অভিমত

রোহিঙ্গা শিবিরে জন্মনিয়ন্ত্রণ কতটা সম্ভব?

Looks like you've blocked notifications!

প্রায় সাড়ে চার লাখ রোহিঙ্গার জীবনের করুণ চিত্র আমাদের প্রতিনিয়ত পীড়িত করে।ফলে দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষজন  রোহিঙ্গাদের জন্য তাদের সাধ্যমতো সাহায্য সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। রোহিঙ্গা এ মানুষগুলো সত্যিই অভাগাজন। তারা রাষ্ট্র কর্তৃক নির্মম নিপীড়নের শিকার হয়ে জীবন বাঁচাতে পরভূমে আশ্রয় নিয়েছে। এর চেয়ে দুঃখজনক বিষয় আর কী আছে।

তবুও জীবন চলে জীবনের নিয়মে। জন্ম, মৃত্য আর ক্ষুধাকে  থামিয়ে রাখা যায় না। এসবই জীবনের অনুষঙ্গ। শিবিরগুলোতে মানবেতর এ জীবনের মাঝেই  তাই জন্ম নিচ্ছে নতুন জীবন। এ নতুন শিশুর জন্য যেমন চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজন তেমনিভাবে প্রসূতি মায়ের জন্যও প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে চিকিৎসাও। কিন্তু শরণার্থী জীবনে এসবের টানাপড়েন হয়। খাবার আর বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যেখানে কষ্টকর একটা ব্যাপার সেখানে অন্য সব ব্যাপার আর মুখ্য হয়ে ওঠে না। বা উঠতে পারে না।

পরিসংখ্যান বলছে, ২০ সেপ্টেম্বর অবধি  উখিয়াতে যে রোহিঙ্গা শিবির আছে সেখানে জন্ম নিয়েছে ১৭৩ জন শিশু।অর্থাৎ দিনে প্রায় ৮ জন শিশু জন্ম নিচ্ছে। এর বাইরে অন্য শিবিরগুলোতেও নিশ্চয় সন্তান জন্ম নিচ্ছে। অন্যদিকে সন্তান সম্ভবা রোহিঙ্গা নারীর সংখ্যা প্রায় আরো ৫০ হাজার। তাহলে চিত্রটা দাঁড়াচ্ছে যে আরো কিছুদিনের ভেতর রোহিঙ্গাপল্লীতে  নতুন করে ৫০ হাজার নতুন মুখের আগমন ঘটবে। এভাবে যদি রোহিঙ্গা  শিবিরে নতুন মুখের আগমন ঘটতে থাকে তাহলে তা আমাদের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপরে চরম চাপ তৈরি করবে।

পত্রিকার খবরে জানা যায়,  রোহিঙ্গা শিবিরে আগত মধ্যবয়সী নারীরা  প্রত্যেকে ১০/১২ টি সন্তানের মা। এর চেয়ে কমবয়সীদের নিদেনপক্ষে চার-পাঁচটি করে সন্তান। এর কারণ হচ্ছে তারা জন্মনিয়ন্ত্রন ব্যবস্থার সঙ্গে  অভ্যস্ত নয়। মিয়ানমার কখনো রোহিঙ্গাদের জন্ম নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে উৎসাহীও ছিল না। ভাবটা এমন যেন এরা অচ্ছুত জন। যা ইচ্ছে করুক। যেমন ইচ্ছে থাকুক। রাষ্ট্রের কোনো দায় বা দায়িত্ব নেই।

এদিকে মিয়ানমার  বলছে রোহিঙ্গারা বাঙালি। যদি এই হয় মিয়াননমারের মনের কথা তাহলে ধরে নিতে হবে তারা  তাদের এ নাগরিকদের খুব দ্রুত দেশে ফেরত নেবে না। সেক্ষেত্রে  রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য অব্যাহত রাখার পাশাপাশি তাদের জন্মনিয়ন্ত্রণের উপায় নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে এবং সে লক্ষ্যে নিবিড়ভাবে কাজ করে যেতে হবে।

মিয়ানমারের হাবভাব দেখে তো মনে হচ্ছে তারা আমাদের দেশ আগত এ রোহিঙ্গাদের হয়তো আর ফেরতই নিতে চাইবে না। এ ভাবনা মাথায় রেখে তাই রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে  জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য এখন থেকেই আমাদের কাজ শুরু করতে হবে। না হলে সামগ্রিকভাবে সমস্যা আরো বাড়বে।

রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে অবশ্য সরকারি এবং বেসরকারি নানা সংস্থা জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কিন্তু সেটা এখন অবধি ফলপ্রসু নয়। কারণ রোহিঙ্গারা জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সঙ্গে তো তেমন পরিচিত বা অভ্যস্ত নয়।

এখন তাই দায়িত্ব হচ্ছে শুধু জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী বিলি ব্যবস্থার পাশাপাশি সেগুলো ব্যবহারে তাদের উৎসাহিত করা। জন্মনিয়ন্ত্রণ করা কেন দরকার সে সম্পর্কে তাদের সম্যক ধারণা দিতে হবে। বিশেষ করে নারীদের। অতিরিক্ত গর্ভধারণ কীভাবে তাদের জন্য শারীরিক জটিলতা তৈরি বা ক্ষতির কারণ হতে পারে সে সম্বন্ধে  যথাযথ ধারণা দিতে হবে।

তা ছাড়া শরণার্থী জীবনে যেখানে খাবার, পানির সংকট রয়েছে এবং সেই সঙ্গে চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতাও বিদ্যমান তাই আর একটা নতুন শিশুকে কোনোভাবেই এ পরিবেশে যে জন্ম দেওয়া ঠিক হবে না সেটা তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। কারণ সন্তান জন্ম দেওয়াটাই বড় কথা নয়। তাকে মানুষ করে তোলাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।কিন্তু শরণার্থী জীবনে তা কি আদৌ সম্ভব?

রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে যদি জন্ম নিয়ন্ত্রণ না করা যায় তাহলে বিদ্যমান পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। এমনিতেই আমাদের সমস্যা প্রচুর। নিজেদের সমস্যার সমাধানেই   আমরা প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছি। তবুও মানবতাবাদী দৃষ্টিকোনের কারণে আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। তাদের খাবার এবং সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সংখ্যা যদি জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে তাহলে তো এক সময় আমরা তাদের জন্য বর্তমান সময়ের মতো অপ্রতুল সহযোগিতাও হয়ত অব্যাহত রাখতে হিমশিম খাব।

এ কারণে এ শিবিরগুলোতে স্বল্পমেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী বিতরণের পাশাপাশি মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রণের পন্থাও অবলম্বন করতে হবে। এ ব্যাপারে তাদের জানাতে হবে। তাদের ভেতরে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। কারণ এরা শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। এদের বোঝাতে হয়তো সময় লাগতে পারে।তবে বোঝালে কাজ নিশ্চয়ই হবে। এজন্য হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। বরং প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। সেই সঙ্গে  জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রীও যথাযথভাবে সরবরাহ করা অব্যাহত রাখতে হবে।

রোহিঙ্গা শিবিরে জন্ম নিয়ন্ত্রণ ওদের জন্য যেমন দরকার তেমনিভাবে দরকার আমাদেরও। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের তাই সরকার নির্ধারিত নির্দিষ্ট এলাকাগুলোতে  আগে একত্রিত করতে হবে। তারপর তাদের জন্ম নিয়ন্ত্রণের সুফল সম্পর্কে ওয়াবিকহাল করতে হবে। যারা এখন অবধি শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে তাদের মধ্যে   এ লক্ষ্যে জোরদারভাবে কাজ শুরু করতে হবে।

আর তার চেয়েও বড় কথা কুটনৈতিক তৎপরতা সহ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সাহায্য নিয়ে মিয়ানমার সরকারকে যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদেরে তাদের দেশ ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আর একমাত্র এটাই হচ্ছে এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র সহজ সমাধান।

লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক, সহযোগী অধ্যাপক, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।