রম্যরচনা
ডিম নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড!
অফিসের কর্তা গলায় টাই বাঁধতে বাঁধতে খেয়াল করলেন, সকালের নাশতাটা করা হয়নি। বাসাতেও কেউ নেই যে নাশতা তৈরিতে সাহায্য করবে। এদিকে সময়ও কম। নো চিন্তা! দুই পিস ব্রেড আর একটা ডিম পোচ, ব্যস তৈরি হয়ে গেল নাশতা। এই হলো ডিমের স্মার্টনেস। ডিমের গুণাবলি এবং পুষ্টিগুণ তাই বলে শেষ করা যাবে না।
ডিম এখন মধ্যবিত্তের খাবার হিসেবে শীর্ষে। হোস্টেল-ছাত্রাবাসগুলোতেও ডিম ছাড়া একদিনও চলে না। ডিম দিয়ে কী হয়? এই প্রশ্নের চেয়ে ডিম দিয়ে কী হয় না, বলাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। ডিম ভাজি, ডিম চপ, ডিমের কোরমা, সেদ্ধ ডিম, ডিমের ভুনা, ডিমের অমলেট, ডিমের পাকোড়াসহ আধুনিক সময়ের এগ চ্যাট, এগ সালাদ কিংবা ডিমের মুত্তা এভিয়াল কত না রেসিপি। এ কারণে ডিম ডিমই।
ডিম, ডিম্ব, আণ্ডা—যে নামেই ডাকি না কেন, সেই ডিম নিয়ে বাংলাদেশের রাজধানীতে হয়ে গেল হুলস্থূল এক কাণ্ড। শুধু হুলস্থূল বললে কমই বলা হবে, বলতে হবে এলাহি কাণ্ড। উহু! এলাহি কাণ্ডতেও এ ঘটনার পুরো মর্তবা ফুটে উঠছে না। বলা যেতে পারে লঙ্কাকাণ্ড! হ্যাঁ, লঙ্কাকাণ্ডই হয়ে গেল শুক্রবার সকালে।
তিন টাকা করে একটি ডিম, অর্থাৎ এক হালির দাম মাত্র ১২ টাকা, যা বাজারদরের অর্ধেকেরও কম। আর জনপ্রতি সর্বোচ্চ ৯০টি করে ডিম কিনতে পারবেন। কয়েক দিন ধরেই ফেসবুক, টেলিভিশন, খবরের কাগজ আর মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়ে সুস্বাস্থ্যের জন্য ডিম নিয়ে একটি মেলার এমনই প্রচারণা ছিল।
কিন্তু মেলার দিনে কী ঘটল? দিন বললে ভুল বলা হবে, কারণ আসল মেলা টিকেছিল মাত্র আধঘণ্টা। হঠাৎ করেই শুরু হলো হুলস্থূল, ঠেলাঠেলি। সেইসঙ্গে ভাঙল কয়েক ডজন ডিম। এরপরই পুলিশের বাঁশি উঠল বেজে। তারপর একপশলা লাঠিচার্জ। এ যেন সাতসকালে বৃষ্টির ঝঙ্কার।
এরপর বাঁশি বাজিয়ে ঘণ্টার মধ্যেই খালি করে দেওয়া হলো মেলা প্রাঙ্গণ। সেই বিরাণ মেলা প্রান্তরে পড়ে রইল কয়েক খাঁচি ভাঙা ডিম।
পার পিস ডিম মিলবে মাত্র তিন টাকায়! বিশ্ব ডিম দিবস উপলক্ষে এ-ই ছিল আয়োজকদের ঘোষণা। এ ঘোষণা শুনে আড়াই কোটি মানুষের এই ঢাকায় ডিম্বপ্রেমীর সংখ্যা দুই কোটি ঊনপঞ্চাশ লাখ নয়শ নিরানব্বই জন খামারবাড়িতে হাজির। তাও আবার এসেছেন কাকডাকা ভোরে। মেলা প্রাঙ্গণে ছুটে এসেছিলেন ঢাকার বাইরেরও অনেকে। নানা বয়সী, নানা শ্রেণির মানুষ। একসঙ্গে সবাই ডিম পেতে অস্থির।
কেউ স্লোগান দিচ্ছেন—ডিম্ব চাই, ডিম্ব চাই! ডিম্ব ছাড়া উপায় নাই! পার পিস এগ/ভাঙে ভাঙুক লেগ, তবুও চাই ডিম্ব/জলদি ধরো ব্যাগ। আবার কেউ বা বলছে, 'টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া/ফিরব আজকে ডিম্ব নিয়া'।
শেষ অবধি এই বিশাল ডিম্বপ্রেমীদের ভাগ্যে ডিম্ব মেলেনি। মিলবে কী করে? পার পিস ডিমের জন্য এদিন এক লাখ করে লোকের আবেদন! ফলে আয়োজকরা কূলকিনারা হারান। ডিমপ্রেমীরাও হয়ে ওঠেন উন্মত্ত। শান্তিপ্রিয় পুলিশ ভাইয়েরা বসে থাকার পাত্র নন। তাঁরাও ডাণ্ডা নিয়ে তেড়ে যান। সবশেষে ডিম্বপ্রেমীরা ঠান্ডা হন। ফলে সমীকরণ গিয়ে দাঁড়াল ডিমাডিমিতে। অর্থাৎ, ডিমাডিমি = আণ্ডা>ডাণ্ডা>ঠাণ্ডা।
১৯৯৬ সাল থেকে ডিম দিবসের সূচনা হলেও ডিম্বমেলার আইডিয়া এ দেশে নতুন। তাঁরা ডিমের পুষ্টি বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতেই হয়তো এমন আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের মাথায় কেন এলো না যে এই ঢাকা শহরে আড়াই কোটি মানুষের বাস। তাদের সামনে রেখে এমন মেলা আয়োজনের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ডিম উপস্থাপন জরুরি। জানা যায়, মাত্র এক লাখ ডিম মেলাতে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু ডিমের চাহিদা ছিল কোটির।
এই শহরে সামান্য টাকা রোজগারের মানুষই বেশি। তাদের হাতে অঢেল অর্থ নেই। তাই তারা সংসার খরচ থেকে দুপয়সা বাঁচাতে পারলে সংসার নামের যুদ্ধটায় কিছুটা স্বস্তি পেতে পারত। সে কারণেই তারা ডিমযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল।
কিন্তু নিন্দুকরা এটা নিয়ে এখন কটাক্ষ করছে। মন্দ বলছে। এটা ঠিক না। সমালোচকরা তো জানে না, স্বল্প আয়ের এই ডিমপ্রেমীরা নেহাত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষ। পুষ্টির চাহিদা মেটাতে কম দামের আশায় এদিন তাঁরা ডিমযুদ্ধে নেমেছিলেন। ঠেকায় না পড়লে কি কেউ যুদ্ধে নামে? বুঝতে হবে আয়োজকদের। এরপর তাঁরা যদি এমন মেলার আয়োজন করেন, মাথায় রাখতে হবে ডিমের জোগানের দিকে।
এ প্রসঙ্গে একটি প্রচলিত গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। আয়োজকদের কাজে দেবে।
এই ডিম্বমেলার আয়োজকদের মতো ডিমের চাহিদায় চ্যাপ্টা হওয়া এক পোলট্রি ব্যবসায়ী একবার ক্ষেপে গিয়ে তাঁর সব মুরগিকে বলেছিলেন, 'দেখ্ বাছারা, দেশে এখন ডিমের বেশুমার চাহিদা। এ অবস্থায় আগামীকাল থেকে যদি প্রতিদিন দুইটা করে ডিম না দিস, তাহলে তোদের ধরে জবাই করে খেয়ে ফেলব, হুম।'
এর পর থেকে প্রতিটি মুরগিই প্রতিদিন দুইটা করে ডিম দিতে শুরু করল!
শুধু একটা বাদে!
ওইটা প্রতিদিন একটা করেই ডিম পারতে লাগল!
এ অবস্থায় ব্যবসায়ী ক্ষেপে গিয়ে সেটিকে বললেন, 'কী রে! তোর তো সাহস কম না! এত বড় হুমকি দিলাম, এরপরও একটা করে ডিম পারতেছিস!'
সেটি উত্তর দিল, 'জনাব, আপনার ভয়ে বহু কষ্টে একটা করে ডিম পারতেছি! আমি আসলে মোরগ।'
লেখক : বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।