বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

Looks like you've blocked notifications!

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া মাজদার হোসেন মামলার রায় পুনর্বিবেচনার কথা বলেছেন। এ রায়ে আপিল বিভাগ সংবিধানের আলোকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সরকারকে নির্দিষ্ট কিছু সুপারিশ করেছেন। আপিল বিভাগের সুপারিশ বা রায় বাস্তবায়নে সরকার এখনো কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অর্থমন্ত্রী কী কারণে রায় পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব করেছেন, তার বিশদ বিবরণ পত্রপত্রিকায় আসেনি। মাজদার হোসেন মামলা ছিল বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি আইনি উদ্যোগ, যা আগেই নেওয়ার কথা ছিল। এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছিল। এই সুপারিশগুলো বাংলাদেশ সরকার হয়তো পুরোপুরি কার্যকর করতে চায়নি। এ কারণেই পুনর্বিবেচনা বা রিভিউয়ের বিষয়টি উঠেছে। রিভিউ করতে পারে সরকার বা রাষ্ট্রপক্ষ। কেন এখনো রিভিউ করা হয়নি, এ প্রশ্নও করা যায়। তবে যে প্রশ্নগুলো সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে তোলা দরকার তা হলো, রাষ্ট্রপক্ষ পুনর্বিবেচনার আবেদন না করে এবং সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে আদালতকে সরকারের আজ্ঞাধীন সংস্থায় পরিণত করেছে কি না? এবং সরকার বা রাষ্ট্র নিজেই সচেতনভাবে নিজের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে কি না? এ প্রেক্ষাপটে সঠিক উত্তর পেতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সংবিধানের বিধিবিধান পর্যালোচনা করা আবশ্যক।

বাংলাদেশের আইনজীবীরা বহুদিন ধরে আইনের শাসন ও স্বাধীন নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চালিয়ে আসছেন, যা আজও অব্যাহত আছে। এ দাবির সঙ্গে যুক্ত ছিল রাজনৈতিক জোটগুলোর দাবি এবং ছাত্র-জনতার সম্মিলিত দাবি বাস্তবায়নের আন্দোলন। আন্দোলনের স্বাভাবিক গতিধারায় এর নেতৃত্বে ছিল কখনো আটদলীয়, কখনো সাতদলীয়, আবার কখনো পাঁচদলীয় জোটসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতার কারণে ওই সব আন্দোলনে জনগণের বিজয় অর্জিত হয়নি। বিদ্যমান সমরতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারী ব্যবস্থার বদলে জনগণের গণতান্ত্রিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই অর্জিত হতে পারে সে বিজয়। আইনজীবীদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের মর্যাদা ও নিরাপত্তার জন্য এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও সমাজে ন্যায়বিচার নিশ্চিতের জন্য আইনের শাসন ও স্বাধীন নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা অপরিহার্য। আর তা হতে পারে কেবল একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক দেশ গঠনের মধ্য দিয়ে। এর নেই কোনো বিকল্প, নেই কোনো তুলনা।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব হঠাৎ করে হয় না। সমাজ-সভ্যতার বিকাশে বিভিন্ন সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থা এবং উৎপাদন সম্পর্কের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব। আদিম উৎপাদনব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্ক যখন একটি সামন্ত উৎপাদনব্যবস্থা ও সম্পর্কে বিকশিত হলো, তখন সামন্ত রাষ্ট্রের উদ্ভব হলো। উৎপাদন সম্পর্ক যখন পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থা ও সম্পর্কে বিকশিত হলো, তখন দেখা দিল আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা। সমাজের এই ক্রমবিকাশের নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। একটা সমাজে আইনের শাসন ও স্বাধীন নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা তখনই সম্ভব, যখন ওই সমাজে থাকে একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা।

স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এবং ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সে আধুনিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার অঙ্গীকার ছিল জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা। আর তা সম্পন্ন করা হয়েছে সংবিধানে আইনের শাসন ও স্বাধীন-নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা নিশ্চিতের মাধ্যমে। বাংলাদেশ একটি পশ্চাৎপদ-পরনির্ভরশীল উৎপাদনব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্কের দেশ। এটা একটা সামন্ত রাষ্ট্রও নয়, আবার পুঁজিবাদী রাষ্ট্রও নয়। ফলে এর সংবিধানে আইনের শাসন ও স্বাধীন-নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য শর্তের অনুপস্থিতি প্রকটভাবে দৃশ্যমান। বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা যেহেতু গণতান্ত্রিক নয়, তাই এর সংবিধানে গণতান্ত্রিক নীতিমালার পূর্ণ স্বীকৃতি নেই, থাকতে পারে না।

এ দেশের অনেকে বলেন, ১৯৭২ সালের সংবিধান গণতান্ত্রিক সংবিধান। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক সংবিধানের পর্যালোচনা করলেই এর অসারতা প্রমাণিত হবে। একটা গণতান্ত্রিক সংবিধানের আবশ্যকীয় ও অপরিহার্য বিষয় হচ্ছে সেই সংবিধানে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোর শুধু সাধারণ স্বীকৃতি থাকা নয়; বরং অধিকারগুলোর নিশ্চয়তার বিধানাবলি। বাংলাদেশের সংবিধানে আইনের শাসন ও স্বাধীন-নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা নিশ্চিতের বিধানাবলির অস্তিত্ব আছে কি না, তা পর্যালোচনার আগে আইনের শাসন ও স্বাধীন-নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে একটা সাধারণ আলোচনা অনিবার্য।

আইনের শাসন ও স্বাধীন-নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা-সংক্রান্ত ধারণার বিকাশ ঘটে গণতান্ত্রিক চেতনা ও আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণার বিকাশের মধ্য দিয়েই। ইউরোপের আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর বিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ সত্য অনুধাবন করা যায়। বিশেষ করে গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্স এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ফ্রান্সের ঐতিহাসিক ফরাসি বিপ্লব ও ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব এই চেতনার বিকাশকে করেছে দ্রুততর। ফলে এ দুটি দেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও আইন-বিশারদরা গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের বা পৃথকীকরণের নীতির পক্ষে অভিমত পোষণ করে এর পক্ষে জনমত গঠনের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।

ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মন্টেস্কু রাষ্ট্রক্ষমতা পৃথকীকরণের নীতির প্রবক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর মতে, রাষ্ট্রের মতো বিরাট জনসমষ্টিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও সমাজকল্যাণ সাধন করতে হলে রাষ্ট্রকে তিনটি প্রাথমিক কাজ করতে হবে। প্রথমত, সুস্পষ্ট আইনের মধ্য দিয়ে জনসাধারণের অধিকার ও কর্তব্য নির্দেশ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যে বিধিনিষেধ আইন দ্বারা সৃষ্ট হয়, তা সর্বক্ষেত্রে নিরপেক্ষভাবে কার্যে পরিণত করতে হবে। তৃতীয়ত, পক্ষপাতশূন্যভাবে রাষ্ট্রকে বিচারব্যবস্থার দায়িত্ব নিতে হবে। এই তিনটি প্রাথমিক ও মৌলিক কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন না হলে রাষ্ট্র কোনোক্রমেই নাগরিকের জীবন-ধন-মান রক্ষণাবেক্ষণ ও সামাজিক কল্যাণ সাধন করতে পারে না।

এই তিনটি কর্তব্য সম্পাদনের জন্য রাষ্ট্রকে তিন প্রকার ক্ষমতা ব্যবহার করতে হয়। প্রথমত, আইন প্রণয়ন ক্ষমতা; দ্বিতীয়ত, আইন পরিচালনা (কার্যে পরিণত করণ) ক্ষমতা এবং তৃতীয়ত, বিচার ক্ষমতা। আবার ক্ষমতা ব্যবহারের জন্য আধুনিক রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ অবশ্যম্ভাবী—আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। অ্যারিস্টটলসহ অন্যান্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এই তিন বিভাগের অস্তিত্বকে আধুনিক রাষ্ট্রে অপরিহার্য বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

ফরাসি সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মন্টেস্কু ক্ষমতা পৃথকীকরণের নীতি বৈজ্ঞানিকভাবে গঠন করেন। তিনি তাঁর সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘আইনের মর্ম’ বা ‍Spirit of the Laws-এ এই নীতি ব্যাখ্যা করেন। ক্ষমতা পৃথকীকরণের নীতির মধ্যেই স্বাধীন-নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার ধারণা নিহিত আছে। মন্টেস্কু এই তিনটি বিভাগকে পৃথক রাখা আবশ্যক বলে মত পোষণ করেন। আর পৃথকীকরণের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি বা সমষ্টিকে বিভাগীয় ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। একটি বিভাগের ক্ষমতাধিকারীদের অন্য বিভাগের ক্ষমতা দেওয়া চলবে না। এর উদ্দেশ্য হলো, এক বিভাগ কর্তৃক আরেক বিভাগকে প্রভাবিত করার পথ বন্ধ করা। যদি এক ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের হাতে একাধিক ক্ষমতা থাকে, তবে স্বাধীন-সার্বভৌম সত্তা হিসেবে ব্যক্তির অস্তিত্ব ও স্বাধীনতা বিপন্ন হবে, জনসাধারণের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে। যদি শাসন বিভাগকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা হয়, তবে তারা নিজেদের স্বার্থে স্বৈরাচারী আইন প্রণয়ন করবে। ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে এবং বিচার পরিণত হবে প্রহসনে, যদি শাসন বিভাগকে বিচার ক্ষমতা দেওয়া হয়। শাসক সম্প্রদায় শাসনের সুবিধার জন্য ন্যায়বিচারের অমর্যাদা করতে পিছপা হবে না। তেমনি আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা স্বতন্ত্র না রাখলে স্বৈরাচারের জন্য ব্যক্তি স্বাধীনতা বিনাশের পথ উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এ নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনুসরণ করে আসছে।

এ ধরনের নীতি সমর্থন করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট মিল, অধ্যাপক লাস্কি, জন বর্ডিন রুশো, জন লক, ইংরেজ ব্যবহার শাস্ত্রবিদ ব্ল্যাকস্টোন প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। এই নীতির ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্বাধীন-নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা। আইন প্রয়োগ করে দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তিমূলক রায় দান হলো বিচার বিভাগের মূল কাজ। এই বিচার সুনিশ্চিত, দ্রুত ও নিরপেক্ষ হওয়া প্রয়োজন। সে জন্য রাষ্ট্রব্যাপী একই আইন, একই বিচার পদ্ধতি হওয়া প্রয়োজন। বিনা বিচারে শাস্তি হতে পারবে না, শাস্তির উদ্দেশ্য হবে সমাজের নিরাপত্তা-প্রতিরোধ নহে। এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখা প্রয়োজন। বিচার বিভাগের কার্যাবলি হলো : ১. বিচার কার্য, ২. আইন প্রণয়ন ও তা ব্যাখ্যার দায়িত্ব, ৩. উপদেশ দান, ৪. নিরোধপূর্বক নির্দেশদান, ৫. শাসনতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষা করা, ৬. শাসন বিভাগীয় অন্যান্য কাজ।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নির্ভর করে কতগুলো বিশেষ ব্যবস্থার ওপরে। বিচারকার্যের নিয়োগ পদ্ধতি, কার্যকাল নির্ধারণ বা অপসারণ, অবসর গ্রহণ, বেতন-ভাতা নির্ধারণ প্রভৃতি বিষয়ই এমনভাবে স্থিরকৃত হতে হবে, যাতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব না হয়। এ ছাড়া শাসকমণ্ডলী কর্তৃক নিয়োগ, সুব্যবহারকালীন স্থায়ী চাকরি, আইনসভার বিশেষ আবেদন ক্ষমতা বা অপরাধের জন্য অপসারণ, বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের যথাযথ বেতন-ভাতা প্রদানের মতো আরো বেশ কিছু বিষয় নিশ্চিতের প্রয়োজন আছে। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রীয় আইন, জনসাধারণের অধিকার এবং স্বাধীনতার তত্ত্বাবধায়ক ও রক্ষাকর্তা। সংঘাতময় সমাজে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির-সংগঠনের বা শাসনব্যবস্থার এবং অনুরূপভাবে সংগঠনের সঙ্গে সংগঠনের ও শাসনব্যবস্থার দ্বন্দ্ব অনিবার্য। সে অবস্থায় রাষ্ট্রের যে ইচ্ছা আইনের মধ্যে রূপ পেয়েছে, সে নিরিখে প্রত্যেক ব্যক্তির অধিকার ও অপরাধ স্থির করার এবং অপরাধের উপযুক্ত দণ্ড নির্ধারণের ভার আরোপিত হয় বিচার বিভাগের । বিচার হতে হবে সন্তোষজনক ও আস্থা অর্জনকারী। এবং তা হতে হবে নিশ্চিত, দ্রুত ও নিরপেক্ষ। নিশ্চিতের গুরুত্ব দেওয়া হয় এই কারণে যে, বিচার যদি ব্যক্তিবিশেষের মর্জির ওপর নির্ভর করে; যদি নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট আইন ধরে না চলে, যদি অভিযোগকারীভেদে রায়ের পার্থক্য হয়, তাহলে সেই বিচারের ন্যায্যতার ওপরে কেউই নির্ভর করতে পারে না; কারো অধিকার নিরাপদ থাকে না। বিচার দ্রুত হওয়া প্রয়োজন এই জন্য যে, অন্যায় ঘটবার দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে ন্যায়বিচারও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনোরূপ ক্ষতিপূরণ করতে সমর্থ হয় না।

বিচারে ন্যায্যতার অপর নামই নিরপেক্ষতা। পক্ষপাতদুষ্ট বিচার, কার্যত প্রহসন মাত্র। ব্যক্তি ও সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্বে, সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর কলহে, শক্তিশালী ও দুর্বলের সংঘাতে, সম্পদশালী ও সম্পদহীনের লড়াইয়ে বিচারককে নির্ভীক, নির্লোভ ও নিস্পৃহ হয়ে আইনের ব্যাখ্যা করতে হয়, অধিকারকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হয় এবং অপরাধীর দণ্ড বিধান করতে হয়। বিচারকের উৎকোচ গ্রহণ কিংবা তাঁকে উৎকোচ সাধা দণ্ডনীয় অপরাধ। একইভাবে বিচারককে ভয় দেখানো বা চাপ প্রয়োগ করাও অপরাধ। শাসকরা যদি কারো শাস্তি বা মুক্তির জন্য বিচারককে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে, তবে সেটিও অপরাধ। বিচার চলা উচিত নিতান্তই আইন অনুযায়ী। কোনো রাষ্ট্রনায়ক বা ক্ষমতাশালী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের সন্তুষ্টি বিধান তার গ্রাহ্য বিষয় নহে। এসব শর্ত হলো স্বাধীন-নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার মূল কথা।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপরে নির্ভর করে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা। আর বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নির্ভর করে—১. বিচারক নিয়োগ পদ্ধতি, ২. কার্যকাল নির্ধারণ, ৩. বিচারকগণের অপসারণ, ৪. বেতন ও ভাতা পদ্ধতিসমূহের প্রকৃতির ওপর। একজন বিচারককে বিজ্ঞ, নিরপেক্ষ, মর্যাদাবোধসম্পন্ন ও স্বাধীনতা মতাবলম্বী হওয়া প্রয়োজন। বর্তমান বিশ্বে বিচারক নিয়োগের পদ্ধতি তিনটি : ১. শাসক কর্তৃক, ২. আইনসভা কর্তৃক ও ৩. জনসাধারণের দ্বারা। অক্ষমতা ও গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে বিচারকরা অপসারণযোগ্য হওয়া উচিত; অন্য কারণে নয়। আর সে অপসারণ অবশ্যই আইনসভা বা জনগণের দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে। বেতন-ভাতা প্রয়োজন মেটানোর মতো পর্যাপ্ত ও সম্মানজনক হওয়া আবশ্যক। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইনসভা কর্তৃক বিচারকের নিয়োগ ও অপসারণ অনুমোদনের ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়ে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ভারত প্রভৃতি গণতান্ত্রিক দেশে এই নীতি অনুসরণ করা হয়। উপরিউক্ত আলোচনার আলোকে বাংলাদেশের সংবিধানের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার অন্যতম শর্ত হিসেবে বিচারকের নিয়োগ, আদালতের কার্যাবলি ও ক্ষমতা সম্পর্কিত বিধানগুলোর পর্যালোচনা করা যেতে পারে।

১৯৭২ সালের সংবিধানে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোর একটা সাধারণ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এগুলোকে অলঙ্ঘনীয় হিসেবে কার্যকর করার বিধান যেমন আছে, তেমনি সেগুলোকে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ নির্বাহী কর্মকর্তার অধীন রাখার বিধানও রয়েছে। বিধানগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থানের ফলে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন হলে তার প্রতিকারের কার্যকর ব্যবস্থা বাস্তবে নেই। গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সাংবিধানিক দায়িত্ব বিচার বিভাগের ওপরে ন্যস্ত থাকলেও বিভাগটির ক্ষমতাকে সীমিত করে রাখা হয়েছে বিভিন্ন বিধিনিষেধের বেড়াজালে। এর সত্যতা পাওয়া যাবে বাংলাদেশের সংবিধানে বিচারকদের নিয়োগ সম্পর্কিত বিধান ও অন্যান্য সংবিধির বিশ্লেষণ থেকে।

বাংলাদেশের সংবিধানের (১৯৭২ সালের) ৯৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়োগ পদ্ধতি বিধান রয়েছে। এই বিধান হলো : অনুচ্ছেদ-৯৫(১) বিচারক নিয়োগ : প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগ করিবেন। অনুচ্ছেদ ৯৫(২)-এ বিচারপতি পদের নিয়োগদানের যোগ্যতা ও মাপকাঠির বিধান রয়েছে। তা ছাড়া সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি অধস্তন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান ও ছুটি মঞ্জুরি নিরূপণের বিধান রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন বিচার বিভাগ এক রাষ্ট্রপতির তথা রাষ্ট্রে নির্বাহী বিভাগের এই নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার কারণে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ রয়েছে। ফলে বিচার বিভাগ কার্যকরভাবে সরকারি প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতা অপব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।

এই ক্ষমতার ওপরে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স [অপব্যবহার রোধের ব্যবস্থা] না থাকার কারণে সুপ্রিম কোর্টকে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো ২৬, ২৭, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৪০, ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৫, ৪৬, ৪৭ অনুচ্ছেদে লিপিবদ্ধ আছে। সংবিধানের ২৬(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘এই বিভাগের বিধানাবলীর সহিত অসামঞ্জস্য সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ এই সংবিধান প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে; ২। রাষ্ট্র এই ভাগের কোনো বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোনো আইন প্রণয়ন করিবেন না এবং অনুরূপ কোনো আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোনো বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।’ এখানে এই বিধান কার্যকর করার কোনো পদ্ধতি সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হয়নি, ফলে ১৯৭৩ সালের সংবিধানের সংশোধনীয় মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা প্রদানের মাধ্যমে এবং পরবর্তী সময়ে জরুরি ক্ষমতা আইন জারির মাধ্যমে সংবিধানে প্রদত্ত জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো অকার্যকর করা হয়েছে। এবং আদালতের ক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে।

সংবিধানের নবম (ক) ভাগে এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান সন্নিবেশিত করা হয়েছে ১৪১ক থেকে ১৪১গ ধারা। এই ধারাগুলোয় জরুরি বিধানাবলি গ্রহণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা এবং এই ক্ষমতা প্রয়োগের ফলে রাষ্ট্রীয় জীবনের ফলাফল ও প্রতিক্রিয়ার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এই বিধানগুলোর প্রয়োগের ফলে সংবিধানের ৩৬, ৩৭, ৩৯, ৪০, ৪২ অনুচ্ছেদের বিধানগুলো অকার্যকর হয়ে যায়। এবং জরুরি অবস্থাকালে সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদের বিধানও অকার্যকর থাকবে। ফলে রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্রপতির তাঁর ওপরে অর্পিত ক্ষমতাবলে যেকোনো ধরনের আইন অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রণয়ন করতে পারবেন। এবং যেকোনো নির্বাহী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন এবং এ সকল আইনও নির্বাহী ব্যবস্থা সংবিধানসম্মত বলে বিবেচিত হবে এবং তা কোনো আদালতের প্রশ্নাধীন করা চলবে না।

১৯৭৩ সালের সংবিধানের এই সংশোধনী কার্যত জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করেছে এবং জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণে আদালতের ক্ষমতা ও অধিকারকে ক্ষুণ্ন করেছে। সংবিধানের ১০১, ১০২(১), ১০৩ অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় হাইকোর্টের এখতিয়ার। ১০২(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদন ক্রমে এই সংবিধানের তৃতীয় ভাগের দ্বারা অর্পিত অধিকারসমূহের যেকোনো একটি বলবৎ করার জন্য প্রজাতন্ত্রের বিষয়াবলীর সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিসহ যেকোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে হাইকোর্ট বিভাগ উপযুক্ত নির্দেশাবলী বা আদেশ দান করিতে পারিবেন।’

সংবিধানের তৃতীয় ভাগে অর্পিত অধিকারগুলো হলো জনগণের মৌলিক অধিকার বা গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো, যা সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ নম্বর অনুচ্ছেদ পর্যন্ত বর্ণিত আছে। এসব মৌলিক অধিকারে স্বাধীন-সার্বভৌম সত্তা হিসেবে ব্যক্তির গণতান্ত্রিক অধিকারের পূর্ণ স্বীকৃতি নেই। তবুও যতটুকু স্বীকৃতি ছিল, তাও পরে খণ্ডিত হয়। সংবিধানের জরুরি অবস্থা ঘোষণা-সংক্রান্ত ১৪১ (ক) থেকে ১৪১ (গ) পর্যন্ত বিধানাবলি ও বিশেষ ক্ষমতা আইন, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম সংশোধনী ইত্যাদির মাধ্যমে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে কার্যত জনগণ হয়ে পড়েছে অধিকারহীন। সংবিধানের ১০২(১), (২)(ক)(আ), (৪)(অ)(আ) নম্বর অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগকে প্রদত্ত এখতিয়ারকে অকার্যকর করার মাধ্যমে বা সীমিত করে ফেলা হয়েছে। ফলে সময়ে সময়ে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়। বিশেষ করে জরুরি ঘোষণা বা অসাংবিধানিক পন্থায় সামরিক আইন জারির মতো ঘটনায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের অসহায়ত্ব প্রকট হয়ে ওঠে, যা আইনের শাসন ও স্বাধীন-নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পরিপন্থী।

এর পর ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো অস্বীকার করে স্বৈরাচারের পথকে প্রশস্ত করেছে। তা ছাড়া সংবিধানের চতুর্থ ভাগের ৫৩(১), ৫৮(৪), পঞ্চম ভাগের ৬৫(৩), পঞ্চম ভাগের ৫৬(৩৪)(ছ), ৬৭(ঝ), তৃতীয় ভাগের ৯৩ অনুচ্ছেদ, ৭০ অনুচ্ছেদ ৭০(২)/(৩), ১১৮/১১৯ অনুচ্ছেদের বিষয়গুলো অগণতান্ত্রিক। একই সঙ্গে সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন ঘটানোর অধিকার দিয়ে দলীয় স্বেচ্ছাচারিতা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়েছে। অতঃপর পঞ্চম সংশোধনী, ষষ্ঠ সংশোধনী, সপ্তম সংশোধনী, অষ্টম সংশোধনী মূলত জনগণের স্বাধীন-সার্বভৌম সত্তাকে পদদলিত করে সমরতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বিদ্যমান সংবিধানের বিধিবিধান দিয়ে বাংলাদেশে আইনের শাসন ও স্বাধীন-নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

লেখক : অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম : সভাপতি, গণতান্ত্রিক সংবিধান সংগ্রাম কমিটি এবং সদস্য, কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটি, গণসংহতি আন্দোলন।