অভিমত

রোহিঙ্গাদের প্রতি বাঙালির জাতীয় কর্তব্য

Looks like you've blocked notifications!

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বাধিকার অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায় হলো, বিশ্ববাসীর কাছে তাদের নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাগত আত্মপরিচয় তুলে ধরতে না পারা। এই দুর্ভাগ্য আরো দীর্ঘায়িত হচ্ছে কারণ- বাংলাদেশ, পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরার মানুষও এই জনগোষ্ঠীকে তাদের নৃতাত্ত্বিক ও ভাষিক সহোদর বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। বরং পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা নিপীড়িত এবং বৃহত্তর স্টেটলেস এই জনগোষ্ঠীর একমাত্র পরিচয় হয়ে উঠেছে ‘মুসলমান’। এ কারণে একদিকে তারা বাংলাদেশ ও ভারতের বাঙালিদের কাছ থেকে জাতিগত ঐক্যের সহায়তা থেকে বঞ্চিত, অন্যদিকে সারা দুনিয়ার অমুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছ থেকেও প্রাপ্য সমর্থন আদায় করতে পারছে না। আরো অবিচার এই যে, দুনিয়ার চোখের সামনে ক্রমাগত জাতিগত নিপীড়নের শিকার হতে থাকা রোহিঙ্গার জাতিগত, ভাষাগত পরিচয় শনাক্তের কোনো চেষ্টা কোথাও লক্ষ‍ করা যাচ্ছে না।

আমরা জানি, নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিকভাবে আরাকানের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। বাংলার সঙ্গে আরাকানের নৈকট্যের সম্পর্ক ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক এবং বিশেষত্বমণ্ডিত। বাংলাদেশ, পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরার বাঙালিরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে আজকে যে গর্ব অনুভব করছে, তারা ভেবে দেখছে না, বাংলা সাহিত্যের প্রথম কেন্দ্র ছিল আরাকান। যাকে আমরা রোসাঙ্গ বলি- তা ছিল আরাকান, রোহিঙ্গাদের সাধনার বাংলা সাহিত্যের প্রথম রাজধানী। চতুর্দশ থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়ানো কবি শাহ মুহম্মদ সগীর, দৌলত উজির বাহরাম খাঁ, আলাওল, দৌলত কাজী, কোরেশী মাগন ঠাকুরদের উত্তরপুরুষই হলো আজকের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। মধ্যযুগের বাঙালি কবিদের শিরোমণি বলা হয় আলাওলকে আর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আদি নিদর্শন হলো শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা (১৩৮৯-১৪১১)। এ দুই কবিই আরাকানের অধিবাসী। ইতিহাসের উপাত্ত এ সাক্ষ্যই দেয়, বাংলা সাহিত্যকে প্রথম পরিপূর্ণ হতে দেখা গেছে রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষদের কলমে, রোসাঙ্গের রাজসভায়। দীনেশচন্দ্র সেন, ড. এনামুল হক, ড. আহমদ শরীফ প্রমুখ মধ্যযুগবিষয়ক পণ্ডিত আরাকানের বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠা এবং সেখানে বিপুল বাংলাভাষী মানুষের বসবাসের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু রোহিঙ্গা ও বাঙালি যে একই মায়ের গর্ভজাত- সেই কথাটি আমরা আজ স্বীকার করে নিতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে বাঙালির মতো আত্মবিস্মৃত ও সম্পর্ক অস্বীকারকারী জনগোষ্ঠী পৃথিবীতে বিরল।

আরাকান ও বাংলার রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিল যে ক্ষমতার রদবদল বা ওঠানামায় দুই দেশ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ১৪৩০ সালের দিকে আরাকানি রাজা নরমিখলা বাংলার সুলতান জালালুদ্দিন শাহের সহায়তায় রাজক্ষমতা পুনর্দখল করেন। ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত আরাকান ছিল স্বাধীন, এরপর চলে যায় বার্মার দখলে। স্বাধীন আরাকান রাজদরবারে স্থান করে নিয়েছিল ফারসি, আরবি ও বাংলা ভাষা। আরাকানি মুদ্রায় বর্মি ভাষার পাশাপাশি ছিল ফারসি ভাষায় কালেমা। আরাকান রাজারা বৌদ্ধধর্মের হলেও সিংহাসনে অভিষিক্ত হতেন মুসলমানি নাম গ্রহণ করে। রাজদরবারের সাহিত্যের প্রধান ভাষা ছিল বাংলা, যাকে আরাকানি বাংলাও বলা হয়। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পরেও চট্টগ্রাম ও রোহিঙ্গাদের মাতৃভাষায় এখনো সেই ঐক্য রয়েছে। আরাকান অঞ্চল ও চট্টগ্রামের মানুষের ভাষাকে স্থানীয়ভাবে এখনো অনেকে ‘আরাকানি বাংলা’ নামে অভিহিত করেন। আরাকান বার্মার অধিকারে যাওয়ার পরেও রাজদরবারের উচ্চপদে বাঙালি নিয়োগ বন্ধ হয়নি। ১৮২৬ সালে আরাকান ব্রিটিশ অধিকারভুক্ত হলে ইংরেজরা বহু বাঙালিকে নিয়ে যান বার্মা পুনর্গঠনের জন্য। আরাকানের পতিত ভূমি কর্ষণের জন্য দক্ষিণ আরাকান বা চট্টগ্রাম থেকে বহু মানুষকে সেখানে পুনর্বাসন করা হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলটি মূলত আরাকানের অংশ। বাংলায় মুসলমান শাসনের আগে থেকেই অবিভক্ত আরাকানে মুসলমান বণিকের আগমন ঘটে। ইংরেজ শাসনের আগে চট্টগ্রাম কখনো আরাকানের থেকেছে, কখনো অংশ হয়েছে বাংলার। ১৬৬৬ সালের পর থেকে চট্টগ্রাম স্থায়ীভাবে বাংলার অংশে পরিণত হয়। 

ইংরেজ শাসনের শেষ দিকে বাংলার হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের মতো, পাঞ্জাব আর কাশ্মীরের মতো আরাকানেও রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে রাজনৈতিক সংকট ঘণীভূত হয়। ভারত ভাগের প্রাক্কালে রোহিঙ্গারা আরাকানকে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করে, এই অভিলাষ মূলত বাংলার অংশ হওয়ার জন্য। ভারত ও বার্মা আলাদা কলোনি হলেও রোহিঙ্গারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে বঙ্গভূমির অংশ হতে। রোহিঙ্গা নেতারা জিন্নাহর শরণাপন্নও হয়েছিলেন। তবে জিন্নাহর উদাসীনতার কারণে শেষ পর্যন্ত তাঁরা ব্যর্থ হন। ঐতিহাসিক এই সংকটের শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোড়ার দিকে যখন, ১৯৪২ সালে জাপানিরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে বার্মা দখল করে। এই যুদ্ধে রাখাইন জাতীয়তাবাদীরা ছিলেন জাপানের পক্ষে। অন্যদিকে ব্রিটিশপন্থী ছিল রোহিঙ্গারা। এর জের ধরে রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ দাঙ্গাও হয়েছিল। এ সময় ৬২ হাজার রোহিঙ্গা স্থায়ীভাবে চলে আসেন চট্টগ্রামে। ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশরা বার্মা পুনর্দখল করে, এই যুদ্ধে মিত্রবাহিনীকে সহায়তা করে রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের আলাদা ভূখণ্ডের দাবি মানার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ব্রিটিশরা, কিন্তু যুদ্ধ শেষে তারা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। ইতোমধ্যে ভারত বিভক্তি ঘনিয়ে এলে রোহিঙ্গারা আরাকান মুসলিম লীগ গঠন করে পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার আওয়াজ তোলে। যা বার্মার প্রতি রোহিঙ্গাদের চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে চিত্রিত হয়। এরপর ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয়ে গেলে রোহিঙ্গারা স্বাধীন আরাকানের জন্য লড়াইয়ের ঘোষণা দিলেও শেষপর্যন্ত তারা ব্যর্থ হয়।

ভারত ও বার্মার স্বাধীনতার পর আধুনিক সীমান্তের দেয়াল তৈরি হয় চট্টগ্রাম ও আরাকানের মধ্যে। চট্টগ্রাম থেকে আরাকানের এই বিচ্ছিন্নতাকে আমরা রোহিঙ্গাদের প্রেক্ষাপটে একধরনের দেশভাগ বলতে পারি। একই জনগোষ্ঠী, একই মাতৃভাষা হলেও চট্টগ্রাম থেকে ঐতিহাসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা জনগোষ্ঠীতে পরিচিত হতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। বললে অত্যুক্তি হবে না, বাংলার অংশ হওয়ার ইচ্ছার কারণে রোহিঙ্গাদের আজ এই ভাগ্যাহত জীবন বরণ করে নিতে হয়েছে। উপরন্তু  আপনজনের কাছেও তারা আজ বিস্মৃত।

২.

মিয়ানমারের নাগরিকত্ব বঞ্চিত রোহিঙ্গারা পৃথিবীর বৃহত্তম স্টেটলেস জনগোষ্ঠী। আরাকান রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ রোহিঙ্গা, এদের প্রায় সবাই মুসলমান হলেও হিন্দুও রয়েছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে। আরাকানের বাকি দুই-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর প্রায় সবাই রাখাইন। এই রাখাইনরা আরাকানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও পুরো মিয়ানমারে তারা একটি সংখ্যালঘু নৃ-গোষ্ঠী। মিয়ানমারে সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মি জাতিগোষ্ঠী যেখানে ৬৮ ভাগ, রাখাইন সেখানে আছে ৪ শতাংশ। তবে আরাকানে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে জাতিগত সংঘাতে রাখাইনরা সমর্থন পাচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। প্রায় প্রতিবছর কোনো না কোনো অজুহাত সামনে এনে তাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের নৃশংস নির্যাতন নেমে আসে। আর তাড়া খেয়ে তারা নাফ নদীর তীরে জড়ো হয়, জীবন তুচ্ছ করে শরণার্থী হয় বাংলাদেশে।  সাম্প্রতিক সময়ে এই পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিলেও ব্যাপারটি ঘটে চলেছে পাকিস্তান পর্বের শুরু থেকে। অথচ রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার দেখা যাচ্ছে না বিশ্বকে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও কেবল দায়সারা বিবৃতি দেয়। আর বিভিন্ন দেশের মুসলিম জনগণ এই নিপীড়নকে দেখছে মুসলমানদের ওপর বৌদ্ধদের নির্যাতন আকারে। রোহিঙ্গাদের একমাত্র সীমান্ত লাগোয়া দেশ ও বড় ভরসাস্থল বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানও সংকটটিকে এভাবেই দেখছে। এই ধর্মীয়করণের ঘেরাটোপে রোহিঙ্গারা আবদ্ধ থাকায় সামগ্রিকভাবে সব বাঙালির কাছে পৌঁছাচ্ছে না তাদের আর্তি। একটি ভাষিক ও নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীকে কেবল ধর্মের মাধ্যমে চিত্রিত করার ফলে বাঙালির নিজস্ব মুক্তিচেতনার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার সম্পর্ক এখনো গড়ে তোলা যায়নি। এই চিত্রায়ন পরিবর্তিত বিশ্বপ্রেক্ষাপটেও সঠিক কৌশল হিসেবে দাঁড়াতে পারে না।

যাঁরা রোহিঙ্গা নিপীড়নকে কেবল মুসলমান নিপীড়ন হিসেবে গণ্য করেন তাঁরা আসলে তাদের জাতিগত সশস্ত্র লড়াইকে ‘জিহাদ’ হিসেবে প্রতিপন্ন করছে, যা প্রকারান্তরে মিয়ানমার সরকারকেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুবিধা করে দিচ্ছে। সারা বিশ্বের জাতিগত মুক্তির লড়াইয়ের ইতিহাস থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের সংগ্রাম। এর ফলে বিশ্বসহ বাংলাদেশের অমুসলিম ও সেক্যুলার গোষ্ঠীও রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর দায় অনুভব করছে না। রোহিঙ্গা সংকট স্পষ্টভাবে একটি জাতিগত নিপীড়ন। এই সংকটকে ধর্মগত মনে করার মধ্যে রয়েছে নানা বিপদ।

ছয় কোটি জনসংখ্যার দেশ মিয়ানমারে মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ। সাড়ে চার কোটি বর্মি বৌদ্ধের পরেই তৃতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হলো মুসলমান। এর মধ্যে কেবল রাখাইন রাজ্যেই রোহিঙ্গাদের বসবাস, যাদের সংখ্যা সব মিলিয়ে ১০ লাখ। বাকি ১৫ লাখ মুসলমান বাস করেন বিভিন্ন রাজ্যে, তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ও রোহিঙ্গাদের থেকে আলাদা। রোহিঙ্গা ছাড়া অন্য মুসলিম জনগোষ্ঠী মিয়ামনমারের নাগরিকত্বসহ সব ধরনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ভোগ করছে। রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর দাবিদাওয়ার যে বয়ান আমরা পাই সেখানে সমগ্র মিয়ানমারের মুসলমান জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার কথা নয়, বরং আছে রাখাইনে শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন বন্ধের দাবি। বিপরীতে দশকের পর দশক ধরে চলা রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিষয়েও বাকি ১৫ কোটি বর্মি মুসলমানের উদ্বেগের খবর আমরা পাই না। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ইতিহাস এবং তাদের সঙ্গে অন্যান্য রাজ্যের মুসলমানদের সম্পর্ক বিবেচনায় নিলেও রোহিঙ্গাদের  সমস্যাটি নৃ-ভাষিক সংকট হিসেবে বোঝা যায়। যে কারণে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে জাতীয়তাবাদী লড়াইয়ের মাধ্যমেই। কালে কালে দখলদাররা যেভাবে দুর্বল জাতিকে উৎপীড়ন করেছে, রাখাইনরা ঠিক একই আচরণ করছে রোহিঙ্গাদের ওপর। যেমন বাঙালিরা পাহাড়িদের পীড়ন করে, এ কারণে নয় যে পাহাড়িরা বৌদ্ধ। যেভাবে পশ্চিম পাকিস্তান একদা পূর্ববাংলার ওপর উৎপীড়ক হয়েছিল।

রোহিঙ্গা সমস্যাকে ধর্মীয় সমস্যা আকারে বুঝতে গেলে এর বিপদ বাড়ে। তাতে অমুসলিম বাঙালির পক্ষে এই সমস্যাকে স্বজাতির বিপদ হিসেবে দেখা সম্ভব হয় না। মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে একসময় বিশ্বজনমত দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু এখন তা কেবল মুসলমান লড়াইয়ে পরিণত। আজ থেকে ৩২ বছর আগে কলকাতার লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন- ‘আমি আরব গেরিলাদের সমর্থন করি।‘ ২০০৩ সালেও আমেরিকার ইরাক আক্রমণের বিরুদ্ধে কলকাতার রাস্তায় প্রতিবাদ মিছিল দেখা গেছে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮ হাজার তরুণ ফিলিস্তিন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ‌এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে গঠিত হয় এই যোদ্ধা দল (ইউএস লাইব্রেরি অব কংগ্রেস এবং প্যালেস্টাইন প্রত্যাগত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলুর সাক্ষ্য)। কর্নেল তাহেরের ভাই ও আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি ওয়ারেসাত হোসেন বেলালও ছিলেন এদের একজন। অথচ এখন ফিলিস্তিনের জন্য এ উদ্যোগ ভাবা যায় না। এর কারণ মধ্যপ্রাচ্যের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর লড়াইকে কেবল ইসলামের লড়াই হিসেবে পরিচিত করা হয়েছে। ফলে রোহিঙ্গা নিপীড়নকে যদি মুসলমানের সমস্যা হিসেবে দেখা হয়, তাতে কেবল সংকটই বাড়বে। এতে কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্রের অনুদান এবং কিছু মানুষকে পুনর্বাসন ছাড়া রোহিঙ্গাদের আর কোনো উপকারের আশা নেই। বর্তমান শোচনীয় পরিস্থিতিতে পার্শ্ববর্তী বাঙালি মুসলমানের কাছে আশ্রয় পাওয়ার সম্ভাবনা থেকে রোহিঙ্গারা হয়তো মুসলমান পরিচয়কে তুলে ধরতে চাইবে। কিন্তু এই পরিচয়কে উৎসাহিত না করে তাদের জাতিগত পরিচয়কেই সামনে আনতে হবে। এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন রোহিঙ্গাদের আরাকানি বাংলাভাষীর স্বীকৃতি। আমাদের দায়িত্ব রোহিঙ্গাদের সমস্যাটিকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠা করা। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে সহায়তা ও জোরদার করা।

সম্প্রতি আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি- আরসাও সারা দুনিয়া কাছে পরিষ্কার দাবি করেছে, তাদেরকে জিহাদি নয়, জাতীয়তাবাদী বলে গণ্য করা হোক। কয়েক দফা বিবৃতিতে তারা বলেছে, তাদের ওপর মিয়ানমারের নির্যাতন ধর্মীয় নয়, জাতিগত নিপীড়ন। রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গা ও রাখাইন উভয়ের এবং রাষ্ট্রীয় সমান সুযোগ সবার প্রাপ্য বলেও পরিষ্কার জানিয়েছে তারা। আরসার এই বক্তব্য লড়াইয়ের মাঠে থাকা একটি পরিণত জাতীয়তাবাদী সংগঠনকে আমাদের সামনে হাজির করে। রোহিঙ্গাদের সাধারণভাবে রাজনীতি অসচেতন মনে করা হলেও আরসা দেখাচ্ছে-দীর্ঘদিনের ব্যর্থ চিত্রায়ন থেকে বের হয়ে এসে তারা এখন জাতীয় মুক্তির প্রকৃত পথের দিশা চিহ্নিত করতে সক্ষম। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্মের লড়াইয়ের এই নীতি ও কৌশল আশাবাদী হওয়ার মতো।  বারবার নিপীড়নের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা, ধর্মীয় সম্পর্কের কারণে সামান্য আশ্রয়, প্রজন্মের পর প্রজন্মের ঠিকানাহীন পরবাস- কোনোটিই রোহিঙ্গাদের মুক্তি দিতে পারবে না। বরং জাতীয় চেতনা ও রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যেই রয়েছে এই জনজাতির প্রকৃত মুক্তি। আর সেই লড়াইয়ে সমর্থন দেওয়াই বাঙালির জাতীয় কর্তব্য।

 

লেখক : কবি ও সাংবাদিক