বাঁকা চোখে

সু চির নোবেলের ‘বেল’ নাই!

Looks like you've blocked notifications!

‘সু চির নুবেলের বেল নাই। অরে কত ভালো ভাবছিলাম। অয় নাকি সততা; গুনোতন্তোরো। আর অয় অহন কয় রুহিঙ্গা বইলা কিছু নাইক্যা। অরা নাকি বাঙ্গালি। মানুষগুলানরে কুপায়া কাপায়া মাইরা ফালাইতাছে। অর নুবেল-টুবেল কাইড়া ন্যায় না ক্যন?’—চা বানানোর সময় রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলছিলেন সত্তরোর্ধ্ব রউফ মিয়া। কারওয়ান বাজারে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে চায়ের দোকানদারি করেন তিনি। মিডিয়াপাড়ার সংবাদকর্মীরা তাঁর দোকানে চা খেতে আসেন। তাঁদের আলাপের অন্যতম অনুষঙ্গ থাকে রাজনীতি। ফলে রউফ মিয়ার একটু বেশিই রাজনীতি-সচেতন হওয়ার কথা।

চা-চিনি-দুধ মেশানোর সময় রউফ মিয়া গজগজ করতে করতে কাপের মধ্যে যেভাবে চামচ ঘোরাচ্ছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল আজ সু চি যদি তাঁর সামনে পড়তেন তাহলে তাঁর ‘খবর’ ছিল। তৃণমূল জনগোষ্ঠীর মৃত্তিকাসংলগ্ন তৃণমূলীয় খাস বাংলায় রউফ মিয়া সু চির চতুর্দশ প্রজন্মকে শাপশাপান্ত করছিলেন। তিনি সু চির নামের আগে যেসব বিশেষণ প্রয়োগ করছিলেন, তা কোনো সম্পাদকের পক্ষেই ছাপা সম্ভব নয় বলে তা লেখা যাচ্ছে না। জনসমক্ষে সেগুলো উচ্চারণ করাটাও খুব সভ্য-ভব্য ব্যাপার হবে না।

তীব্র রাগ আর ক্রোধে বিকৃত হয়ে যাওয়া রউফ মিয়ার মুখটা সেই তখন থেকে চোখের সামনে ভাসছে। কানে বাজছে তাঁর খিস্তিখেউড়। ভাবছি একি রউফের একার কথা? একি শুধু সাধারণ বাংলাদেশিদের কথা?

না তো! ব্রিটিশ লেখক জর্জ মনবিট গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি কলামে দেখলাম হুবহু রউফ মিয়ার কথা নকল করে মেরে দিয়েছেন। লেখাটির শিরোনাম, ‘টেক অ্যাওয়ে অং সান সু কি’স নোবেল পিস প্রাইজ; শি নো লংগার ডিজার্ভস ইট’। রউফের ভাষায় তরজমা করলে দাঁড়ায়, ‘অর নুবেল-টুবেল কাইড়া ন্যায় না ক্যান; অর আর এই জিনিস রাহার কুনো অধিকার নাই।’

আমরা যাঁরা ছা-পোষা জীবনযাপন করি; বিশ্ব রাজনীতির অ আ ক খ-ও জানি না; ‘শান্তিতে নোবেলজয়ী’ শুনলেই তাঁদের মনটা শ্রদ্ধায় ভরে যায়। প্রথমেই ধরে নিই শান্তিতে নোবেলজয়ী ব্যক্তিটি নিশ্চয়ই বিরাট কোনো মানবিক বিপর্যয় থেকে কোনো জাতিকে রক্ষা করেছেন। এই ধারণা যে একবারে ফালতু; তাও নয়। যাঁদের গলায় নোবেল কমিটি এই মেডেল ঝুলিয়ে দেয়, তাঁদের কেউই ‘রাম-শ্যাম-যদু-মধু’ কিংবা ‘আবদুল’ গোছের লোক নন। বিশ্বশান্তির প্রতিনিধি তাঁরা।

অং সান সু চি বড় ঘরের বংশীয় মেয়ে। পড়াশোনা করেছেন অক্সফোর্ডে। বিয়ে করেছেন বিলেতি সাহেবকে। দারিদ্র্য তাঁকে ছোঁয়নি। যৌবন কেটেছে বিলাসবহুলতায়। কিন্তু পরে তাঁকে দুই দশক জান্তা সরকার নিজ বাড়িতে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় ১৯৯১ সালে তাঁকে শান্তির চকমকা মেডেলখানা দেওয়া হয়। নোবেল কমিটির ঘোষণায় বলা হয়, ‘গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অহিংস সংগ্রামের জন্য সু চিকে এই পুরস্কার দেওয়া হলো।’ এই মেডেল মারাত্মক জিনিস। এটি গলায় লটকানোর সঙ্গে সঙ্গে সু চির খ্যাতির কথা বানের পানির মতো দুনিয়ার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে রোহিঙ্গা মুসলমানরা বার্মায় দাবড়ানি খেয়ে এসেছে। জান্তাদের সময় এই নির্যাতন আরো বেড়ে যায়। মিয়ানমারে গত নির্বাচনে সু চির দল জেতার পর রোহিঙ্গারা ভেবেছিল, ‘যাক বাবা, ডাঙা থেকে জলে নেমেছি। বাঘের কবল থেকে তো বাঁচলাম!’ এখন তারা দেখছে জলে সু চি নামের একটি বিশাল কুমির তাদের পা কামড়ে ধরেছে।

অনেকে বলছেন, রাখাইনে যা ঘটছে তার পেছনে সু চির হাত নেই। আর্মি সব করছে। আর্মির বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষমতা তাঁর নেই। তা ছাড়া স্থানীয় বৌদ্ধরা এই নির্যাতনে সমর্থন দিচ্ছে। রোহিঙ্গা নিয়ে কথা বললে সু চি আর্মি এবং জনগণ উভয়েরই সমর্থন হারাবেন। তাই তাঁর মুখে কুলুপ। আসলে তিনি মানুষ ভালো; ‘মাতৃরূপেনুঃ’ এবং অসাম্প্রদায়িক।

ধরা যাক সু চির ভক্তদের এই দাবি নায্য এবং সঠিক। তবুও তো রউফ মিয়াদের পক্ষে সু চিকে মাফ করার কথা না। রউফ মিয়ারা তো বলেতেই পারে, “আপনে ক্ষমতায় থাইকা শান্তির মেডেল গলায় ঝুলায়া পাকনা পাকনা কথা কইবেন; রুহিঙ্গারা কচুকাটা হবে; আর কইবেন ‘আমি কছু জানি না’, তা তো অয় না। বে-ইনসাফির বিরুদ্ধে কথা কইবেন দেইখ্যাইতো আপনারে মেডেল দিছে।”

সু চি মেডেল পেয়েছেন মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলার জন্য। নোবেল বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘অত্যাচার, নির্যাতন ও বৈষম্য সহিংসতাকে উসকে দেয়। নিগৃহীত মানুষ আত্মরক্ষার্থে কোনো না কোনো সময় আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।’

সেই বক্তৃতা দেওয়া সু চি গদিতে বসার পর এখন ‘পল্টি খেয়েছেন’। কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি যেসব ত্যাড়াব্যাকা বর্ণবাদী কথা বলেছেন, তা শুনলে যে কারুরই মনে হতে পারে তাঁর মেডেল কেড়ে নেওয়া উচিত।

গত বছরের ২৫ মার্চ বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দিচ্ছিলেন সু চি। সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন মিশাল হুসাইন। আলোচনা ভালোই চলছিল। হাস্যোজ্জ্বল সু চি তাঁর দেশের গণতন্ত্র ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলছিলেন। একপর্যায়ে মিশাল হুসাইন তাঁকে রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করেন। বিড়ালের সামনে খা খা গরম ভাত দিলে সে যেভাবে বেজার হয়ে গরর গরর করতে থাকে; মুহূর্তেই ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’র সেই দশা শুরু হয়। কোনোরকমে অনুষ্ঠান শেষ করে প্রযোজককে সু চি গজগজিয়ে বলতে থাকেন, ‘আমার সাক্ষাৎকার যে একজন মুসলমান নেবে, সে কথা তো আমাকে আগে জানানো হয়নি!’ তাঁর সেই অসাম্প্রদায়িক বাণীটি যে রেকর্ড হয়ে যায়, সে কথা তিনি বুঝতে পারেননি। পরে এই নিয়ে বিশ্বমিডিয়ায় সু চির অনেক নিন্দা-মন্দ হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সু চি কোনোদিন একটা ভালো কথা বলেছেন, এমন খবর গুগলে ঘণ্টাখানিক সার্চ করেও আমি পাইনি। তবে তাদের গুষ্টির পিন্ডি চটকাবার মতো মনোভাব প্রকাশ পায়—সু চির এমন অনেক বক্তব্য পাওয়া গেছে। প্রথমত, ক্ষুদ্র এই মুসলমান জাতিগোষ্ঠী যে ‘রোহিঙ্গা’ সেই কথাটাই তিনি কোনোদিন স্বীকার করেননি। সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সু চি বলেছিলেন, ‘রাখাইনের ওরা বাঙালি সন্ত্রাসী। ওদের রোহিঙ্গা বলবেন না।’ মানে সু চি মনে করেন, রোহিঙ্গা বলে কিছু নেই। ওরা বিদেশি। অনুপ্রবেশকারী। শতাব্দীর পর শতাব্দী আরাকানে বাস করা মুসলমানরা হচ্ছে বিদেশি। ওদের দায় মিয়ানমার নেবে না। এই হলো নোবেল শান্তিজয়ীর ভাষ্য।

সর্বশেষ গত ৬ সেপ্টেম্বর সু চি বলেছেন, রোহিঙ্গা গণহত্যার কথা বলে ভুয়া খবর ছড়ানো হচ্ছে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে টেলিফোনে সম্প্রতি তাঁর কথা হয়। সেখানে সু চি ফোনে এরদোয়ানকে বলেছেন, রাখাইনে এমন কোনো কিছু হচ্ছে না।

কিন্তু জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, সেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগতভাবে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার অভিযান চালানো হচ্ছে।

এই লেখা যখন লিখছি, তখন যুক্তরাজ্যের ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, চার লাখের বেশি লোক সু চির শান্তির মেডেল কেড়ে নেওয়ার জন্য নোবেল কমিটির কাছে আবেদন জানিয়েছে। তারা বলছে, এমন নির্মম গণহত্যার বিরুদ্ধে কথা না বলে উল্টো সাফাই গাওয়ার জন্য সু চির পুরস্কার প্রত্যাহার করা উচিত।

অবশ্য নোবেল কমিটি আগেই জানিয়ে দিয়েছে, আগের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁরা এই মেডেল দেয়। পরে ওই লোক খুন করল নাকি নোংরামি-লোচ্চামি করল, তা তাদের দেখার বিষয় নয়। এ কারণে ওই মেডেল ফেরত নেওয়ার মতো ‘ছোটলোকি’ কাজ তারা করতে পারবে না।

কিন্তু ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে রউফ মিয়ারা যখন দেখতে পায়, কচি তুলতুলে ছোট্ট বুকের ওপর দাঁড়িয়ে পাড়িয়ে পাড়িয়ে পাঁজড় ভেঙে রোহিঙ্গা শিশুদের মেরে ফেলা হচ্ছে; নবজাতকের দুই পা ধরে প্রকাশ্যে আছড়ে মেরে ফেলা হচ্ছে; স্বামী সন্তানের সামনে বিবস্ত্র করে পর্দানসীন নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে; পলায়নরত বৃদ্ধদেরও পেছন থেকে গুলি করে মারা হচ্ছে; তখন বিশ্ববিবেকের ‘বড়লোকি’র দিকে রউফ মিয়ারা থুতু ছোড়ে। ঘেন্নায় মুখ বিকৃত করে। চূড়ান্ত রকমের ‘ছোটলোক’ হয়ে রউফ মিয়ারা বলতে থাকে, ‘সু চির নুবেলের বেল নাই। অর নুবেল-টুবেল কাইড়া ন্যায় না ক্যান?’