আমি যেন তার নিরাপত্তা হই

Looks like you've blocked notifications!

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার সর্বগ্রাসী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলছে পুরো মাত্রায়। এখন যখন এমন ভীৎস্য দানবীয় চেহারার বিজয় দেখি মানবতার চরম পরাজয়ের মধ্য দিয়ে তখন মা-বাবার মুখে শোনা আমাদের চরম মানবিক সংকটের করুণ কাহিনী ১৯৭১ কে মনে পড়ে বারংবার।

আর তখনই উদ্বাস্তু সংখ্যালঘু এ মানুষগুলোর করুণ মুখের দিকে তাকালে নিজেকে অসহায় লাগে।মনে হয় আমি নিজেই এক উদ্বাস্তু মানুষ যেন।কারণ আমিও তো সংখালঘুদেরই প্রতীকী একজন। সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর দ্বারা এবং নানা সময়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নির্মূল করার নির্মম পরিকল্পনা বিশ্বব্যাপী যেন চলমান ঘটনা। মাঝেমধ্যে তাতে ঘৃতাহুতি দেওয়া হয় শুধু স্থান-কাল-পাত্র ভেদে।

কী ভয়ংকর জাতিগত নির্মূল অভিযান চালালে মানুষগুলো তাদের সহায় সম্পদ ফেলে জন্মভূমির মাটি ত্যাগ করে উদ্বাস্ত জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয় তা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়াটাই মনে হচ্ছে এখন বড়সড় পাপ। সেটা জাতি, ভাষা, ধর্মীয়, গোষ্ঠী বা বর্ণগত –তা যাই হোক না কেন। সংখ্যালঘুদের কোথাও কোনো শান্তি নেই। সংখ্যালঘুরা এখন সর্বত্রই অনিরাপদ জীবনের মৌলিক প্রতীক হয়ে উঠছে।

১৯৭১ সালে বাঙালি জাতিগত নিধনের পাশাপাশি ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দু নিধনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ”অল আউট” প্রচেষ্টা। পোড়ামাটি নীতি (স্কর্চ আর্থ পলিসি মানে মাটি চাই ;মানুষ নয়) বাস্তবায়নের  জন্য গণহত্যাসহ গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার যে পরিকল্পনা তারা বাস্তবায়ন করেছিল তা এক কথায় বিস্ময়কর।

এমনই এক সময়ে আমাদের পরিবার যখন ভারতে উদ্বাস্ত হয়ে যায় তখনকার কথা যখন মা-বাবার মুখে বড় হয়ে শুনেছি তখনই মনে হয়েছে তা যেন কল্পকাহিনীকেও হার মানানোর মতো ব্যাপার। কারণ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় আমার বড় বোনের বয়স ছিল ছয়-সাত বছর। তার  পরে দুই ভাই পিঠাপিঠি তিন-চার বছর বয়স ওদের। আর এক বোনের বয়স মাত্র সাত মাস। সঙ্গে বাবার বৃদ্ধা জেঠিমা। আমিসহ আমার একদম অগ্রজ ভাইটির তখন অবশ্য জন্মও হয়নি।

সাত মাসের এ মেয়েটিকে কোলে নিয়ে যখন নিজেদের বাস্তুভিটা ছেড়ে আমাদের পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে ভারতের পথে হেঁটে রওনা হয় সেদিনের সে দুঃসহ স্মৃতির কথা শুনলে আমার চোখ ভিজে আসে।নৃশংসতার ছবি কল্পনায় আমার মস্তিষ্কে ভেসে ওঠে।আমি তাই পারতপক্ষে এটা না শোনার চেষ্টা করি।

পথে যেতে যেতে আমার বড় দুই ভাই যখন জিজ্ঞেস করত আর কতদূর। আর কতদূর হাঁটতে হবে; তখন ওই যে আর একটু সামনে, এই তো কাছেই—এসব বলে বলে হেঁটে হেঁটে যখন সবাই সামনে চলতে থাকত তখন ওদের কচি কচি শরীর দুটো আর এক বিন্দুও চলতে চাইত না। কারণ হাঁটতে হাঁটতে ওদের পা দুটো ফুলে গেছে। মাঝেমধ্যে তাই ওদের কাঁধে নিয়ে হাঁটতে হয়েছে। তবুও ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। কারণ পথে যেতে যেতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বা তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর হাতে  আমাদের পরিবারকে ধরা পড়তে হয়নি।

পথে যেতে যেতে মানুষের বাড়িঘর দেখে ওরা জানতে চাইত ওদের কাছে গিয়ে ভাত চাইলে দেবে কি না। কারণ ক্ষিধা লাগলে পথে শুধু চিড়া-মুড়ি খেতে হতো। ছোট মানুষ ওরা তা খেতে পারত না।ফলে ভাত খাওয়ার জন্য ওদের মন ছুটে যেত। বাড়িতে কখনো ভাতের কষ্ট করেনি। কিন্তু সময় বড় নির্মম। ছোট ওরাও বুঝে গেল এখন আর ভাত চাইলেই পাওয়া যায় না। তা ছাড়া পথে যেতে যেতে রান্না করার সুযোগ এবং সময়ই বা কোথায়। কারণ জীবন বাঁচানোই তখন কঠিন দায়।

তাই কিছু করার নেই।কারণ দিনে রাতে মিলিয়ে যতটা পথ পরা যায় হাঁটতে হতো। রাতে হয়তো কোথাও বিশ্রাম নিত। সুযোগ থাকলে সেখানে হয়তো ইট বা মাটির ঢেলা দিয়ে উনুন তৈরি করে পথের পাশ থেকে পাতা কুঁড়িয়ে বা আশপাশের কোনো বাড়ি থেকে পাঠকাঠি চেয়ে এনে তা ধরিয়ে রান্না করার চেষ্টা করত। কিন্তু উদ্বাস্তু মনে সর্বদা ভয়। এই বুঝি মিলিটারি এলো। এই বুঝি দৌড়ে পালাতে হবে।

এভাবেই একসময় আমাদের পরিবার ভারতে পৌঁছে যায়।তারপর দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলে আমাদের পরিবার যখন আবার দেশ ফেরত আসার দিনক্ষণ গুনতে থাকে তখন আমাদের পরিবারের সবার বড় বোনটি (আগেই বলেছি ওর বয়স তখন ৬/৭ বছর) দেশে ফিরে আসতে অস্বীকার করে। কারণ ওর ধারণা হয় আসার পথে এতটা পথ ওকে যেভাবে হেঁটে আসতে হয়েছে সেভাবেই হয়তো আবার হেঁটে হেঁটে দেশে ফেরত যেতে হবে। মা-বাবা যতই ওকে বলেছে যে আর হেঁটে যেতে হবে না ওর ছোট্ট মন সেটা একদমই বিশ্বাস করতে চায়নি। তাই আমাদের পুরো পরিবার দেশে ফেরত এলেও ও রয়ে যায় আমার বাবার পিসি-পিসামশায়ের কাছে। নিঃসন্তান এ দম্পত্তির কাছেই ও পরে বড় হয়ে ওঠে।

এভাবেই আমার বড় বোনটি দেশ স্বাধীনের পরও ভারতেই থেকে যায়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কর্তৃক  শুধু একটা চাপিয়ে দেওয়া অনৈতিক যুদ্ধের পরিণতিতে যে লাখো কোটি মানুষের উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়ার করুণ কাহিনী সৃষ্টি হয়েছিল যুদ্ধ শেষেও সে মর্মান্তিক এবং বিচ্ছিন্নতার কাহিনী তাই শেষ হয়ে যায়নি। শেষ হয়ে যায়ও না কখনো। কারণ যুদ্ধ তার নির্মমতার সাক্ষ্য সবসময় কিছু না কিছু রেখে যায়। এ কারণেই আমার মা-বাবার প্রথম সন্তান যাকে আদর করে তারা ডাকত “পুতুল” নামে সে পুতুলকে তারা আর তাদের সাথে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। কত পরিবার যে উদ্বাস্তু জীবনে না খেতে পেয়ে রোগে শোকে পরিবারের সদস্যদের হারিযেছে তারও কোনো ইয়াত্তা নেই। অথচ এদের সবারই একটা সুন্দর জীবন ছিল।

”সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড” আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সময়ে উদ্বাস্তু মানুষদের নিজ চোখে দেখে অ্যালেন গিন্সবার্গ রচনা করছিলেন। পরে যা গান হিসেবে গাওয়া হয। সে কবিতা বা গানের শুরুর দুটো লাইন ছিল  Millions of souls nineteenseventyone / homeless on Jessore road under grey sun । Millions of souls অর্থাৎ এরা  লাখ লাখ মানুষ। শুধুই মানুষ। এদের ধর্মীয় পরিচয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। নেই কোনো জাতিগত পরিচয়ও। এ সংকট শুধুই মানবিকতার।

রোহিঙ্গা প্রশ্নেও তাই আমি বলব এদের ধর্মীয় পরিচয়কে যারা মোটা দাগে বড় করে দেখছেন তারা ভুল করছেন। এদের মানুষ হিসেবে ভাবুন। ধর্মীয় নয় বরং মানবিকতার  বৃহৎ দৃষ্টিকোণ থেকেই তাদের জন্য সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন। বিশ্ববাসীর সামনেও এ মানবিক সংকটের কথাটাই বারবার করে তুলে ধরুন। তুলে ধরুন তাদের জাতিগত সংখ্যালঘু পরিচয়ের কথা। সেটাই বরং বেশি সত্য। সংখ্যালঘু হওয়ার চেয়ে বড় কোনো তিক্ত সত্য আজ আর নেই।

পরিশেষে, ভুপেন হাজারিকার গানের কয়েকটা লাইন স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ লেখার শেষ টানতে চাই। সংখ্যালঘু কোনো সম্প্রদায়ের ভয়ার্ত মানুষের না ফোঁটা আর্তনাদ /যখন গুমরে কাঁদে / আমি যেন তার নিরাপত্তা হই।সারা বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষ; বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের করণীয় ব্যক্ত হয়েছে এ গানে।

আসুন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বেদনাকে হৃদয়ে অনুভব করি। তাদের নিরাপত্তা বিধানে আরো বেশি মানবিক হই।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।