টি মোটেও এমন নয় বরং এই পদ্ধতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জ্ঞান এবং জানা-বোঝার পরিধি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
আধুনিক যুগে বসবাস করে তথ্যপ্রযুক্তির জোয়ারকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না, বরং এই ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের খাপ খাইয়ে নিয়ে সহযোগিতা করতে হবে। এটি আমাদের কর্তব্য এবং আগামীদিনের অগ্রগতি ও উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু সেই কাজটি কী পদ্ধতিতে হবে, কেমন হবে তার একটি রূপরেখা প্রণয়নও কম জরুরি নয়। হঠাৎ করে নয়া এক পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের মাঝে ছেড়ে দিয়ে, পদ্ধতির খুঁটিনাটি এবং বিস্তারিত না বর্ণনা করে এবং এর সম্ভাব্য জটিলতা দূর না করেই সেটি বাজারে ছেড়ে সুফল লাভ করা মুশকিল।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি এ সব বিষয় বিবেচনায় না এনেই ডিজিটাল পদ্ধতির নামে নিত্যনতুন যন্ত্রণা শিক্ষার্থীদের কাঁধে চাপিয়ে দেয় এতে বিপদের যেমন অন্ত থাকে না, তেমনি প্রযুক্তির প্রতি মানুষের ভালোবাসার বদলে বিতৃষ্ণাও বৃদ্ধি পায়। আমাদের লক্ষ্য যদি হয় মানুষ এবং বিজ্ঞানের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা, মানুষকে বিজ্ঞানমনষ্ক করে তোলা- তবে এ ধরনের হয়রানি অবশ্যই বন্ধ করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই উদ্যোগ নিতে হবে প্রযুক্তি সম্পর্কিত বিষয়াদিকে সহজবোধ্যভাবে শিক্ষার্থীদের মাঝে উপস্থাপন করা এবং যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে এর জন্য শুধু দুঃখ প্রকাশই যথেষ্ট নয় বরং প্রয়োজন বাস্তবসম্মত আত্মসমালোচনাও।
লেখক : অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়