জয় হোক মুক্তামণির ও বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার

Looks like you've blocked notifications!

সাতক্ষীরার মুক্তমণি। ছোটবেলা থেকেই হাতের মারাত্মক রকমের এক সমস্যায় ভুগছিল। বিরল এক রোগ নিয়ে রীতিমতো দুশ্চিন্তায় ছিলের মুক্তামণির বাবা ও মা। বিশাল আকৃতির হাত নিয়ে চলাফেরা করে শিশুটি। গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হলে চিকিৎসার উদ্যোগ নেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎকরা।

গত ১১ জুলাই রক্তনালীতে টিউমার নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করানো হয় শিশুটিকে। তার ডান হাত ছিল অস্বাভাবিক দুগর্ন্ধযুক্ত ও ফোলা। শিশুটি স্বাভাবিকভাবেই জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু দুই বছর বয়সে তার ডান হাতে ছোট একটি টিউমার দেখা যায়। যা ধীরে ধীরে বড় হতে শুরু করে এবং গত দুই বছর ধরে ব্যাপক আকারে বাড়তে থাকে।

মুক্তামণির চিকিৎসা শুরু করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরা। এ ক্ষেত্রে শুধু রোগ নির্ণয় করতে সফল হন তাঁরা। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চিকিৎসকরা জানতে পারেন মুক্তামণির হাতের রক্তনালিতে টিউমার রয়েছে। যা বাংলাদেশের অন্যান্য হাসপাতালের চিকিৎসকরা নির্ণয় করতে ব্যর্থ হন।

এই রোগের চিকিৎসার জন্য গত ২৭ জুলাই সিংঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের চিকিৎসকরা। এক ই-মেইলের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল জানায়, মুক্তামনির এই রোগটি ভালো হওয়ার নয়। অপারেশনের মতোও নয়। তবে তারা রোগটির পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যাপারে সাহায্য করার কথা জানায়।

তাদের এই কথার অর্থ দাঁড়ায়- মুক্তামণির হাত কখনো ভালো হবে না। তাই সংবাদ মাধ্যমগুলো মুক্তামণির হাত কেটে ফেলা হতে পারে বলে সংবাদ প্রকাশ হয়। তবে হাল ছাড়েননি ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশক্রমে নিজেরাই এই রোগের অপারেশনের পদক্ষেপ নেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেরর চিকিৎসকরা। ২ আগস্ট বুধবার। ১৩ জন চিকিৎসককে নিয়ে একটি বৈঠক হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়- ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ৩ আগস্ট মুক্তামনির শরীর থেকে বায়োপসি নেওয়া হয়। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় মুক্তামনির রক্তনালিতে টিউমার হয়েছে তার রোগটি মোটেও বিরল নয়।

এরপর ১২ আগস্ট শনিবার সকালে শুরু হয় মুক্তামনির হাতের অপারেশন। মুক্তামনির ডান হাত থেকে প্রায় তিন কেজি ওজনের টিউমার অপসারণ করেন চিকিৎসকরা। তবে সব টিউমার এখনো অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। আরো ৫-৬টি অপারেশন লাগবে বলে ধারণা করছেন চিকিৎসকরা। তবে তার প্রথম অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে, এটাই ভীষণ স্বস্তিদায়ক খবর হয়ে এসেছে গণমাধ্যমে।

বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়েও এগিয়ে যাচ্ছে তার প্রমাণ মুক্তামণির বেলায় আবার নতুন করে পেলাম আমরা। তাই তো মুক্তামণির হাত কাটতে হয়নি। হাত না কেটেই সফলভাবে টিউমার অপসারণ করা সম্ভব হয়েছে।

তবে শুধু মুক্তামণি নয়। মুক্তামনির অপারেশন শুরু করার ঠিক ১২ দিন আগে অর্থাৎ ১ আগস্ট আরো একটি সফল অপারেশন করেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকরা। ‘পাইগোপেগাস’ নামের রোগে আক্রান্ত জোড়া লাগা যমজ শিশু তোফা ও তহুরাকে আলাদা করা হয়েছিল। সেই শিশুরা এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছে। তারাও এখন ভালো আছে, সুস্থ আছে।

তোফা-তহুরা যেভাবে জোড়া লাগানো ছিল, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘পাইগোপেগাস’। বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘পাইগোপেগাস’ শিশু আলাদা করার ঘটনা এটি প্রথম। শিশু দুটোর অস্ত্রোপচারে বিভিন্ন বিভাগের ১৬ জন সার্জন যুক্ত ছিলেন। নয় ঘণ্টার জটিল অস্ত্রোপচারে দুই শিশুর স্পাইনাল কর্ড, মেরুদ-, পায়ুপথ ও প্রস্রবের রাস্তা আলাদা করা হয়। জন্মের সময় দুজনের পায়খানার রাস্তা ছিল একটি। তবে মাথা ও পা ছিল আলাদা। এর আগে অন্যান্য হাসপাতালে তিন জোড়া শিশুকে অস্ত্রোপচার করে আলাদা করা হয়েছে, তাদের ধরন ছিল আলাদা।

এ ছাড়া বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে হাতে পায়ে গাছের মতো শেকড় গজিয়ে যাওয়া আবুল বাজানদারকে প্রায় সুস্থ করে তুলেছেন ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকরাই। এই ধরনের চিকিৎসা এর আগে কখনো বাংলাদেশে হয়নি, করা সম্ভব-এমন কথাও ভাবেনি কেউ। বৃক্ষমানব হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আবুল বাজনদার কখনো সুস্থ হতে পারবেন, তা ভাবতেও পারেননি নিজেই। তবে তিনি এখন সুস্থ প্রায় এবং একজন স্বাভাবিক মানুষের মতই জীবন যাপনের অপেক্ষায়।

বাজানদারের রোগটি ছিল বিরল ‘এপিডারমোডাইসপ্লাসিয়া ভেরাসিফরমিস’। ১০ কেজি ওজনের আঁচিল নিয়ে ২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন খুলনার পাইকগাছার এই তরুণ। দুই হাতে পাঁচ বার করে ১০টি আর দুই পায়ে দুইবার করে চারটি অস্ত্রোপচার করেন চিকিৎসকরা। অপারেশনের পর সুস্থ হয়েছেন আবুল বাজনদার। তিনি এখন ঢাকা মেডিকেলের বিছানায় বসে স্বপ্ন দেখছেন সুন্দর এক ভবিষ্যতের।

সম্প্রতি ক্যাথেটার দিয়ে একটি কনডম প্রসূতির জরায়ুর ভেতর ঢুকিয়ে তা বাতাস দিয়ে ফুলিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যায় তার আবিষ্কারকও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক। যা বর্তমানে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতেও ব্যবহার হচ্ছে।

সীমিত লোকবল ও স্বল্প সুযোগ সুবিধা নিয়েও এগিয়ে চলছে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা। পর্যান্ত পরিমাণ সুযোগ সুবিধা সরবরাহ করা সম্ভব হলে একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও উন্নত বিশ্বের চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে পাল্লা দিবে বাংলাদেশের চিকিৎসা  চিকিৎসা ব্যবস্থা ।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন।