পশুর বর্জ্যও সম্ভাবনাময় রপ্তানি পণ্য
দেশে সারা বছরে যে পরিমাণ পশু জবাই করা হয়, এক কোরবানি ঈদেই তার থেকে অনেক বেশি পশু জবাই করা হয়ে থাকে। এক পরিসংখ্যানে প্রকাশ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান কোরবানি ঈদে গতবছর(২০১৬) এক কোটি পাঁচ লাখ পশু কোরবানি করা হয়েছিল। কিন্তু এ বছর হাওর এবং দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার কারণে পশু কোরবানির সংখ্যা প্রায় ২৫ শতাংশ কমে পঁচাত্তর থেকে আশি লাখে এসে নেমেছে। এতে চামড়ার সংখ্যা কমেছে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছুই।
আমরা এত দিন জানতাম কোরবানির পশুর চামড়াই মনে হয় একমাত্র মূল্যবান রপ্তানি পণ্য। তাই একে কেন্দ্র করেই সব ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ চলে থাকে। কিন্তু গত কয়েক বছর থেকে এর সঙ্গে নতুন ভাবে রপ্তানি পণ্যের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে পশুর বর্জ্য।
আর রপ্তানিযোগ্য বর্জ্য বলতে বোঝানো হয়েছে-তাদের হাড়, শিং, কান, নাড়িভুঁড়ি, মূত্রনালি, যৌনাঙ্গ, লোম, চর্বি, দাঁত, পায়ের খুর ও জমাট বাঁধা রক্ত ইত্য্যাদি।এগুলোর রপ্তানির জন্য মূল বাজার হচ্ছে-ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, চীন ও জাপান প্রভৃতি দেশে।বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে গত বছর দেশে দেড় থেকে দুই হাজার মণ এসব বর্জ্য থেকে উল্লেখিত দেশসমূহে প্রায় ১৭০ কোটি টাকারও বেশি আয় করা সম্ভব হয়েছে। তারা ধারণা করছে এ বছর এর সম্ভাবনা আরো বৃদ্ধি পেয়ে তা ২০০ কোটি টকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এমনটি হলে নিশ্চিতভাবে বলা যায় এটি একটি লাভজনক রপ্তানি পণ্য হতে পারে ভবিষ্যতের জন্য।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞমহলের ধারণা ও পরামর্শ-যদি বিষয়টিতে বড় ধরনের একটি জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা যায় তবে এ খাতের সম্ভবনা দিনে দিনে বাড়তে একটি অন্যতম উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পারে। এর মাধ্যমে এক ঢিলে কয়েকটি পাখি মারার মতো অবস্থা সৃষ্টি করা যেতে পারে। একদিকে রপ্তানিপণ্যের তালিকায় আরো কিছু পণ্য যুক্ত হলো, এসব বর্জ্য সাধারণভাবে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকলে পরিবেশের যে ক্ষতি হতো তা থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে, কিছু বেকার ও দুস্থদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং সর্বোপরি কিছু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে।
এখন এ ব্যবসাটি শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক চলছে। সেখানে মানুষের খাওয়ার পরে তাদের ফেলে দেওয়া মাংসের হাড়, বিভিন্ন রকমের বর্জ্য যেগুলো কোন ডাস্টবিন কিংবা বাগারে ফেলে রেখে চলে যায়, সেখান থেকে টোকাইরা কুঁড়িয়ে সংগ্রহ করে ব্যবসায়ীদের কাছে নিয়ে গিয়ে নামেমাত্র মূল্যে বিক্রি করে। পরে তারা তা একটু প্রসেস করে একত্রিত করে বিদেশে রপ্তানি করে থাকে। এ ব্যবসাটির খবর হয়তো এখনো কেউ জানে না। সেজন্য বলা হচ্ছে এ বিষয়ে যদি ব্যাপক প্রচার করা হয় যে কোরবানির চামড়ার মতো এসব বর্জ্যও ব্যবহারযোগ্য এবং তা এখন একটি মূল্যবান রপ্তানিপণ্য তাহলে এ বিষয়ে মানুষের আগ্রহ আরো বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে সারা বছর এসব কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে সহযোগিতা করার জন্য একটি প্রশিক্ষিত টিম তৈরি করে দেওয়া উচিত। আর এটি করার জন্য সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দায়িত্ব নিতে পারে।
এবারে ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন থেকে প্রায় ২৮ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। তা ছাড়া ট্যানারি থেকেও সংগ্রহ করা সম্ভব অনেক বর্জ্য। প্রশিক্ষিত টিম থাকলে হয়তো এখান থেকেও এ বছরেই অনেক রপ্তানিযোগ্য বর্জ্য বাছাই করে একদিকে নগরীর পরিবেশ রক্ষা সহজ হতো অপরদিকে তা রপ্তানি করে আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হতো। এখন জানা দরকার কী হয় এসব বর্জ্য দিয়ে। থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, জাপান ও চীনে পশুর যৌনাঙ্গ দিয়ে তৈরি করা বিশেষ এক ধরনের ঔষধ। সেজন্য সেসব দেশে একেকটি যৌনাঙ্গ ৬-৭ ডলারে বিক্রি হয়। গরু মহিষের হাড়, দাঁত দিয়ে তৈরি করা হয় ক্যাপসুল জাতীয় ঔষধের কভার। ট্যানারি থেকে পাওয়া উচ্ছিষ্ট চামড়া দিয়ে তৈরি করা হয় জুতার তলার সোল।
পশুর রক্ত সংগ্রহের পর সেদ্ধ করে শুকিয়ে গুঁড়া করা হয়। সেই গুঁড়ার সঙ্গে শুঁটকির গুঁড়া, সয়াবিন তেল ও যব মিশিয়ে তৈরি করা হয় মাছ ও মুরগির জন্য উচ্চ আমিষযুক্ত দানাদার খাবার। পশুর চর্বি দিয়ে হয় সাবান। শিং থেকে বোতাম ও চিরুনি তৈরি করা হয়। মহিষের শিংয়ের ডগা দিয়ে জাপানে বাচ্চাদের জন্য এক বিশেষ ধরনের খেলনা বানানো হয়ে থাকে। গরু ও মহিষের নাড়ি প্রক্রিয়াজাত করে মানুষের খাবার তৈরি করা হয়। জাপানে অতি জনপ্রিয় শোস্যাট রোলটি গরু ও মহিষের নাড়িভুঁড়ি দিয়ে তৈরি করা হয়ে থাকে। এসব বর্জ্য কেনা-বেচার জন্য রাজধানী ঢাকার পাশে কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, হাসনাবাদ ইত্যাদি স্থানে কয়েকটি বাজার ঈদের পরের দিন থেকে শুরু হয়ে ১০-১২ দিন চালু থাকে।
সংগৃহীত শিং, হাড় ইত্যাদি চুন মেশানো পানিতে ডুবিয়ে রাখলে ৫-৬ ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই তা পরিষ্কার হয়ে জীবাণুমুক্ত হয়। বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির আরেক তথ্যমতে, গত বছর শুধু কোরবানির পশু থেকেই এক হাজার মণ হাড়, ছয় হাজার কেজি যৌনাঙ্গ এবং ৫০০ মণ নাড়িভুঁড়ি সংগ্রহ করা হয়েছিল। শুধু কোরবানি ঈদে নয় সারাবছরই এ কাজ চলতে পারে। তবে কোরবানির ঈদেই নাকি সারা বছরের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ সংগৃহীত হতে পারে। সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বলছে এখনো পণ্যটির রপ্তানিকরণে ব্যাপকতা লাভ করেনি। তবে অদূর ভবিষ্যতে অপ্রচলিত এ খাতের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে যা সংশ্লিষ্ট সব মহলকে সুদৃষ্টিতে রাখতে হবে।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়