স্মরণ

তবু বলব না বিদায়

Looks like you've blocked notifications!

গাড়িটির নম্বর ঢাকা মেট্রো-চ-১৩-০৩০২। একটি বারো আসনের সাদা মাইক্রোবাস। দিনটি ছিল শনিবার। ১৩ আগস্ট, ২০১১ সাল। ঠিক ছয় বছর আগের কালো, বেদনার, যন্ত্রণার, শোকের দিনটির কথাই বলছি আমি। সকালে ঘুম থেকে জেগে এমন একটি সংবাদ দেখবে বাংলাদেশের মানুষ, তার জন্য কেউ কখনই প্রস্তুত ছিল না।

১৩ আগস্ট ২০১১ শনিবারের সকাল এমন চরম দুঃসংবাদ বয়ে আনবে, তা কল্পনার বাইরে ছিল। মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় দেশের কৃতী চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ নিহত হয়েছেন! শিরোনাম শুনেই কেঁদে ফেলেছিল পুরো বাংলাদেশ। এ কেমন কথা! এ কেমন প্রস্থান!

আবু তারেক মাসুদ, তারেক মাসুদ নামেই সর্বক্ষেত্রে পরিচিত (জন্ম ৬ ডিসেম্বর, ১৯৫৬—মৃত্যু ১৩ আগস্ট ২০১১, আসলে তাঁর মৃত্যু নেই) তারেক মাসুদ নামটি ছোট। কিন্তু তারেক মাসুদের কর্মপরিধি ওই দিগন্তব্যাপী বিস্তৃত। পৃথিবীর যে প্রান্তেই গিয়েছি, আমার সঙ্গে সব সময় ‘মুক্তির গানে’র ভিসিডি ও পরে ডিভিডি থাকত, আজও আছে। তাঁর মৃত্যু এখনো দুঃস্বপ্ন বলেই মনে হয়। হ্যাঁ, এটা আমাদের কাছে একটা দুঃস্বপ্নই। তাই তারেক মাসুদ, এখনো তো তোমাকে বিদায় বলতে পারিনি হে প্রিয়।

তারেক আছেন আমাদের শিল্পে, মননে ও স্মরণে। বাংলা চলচ্চিত্র যত দিন থাকবে, তারেক মাসুদ তত দিন থাকবেন। তিনি চলচ্চিত্রের মহারথী ছিলেন। তাঁর সব স্বপ্ন আর পরিশ্রম ছিল চলচ্চিত্রের জন্য। তাঁর মতো ভালো নির্মাতা, চলচ্চিত্রপ্রেমী শতবর্ষে একজন আসে এই বাংলায়। তারেক সব সময় আছেন, থাকবেন। আফসোস হয় তাঁর শূন্যতা পূরণের মতো কেউ নেই বলে।

তারেক মাসুদ ছিলেন বাংলা মায়ের কাদামাটির লালিত কৃতী সন্তান। লাখো বাঙালি তরুণ যখন বিদেশে অভিবাস নিয়ে স্থায়ী হওয়ার জন্য তুমুল জীবনযুদ্ধ করছিলেন, তখন তারেক মাসুদ জানান তিনি বাংলাদেশেই স্থায়ী হবেন। বিয়ে করেছিলেন ক্যাথরিন মাসুদকে। তারেক ক্যাথরিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অনেকেই ভেবেছিলেন, ক্যাথরিন বাংলাদেশে গিয়ে স্যাটেল হতে পারবেন তো? হ্যাঁ, ক্যাথরিন পেরেছিলেন এবং তাঁর পাশের আসন থেকেই সড়ক দুর্ঘটনায় চিরবিদায় নিয়েছেন বাংলাদেশের এই কর্মবীর সন্তান তারেক মাসুদ।

তিনি বাংলা সিনেমার একজন ফেরিওয়ালা। নিজের সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন বহুবার। চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়কে এবং বাংলাদেশকে তুলে ধরার দায়িত্ব নিয়েছিলেন যেন তিনি। এই চলচ্চিত্র নির্মাণকাজে ব্যস্ত থাকা অবস্থায়ই আকস্মিকভাবে মহাপ্রয়াণ ঘটে বাংলা চলচ্চিত্রের এই কৃতী সন্তানের।

তারেক মাসুদ চলচ্চিত্র-সংক্রান্ত কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হন বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন। তিনি চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। চলচ্চিত্র নির্মাণ-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে তিনি দেশে-বিদেশে অনেক কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৮২ সালে তিনি শিল্পী এস এম সুলতানের ওপর ডকুমেন্টারি ‘আদম সুরত’ নির্মাণ শুরু করেন। আদম সুরত মুক্তি পায় ১৯৮৯ সালে। এর আগে অবশ্য ১৯৮৭ সালে ‘সোনার বেড়ী’ নামে বাংলাদেশের নির্যাতিত নারীদের ওপর তিনি ২৫ মিনিট স্থায়িত্বের একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। ১৯৯২ সালে স্ত্রী ক্যাথেরিন মাসুদের সঙ্গে যৌথভাবে তারেক একটি অ্যানিমেশন শর্ট ফিল্ম নির্মাণ করেন, যার দৈর্ঘ্য মাত্র তিন মিনিট। তারেক মাসুদ মুক্তির গান চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকদের কাছে ব্যাপকমাত্রায় পরিচিতি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার দুর্লভ কিছু ফুটেজ থেকে মুক্তির গান চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন তারেক মাসুদ।

২০০২ সালে মাটির ময়না চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিতে ভূমিকা পালন করেন তিনি। বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে একাডেমি অ্যাওয়ার্ডসের বিদেশি মুভির ক্যাটাগরিতে প্রতিযোগিতা করে এই চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র নির্মাণ ছাড়া তারেক মাসুদ চলচ্চিত্র বিষয়ে লেখালেখি করেছেন। মাটির ময়না চলচ্চিত্রের প্রিক্যুয়েল হিসেবে তারেক মাসুদ ‘কাগজের ফুল’ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ চলচ্চিত্রের লোকেশন দেখে ফেরার সময় মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বালিয়াজুড়িতে এক সড়ক দুর্ঘটনার শিকান হন। এতে তিনি ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আশফাক মুনীর মিশুকসহ পাঁচজন নিহত হন।

দুর্ঘটনায় নিহত বাকি তিনজন হলেন মাইক্রোবাসচালক মুস্তাফিজ, তারেক মাসুদের প্রোডাকশন ম্যানেজার ওয়াসিম ও কর্মী জামাল। একই গাড়িতে ক্যাথেরিন মাসুদ থাকলেও সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। তারেক মাসুদের বাবার নাম মশিউর রহমান মাসুদ এবং মায়ের নাম নুরুন নাহার মাসুদ। ভাঙ্গা ঈদগাহ মাদ্রাসায় তিনি পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকার লালবাগের একটি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর মাদ্রাসা শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। যুদ্ধের পর তিনি মূলধারার শিক্ষায় প্রবেশ করেন। ফরিদপুরের ভাঙ্গা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার মাধ্যমে প্রথম বিভাগে এসএসসি পাস করেন। তিনি আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ছয় মাস পড়াশোনার পর বদলি হয়ে নটর ডেম কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর একটি পুত্রসন্তান রয়েছে, নাম ‘বিংহাম পুত্রা মাসুদ নিশাদ’। বাংলা চলচ্চিত্রে তারেক মাসুদের যে অবদান, তা আজীবন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরিত হবে।

তারেক মাসুদের একটি অন্যতম আগ্রহের বিষয় ছিল বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ। তিনি বিদেশে বিভিন্ন আর্কাইভ থেকে ফুটেজ সংগ্রহের কাজটি করছিলেন খুব দক্ষতার সঙ্গে। তারেক তাঁর সংগৃহীত বিভিন্ন ফুটেজ আমাদের দেখিয়েছিলেন। তা থেকেই সম্পাদনা করে তিনি নির্মাণ করেন 'মুক্তির গান', যা বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা-সংগ্রামের এক অনবদ্য দলিল।

তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর অনেক ভালোবাসা আপনাদের জন্য হৃদয়ের গহিনে বহমান। আমরা আপনাদের কবর দিইনি, রোপণ করেছি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে। আজও কাঁদছে বাংলাদেশ, কাঁদছে বাংলার চলচ্চিত্র। তারেক মাসুদ, আপনার সঙ্গে বেশির ভাগ মানুষেরই দেখা হয়নি সম্মুখ থেকে, দূর থেকে আপনাকে ও ক্যাথরিনকে অনেকেই দেখেছে। কিন্তু তারেক মাসুদকে হারানোর শোক বাঙালিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে আজ ছয় বছর পরও।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন।