আইএসকে হারানোর আশা পশ্চিমাদের, ইতিহাস বলছে ভিন্নকথা

Looks like you've blocked notifications!
রবার্ট ফিস্ক। ফাইল ছবি

হিটলার একটি খারাপ উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন। তিনি ছিলেন অশুভ। তাঁর বাহিনী ছিল অশুভ। তাঁর সম্রাজ্য ধ্বংস হয়েছে। নাৎসিরা হারিয়ে গেছে। ইউরোপের দুঃস্বপ্নে হিটলার মারা গেছেন নিজ হাতেই। খারাপ ব্যক্তি হারে। ভালো ব্যক্তি জিতে যায়। মূল্যাবোধ, মানবাধিকার, আইন, গণতন্ত্র—এসব আধুনিক কথা। আমরা সাবধানে এটা বলতে পারি—ভালো সবসময়ই পাপকে জয় করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমাদের এটিই শিখিয়েছে। বিশ্বের বড় ধর্মগুলো আমাদের শেখায় সততা, মানবতা, পরিবার, ভালোবাসা ও বিশ্বাস। তাহলে আমরা কেন এই বিশ্বাসে শক্ত নই যে, নিষ্ঠার শক্তির কাছে পরাজিত হবে সহিংসতা, নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা?

আইএস অশুভ। বিরোধীদের গণহত্যা,  বেসামরিক জনগণ হত্যা, নিরপরাধ মানুষের শিরশ্ছেদ, শিশু ধর্ষণ, নারীদের দাস হিসেবে রাখাসহ নানা অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের দৃষ্টিতে এটি হলো ‘ধ্বংসাত্মক’, তাই এর ধ্বংসও নিশ্চিত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশ কার্টারের অভিযোগ ইরাকিরা আইএসের ভয়ে পালিয়ে এসেছে। গত সপ্তাহে তাঁর বক্তব্য ছিল, তিনি ছেলেমানুষির বিষয়টি বোঝেন না। তিনি বলেন ‘সভ্যতা সবসময়ই বর্বরতার বিপক্ষে জয়ী হয়।’

কিন্তু সত্যি কি? শুরুতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে যে মিথ্যা বলা হয়েছিল সে বিষয়ে বলি। হিটলার হেরেছিলেন। কিন্তু জয়ী হয়েছিলেন স্তালিন। ১৯১৭ সালের রাশিয়ার বিপ্লবের মাধ্যমে আসে সোভিয়েত একনায়কতন্ত্র। খাদ্যাভাব ও বর্বরতায় মারা যায় লাখো মানুষ। শয়তানরূপী শাসকরা ৭০ বছর পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়া শাসন করেছে। এর ৪০ বছরই কেটেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর।

রোমানরা ‘বর্বরতা’ টিকিয়ে রেখেছিল প্রায় হাজার বছর। কিন্তু অবশেষে গোথ, অস্ট্রোগোথ ও ভিসিগোথ (পূর্ব জার্মানির দুটি জাতি)—ওই সময়কার আইএসই জিতেছিল। রোমান বর্বরতার মধ্যে ছিল ক্রুশবিদ্ধ, দাসত্ব, নির্যাতন ও গণহত্যা (আইএসের সবই আছে শুধু ভিডিওচিত্র বাদ)।

‘অ্যাটিলা দ্য হুন’ কে বলা হয় ‘স্রষ্টার চাবুক’, যিনি পারস্য থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত প্রায় সবকিছুই ধ্বংস করেছেন। এই নাটকের আরেক অপরিহার্য অভিনেতা চেঙ্গিস খান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে গেছেন।  তাঁর নাতি হুলাগু বাগদাদকে পুরো ধ্বংস করেন। ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইরাককে স্বাধীন করে ‘সভ্যতা’ ফিরিয়ে আনেন যুক্তরাজ্যের এক জেনারেল অ্যাংগাস মড।

অ্যাশ কার্টার মডের ঘোষণাটি পড়তে পারেন। তিনি বলেছিলেন, ‘হুলাগুর সময় থেকে এখানকার নাগরিকরা বাইরের মানুষের শাসনের শিকার। তোমাদের স্থানগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তোমাদের বাগানগুলো হয়েছে জনশূন্য এবং তোমাদের পূর্বপুরুষ ও তোমরা ছিলে দাসত্বের শিকার। অরেকভাবে দেখলে এটি অনেকটাই আইএসের মতো। কিন্তু ওই স্বৈরশাসন চলেছে প্রায় ৭০০ বছর।

এবার আসা যাক ২০০৩ সালে অবৈধভাবে হামলার মাধ্যমে ইরাকে পুনরায় ‘সভ্যতা’ প্রতিষ্ঠার পরের বছরগুলোতে। প্রতিদিন শহরের মর্গে যাওয়া এবং তাঁবুতে থাকা বিলাপকারী ও ক্ষুব্ধ পরিবারগুলোর ভাষ্য, আমাদের দেওয়া স্বাধীনতা তাঁদের দিয়েছে নৈরাজ্য। তাঁরা স্বৈরশাসক সাদ্দামকে ঘৃণা করত, যিনি তাঁর প্রতিপক্ষকে হত্যা করেছেন এবং ২৪ বছর নিজের জনগণের ওপর ‘বর্বরতা’ চালিয়েছেন—কিন্তু অনন্ত সবাইকে নিরাপত্তা দিয়েছিলেন। ওই মানুগুলো বলে, আপনার যদি সন্তান থাকে তবে চাইবেন সে বাড়িতে ফিরে আসুক। কোনোভাবেই চাইবেন না সে খুন হোক। আমাদের প্রতি তাঁদের প্রশ্ন—কোনটি  আপনি চান স্বাধীনতা না কি নিরাপত্তা?  গণতন্ত্র না কি সাদ্দাম?  

শিয়া-নিয়ন্ত্রিত ইরাকি সরকারকে তাঁরা ভয় পায়, যার সেনাদল তাঁদের ওপর গণহত্যা চালায় এবং দুর্নীতিবাদ আরব স্বৈরশাসক তাঁদের ওপর শোষণ চালায়। লাখো সুন্নি মুসলমান খুঁজে পায় আইএসের অধীনে তাঁরা নিরাপদ। শিয়া নয়, খ্রিস্টান নয়, নয় ইয়াজিদীরাও। সেখানে কোনো ‘স্বাধীনতা’ নেই, যা আমরা বলে থাকি। বৈরুতের অনেক সুন্নি মুসলমান নিয়মিত আইএসের সিরিয়া অঞ্চলের কেন্দ্র রাক্কাতে যান। তাঁরা বলেন, ধূমপান না করলে ও অ্যালকোহন না খেলে, নারীরা আবৃত থাকলে এবং আইএসবিরোধী না হলে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয় : ব্যবসা, পরিবারের সঙ্গে সাক্ষ্যাৎ, ভ্রমণ সবই নিরাপদ। (আফগানিস্তানের তালেবান আমলেও অনেকটা এমনই ছিল।)

আইএসের-অঞ্চলে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়, নতুন রং করা নৌকায় আছে নৌপুলিশ, কর আদায় করা হয় এবং অবশ্যই শাস্তি হয় বর্বর। কিন্তু এর মানের এই নয় ‘ইসলামিক খেলাফত’ পরাজিত হবে ‘সভ্যতা’র মাধ্যমে।

আমরা কীভাবে বিশ্বাস করি এটি ঘটবে, যখন আমাদের জনসংযোগ কর্মকর্তারা ব্রিটিশ মূল্যবোধের গর্জন তোলেন এবং একই সময়ে অর্থের মাধ্যমে কাজ করা, কুটিল, প্রচণ্ড ধনী এবং ভয়ঙ্কর সব মানুষের ভক্তি করে, যাঁরা আইএসকে উদ্বুদ্ধ করতে সহায়তা করেছে। অবশ্যই আমি বোঝাচ্ছি ওইসব সৌদিকে যাঁদের সুন্নি ওহাবি বিশ্বাস উদ্বুদ্ধ করেছে আইএসকে, যাঁদের সামঞ্জস্যহীন হাস্যকর অতিনৈতিকতা মাথা-কাটার চরমপন্থায় তারা উদ্বুদ্ধ হয়েছে, আর এটিই তাদের নিজস্ব বর্বরতার কেন্দ্র। নিশ্চয়ই সৌদি রাষ্ট্র আইএসের বিরুদ্ধে। তবে একই সময়ে পশ্চিমা জাতিগুলোর সমর্থনে বোমাবর্ষণের মাধ্যমে হাজারো হুতি শিয়াকে মারছে সৌদিরা এবং অদ্ভুত রাষ্ট্রের শুকনো রাজা মারা গেলে কী করেন ডেভিড ক্যামেরান (যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী।)? অবশ্যই অর্থ ‘সভ্যতা’র চেয়ে জোরে কথা বলে। তিনি ব্রিটিশ পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দেন। এখন আমি একেই বলি ব্রিটিশ মূল্যবোধ!

হায়রে ডেভ (ডেভিড ক্যামেরন)। সে আইএসকে ঘৃণা করে অথচ সম্মান করে এর বয়োজ্যেষ্ঠ ‘সহায়তাকারী’কে। ভয় পেয়ো না। ‘সভ্যতা’ এখনো হয়তো ‘বর্বরতার’ বিরুদ্ধে জিতবে। আমার নিজের সন্দেহ হলো, অ্যাশ (অ্যাশ কার্টার), ডেভ (ডেভিড ক্যামেরন) এবং অপরেরা আইএসকে কিনে ফেলার চেষ্টা করবে, অনেক ভাগে একে বিভক্ত করবে এবং তাঁদের মধ্যে ‘মধ্যপন্থা নিয়ে’ আসবে। এর পর আমরা পাবো উদারনীতির আইএস—যাঁদের সঙ্গে ব্যবসা করা যায়, কিছুটা একসঙ্গে চলা যায়, সব পাপ ভুলে যাওয়া যায়। এর পর আমরা তাঁদের সঙ্গে বেশ ভালোই সম্পর্ক করব, যেমনটি দেখা গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ‘সভ্যতা’র কাছে বর্বরতা পরাজিত হওয়ার পর, হিটলারের খুনে রকেট বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের।

‘সভ্যতা’র জন্যই সব।

লেখক : রবার্ট ফিস্ক, যুক্তরাজ্যের ‘দি ইনডিপেনডেন্ট’ পত্রিকার মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি। সাহসী সাংবাদিকতার জন্য পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। 

যুক্তরাজ্যের ‘দি ইনডিপেনডেন্ট’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে অনুবাদ করেছেন জাহিদ আব্দুল্লাহ।