আন্তর্জাতিক

নওয়াজ শরিফ ক্ষমতাচ্যুত : একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

Looks like you've blocked notifications!

অব্যাহত অস্থিতিশীলতার দেশ পাকিস্তানে আবারও অস্থিতিশীলতার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ২৮ জুলাই, ২০১৭ সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে প্রধানমন্ত্রী এবং জনপ্রতিনিধিত্বের জন্য অনুপযুক্ত ঘোষিত হয়েছেন। ১০ বছর এ আদেশ বহাল থাকবে। তিনি কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। এমন কি  রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং নির্বাচনী  প্রচারণা থেকে তাঁকে বিরত থাকতে হবে।

পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ সীমিত। তার পরও মনে হয় অনেকটা আকস্মিকভাবেই নওয়াজ শরিফের পতনের সংবাদ এলো। এমনিতেই পাকিস্তানে নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক কালে শক্ত আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফ-পিটিআই প্রধান সাবেক ক্রিকেট কিংবদন্তি নায়ক ইমরান খান। পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী শক্তি জুলফিকার আলী ভুট্রোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি-পিপিপি বেশ কয়েক বছর ধরে উত্তরাধিকার সংকটে ভুগছে। বেনজির ভুট্টোর স্বামী আসিফ আলী জারদারীর নেতৃত্ব কেউ মানছে না। তাই পুত্র বালক বেলাওয়াল ভুট্টোকে নেতৃত্বে হাজির করার চেস্টা পরিলক্ষিত হয়েছে। কিন্তু তার সফলতা বহন করেনি। এতদসত্ত্বেও পিপল্স পার্টি নওয়াজ শরিফ বিরোধী আন্দোলনে ভালো ভূমিকা রেখেছে। তবে গণআন্দোলন এমন তীব্রতা অর্জন করেনি যা শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে নওয়াজ শরিফকে অকালেই ক্ষমতাচ্যুত হতে হলো। উল্লেখ্য যে, ২০১৬ সালে প্রকাশিত পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারির ধারাবাহিকতায় তাকে গতিচ্যুত হতে হলো। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত পাঁচজন সদস্যদের আদালত এ সর্বসম্মত রায় প্রদান করেন। পাকিস্তানের দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শরিফ পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। গত বছর পানামা পেপার্স নামে কথিত অনেক বিশ্ব নেতার অর্থনৈতিক দুর্নীতি ও কলেঙ্কারির সঙ্গে নওয়াজ শরিফের নাম যুক্ত হয়। এর ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানে তার পদত্যাগ এবং বিচারের দাবি জোরদার হয়ে ওঠে।

পানামা পেপার্স সম্পর্কে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মিশ্র মতামত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, এটি বৈশ্বিক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের একটি অংশ। এতে মার্কিন ও ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার হাত থাকতে পারে বলে সন্দেহ পোষণ করা হয়। তবে বিশ্বের বাঘাবাঘা রাঘোব বোয়ালদের পানামা পেপার্সে নাম রয়েছে। এতে রয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, কমপক্ষে ১২ জন বর্তমান রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান। আরো রয়েছে নিওলেন মেসির মতো ক্রিড়া তারকার নাম। পানামা পেপার্স মূলত এক কোটি ১৫ লাখ ট্যাক্স ফাঁকির দলিলপত্র। পানামা ভিত্তিক আইন প্রতিষ্ঠান মোসাক ফরেনসাক ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল এসব পেপার ফাঁস করে দিয়ে বড় ধরনের এক কেলেঙ্কারি বাঁধিয়ে দেয়।

প্রতিষ্ঠানটি দাবী করে আসছে যে ১০০টিরও বেশি গণমাধ্যমের প্রাপ্ত তথ্য এতে সন্নিবেশিত রয়েছে। এরা আরও দাবী করছে যে, পৃথিবীর দীর্ঘ ইতিহাসে তারাই একমাত্র প্রতিষ্ঠান যারা ১৪০ বিশ্ব নেতার অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির তথ্যপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করছে।

বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই প্রতিবেদনে সরাসরি নওয়াজ শরিফের নাম উল্লেখ নেই। তবে তার মেয়ে মরিয়ম শরিফ এবং ছেলে হাসান শরিফ ও সোহাইন শরিফের নাম রয়েছে। পানামা পেপার্স প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি তদন্ত করার জন্য যে কমিটি গঠিত হয় তারা শরিফ পরিবারের সরাসরি অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়।বিষয়টি আরও পঙ্খানুপঙ্খভাবে যাচাই বাছাই করার জন্য একটি যৌথ কমিটি গঠিত হয় । কমিটি শরিফ পরিবারের বিপুল অর্থ বিত্তের উৎস জনতে চান। কিন্তু তারা সহায় সম্পত্তির পক্ষে আইনানুগ তথ্য প্রমাণাদি দিতে ব্যর্থ হয়।

নওয়াজ শরিফ পাকিস্তানে তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরেও শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। ১৯৪৯ সালে পাঞ্জাবেরর এক ধনাঢ্য পরিবারের জন্ম গ্রহণ করেন নওয়াজ শরিফ। তাঁর বাবা মোহাম্মদ শরিফ ইত্তেহাদ গ্রুপের মালিক ছিলেন। শরিফের বড় ভাই শাহবাজ শরিফ তিন তিন বার পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এখন তিনিই নওয়াজ শরিফের স্থলাভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন। শরিফ ছিলেন কমার্সের ছাত্র। তিনি লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ৭০ দশকের শেষের দিকে সামরিক প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের সময়ে তিনি পাঞ্জাব প্রদেশের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৮৫ সালে তিনি পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে সামরিক আইন প্রত্যাহারের পর তিনি সপদে ফিরে যান। ১৯৯০ সালে তিনি মুসলিম লীগের একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেন এবং বিজয় অর্জন করেন। তাঁর এই বিজয়ে সামরিক বাহিনীর সমর্থন ছিল বলে ধারণা করা হয়। নির্বাচন শেষে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন। প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খানের সঙ্গে মতদ্বৈততা দেখা দিলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ কাল পূর্ণ করার আগেই পদচ্যুত হন।

এই বরখাস্ত আদেশের বিরুদ্ধে শরিফ আইনি লড়াই শুরু করেন। ১৯৯৩ সালে সেনা বাহিনীর হস্তক্ষেপে তিনি এবং প্রধান বিচারপতি উভয়েই অপসারিত হন। নওয়াজ শরিফ দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হন। এবারও তিনি  বিচার বিভাগ এবং সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মত দ্বৈততায় জড়িয়ে পড়েন। সেনা বাহানী প্রধান জেনারেল কেরামতকে তিনি পদচ্যুত করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে সেনা বাহিনী নিযুক্ত করেন। তবে শিগগিরই কার্গিল যুদ্ধের  ব্যর্থতার অভিযোগে মোশাররফকে ক্ষমতাচ্যুত করার আদেশ দেন।

কিন্তু উল্টো ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর সেনাবাহিনী তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। শরিফ সৌদিআরবে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এর ২০১৩ সালের নির্বাচনে একটি জোট সরকারের প্রধান হিসেবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সময়ে তিনি সফলভাবেই রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। নিরাপত্তা ও অর্থনীতিক ক্ষেত্রে তিনি কৃতিত্ব দাবী করতে পারেন। ২০১৫ এবং ২০১৭ সালে দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে ইসলামী চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে তিনি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময়ে সন্ত্রাসী তৎপরতার দ্বারা শান্তি-শৃঙ্খলা ব্যহত হলেও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা অর্জিত হয়। বিশ্ব অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো তাকে উদার সাহায্য দেয়। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে সম্পাদিত ‘চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর-সিপিইসি’র সূচনা তিনিই করেন। চীন থেকে গোয়াদার সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত ‘ওয়ান বেল্ড ওয়ান রোড প্রকল্পের আওতায়’ পাকিস্তান  বিপুল অঙ্কের অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ করে। পাকিস্তানের চরমপন্থী ইসলামী ভাবধারায় তিনি তার প্রাথমিক শাসন কাল থেকে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে আসছেন। তাঁর সবচেয়ে ব্যর্থতা নিজ পরিবারকে দুর্নীতি ও অসৎ উপায় থেকে রক্ষা করতে না পারা।

বিচার বিভাগের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক বজায় রাখতে না পারাটাও তাঁর একটি বড় ব্যর্থতা বলে চিহ্নিত হচ্ছে। যেকারণে তার সমস্ত সফলতা ম্লান হয়ে আজ পদচ্যুত হতে হলো।

নওয়াজ শরিফের পদচ্যুত হওয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বা প্রয়ৌগিক হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। পাকিস্তানের হাজারো রাজনৈতিক ব্যর্থতার মাঝে দীর্ঘকাল ধরেই বিচার বিভাগের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার ইতিবাচক উদাহরণ রয়েছে। আর তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক মানদণ্ডে সফল একজন নওয়াজ শরিফের বিদায় দুঃখজনক।       

লেখক : প্রফেসর, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।