ছিটমহল

৬৮ বছরের ছিটমহল যুগের সমাপ্তি

Looks like you've blocked notifications!
তুহিন ওয়াদুদ। ফাইল ছবি

বাংলাদেশ-ভারতের অভ্যন্তরে ১৬২টি ছিটমহল রয়েছে। ১৯৪৭ সালে যখন দেশবিভাগ হয়, তখনই এগুলো সৃষ্টি হয়। দেশবিভাগের সময়ে কোচবিহার ছিল স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। সে কারণে দেশবিভাগের সময়ে ভারত-পাকিস্তান সীমানা নির্ধারণে কোচবিহারকে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো সুযোগ ছিল না। ১৯৪৯ সালে কোচবিহার ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়। ফলে দেশবিভাগের সময়ের সীমানা নির্ধারণই ছিটমহল সৃষ্টির প্রধান কারণ হয়ে দেখা দেয়। এ কারণে দীর্ঘ এই ৬৮ বছর দুদেশের ১৬২টি ছিটমহলের মানুষ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে কোনো সুবিধা পায়নি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল। এই ছিটমহলগুলোর মানুষ ভারতের। চারদিকে বাংলাদেশবেষ্টিত বলে তাঁরা কখনোই বৈধ পথে ভারতে যেতে পারেননি। শুধু তা-ই নয়, ভারত সরকারও অন্যান্য নাগরিকের মতো এসব নাগরিকের সুবিধা চাইলেও দিতে পারেনি। একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোর বাস্তবতা। তবে উভয় দেশ সচেষ্ট হলে ছিটমহলবাসীর সমস্যা অনেক আগেই সমাধান করা সম্ভব হতো।

দেশবিভাগের পর ১৯৫৮ সালে নেহরু-নূন চক্তি হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি করেন। এই চুক্তির ১২ ধারায় বলা হয়, ‘বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহল ও ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশি ছিটমহল দ্রুততার সঙ্গে বিনিময় হবে।’ যদি এই চুক্তি তখনই অনুসরণ করা হতো, তাহলে সে বছরই ছিটমহল সমস্যা দূর হতো। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশ শাসন করেছেন, রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দেশ শাসন করেছন, তার পর খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ছিলেন। এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম দফায় ক্ষমতা থাকাকালীন পর্যন্ত ছিটমহল সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল ভীষণ কম। প্রায় সবাই কমবেশি আঙ্গুরপোতা-দহগ্রাম সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু ১৬২টি ছিটমহল নিয়ে কেউই সোচ্চার ছিলেন না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতাসীন হলেন, তখন তিনি তিনবিঘা করিডোর এবং ১৬২টি ছিটমহল সমস্যা নিয়ে তৎপর হন। প্রথমবার ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি তিনবিঘা করিডোরের সাময়িক ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর ছিটমহল সমস্যা নিরসনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসহযোগিতার কারণে ২০১১ সালে এই ছিটমহল সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হয়নি। মনমোহন সিং ২০১১ সালে ১৯৭৪ সালের চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন। আসার কথা ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসেননি। তখন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং শুধু প্রটোকল স্বাক্ষর করে চলে যান।

ছিটমহল সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো বাধাই ছিল না। কখনো জিয়া, কখনো এরশাদ, কখনো খালেদা জিয়া ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁরা জোরালোভাবে সমস্যা সমাধানে তৎপর না হলেও ছিটমহল বিনিময়ে কারো কোনো আপত্তি ছিল না। বাধা ছিল ভারতের। কখনো ফরোয়ার্ড ব্লক, কখনো বামফ্রন্ট এই চুক্তি বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় হয়ে দেখা দিয়েছিল। তখন পশ্চিমবঙ্গের চারবার নির্বাচিত এমএলএ দীপক সেনগুপ্ত ছিটমহলবাসীর সমস্যা সমাধানে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেন। রাজনৈতিক সংগঠনের ছত্রছায়ায় সম্ভব নয় মনে করে সামাজিকভাবে আন্দোলন গড়ে তোলেন। ২০০৯ সালে তিনি প্রয়াত হলে তাঁর ছেলে দীপ্তিমান সেনগুপ্ত আন্দোলনে সক্রিয় হন। একদিকে ছিটমহলবাসীর মুক্তির জন্য নিয়মিত কর্মসূচি গ্রহণ, অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নীতি পরিবর্তনের জন্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের উচ্চপদস্থদের সঙ্গে নিয়মিত কাজ করেন দীপ্তিমান সেনগুপ্ত। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীতির পরিবর্তন, নরেন্দ্র মোদির আন্তরিকতা এবং শেখ হাসিনার জোর চেষ্টা ছিটমহল বিনময়ে প্রধান ভূমিকা পালন করে। গত ৭ মে নরেন্দ্র মোদি লোকসভায় ১৯৭৪ সালের স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুমোদনের পর খুবই দ্রুত চলতে থাকে বাস্তবায়নের কাজ। ৬ জুন মাত্র এক মাস পরেই ঢাকায় শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত প্রটোকল অনুযায়ী ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। ৬ থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত চলে ছিটমহলবাসী কে কোন দেশে থাকতে চায়, সেই পরিসংখ্যানের কাজ। সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১১১টি ছিটমহল থেকে ৯৭৯ ভারতীয় নাগরিক নিজ দেশে যাবেন। বাংলাদেশি ছিটমহলের একজনও বাংলাদেশে ফিরবেন না। ৩১ জুলাই রাত ১২টার পর ছিটমহল বিনিময় হচ্ছে। ১ আগস্ট থেকে আর কোনো ছিটমহল থাকবে না। যেসব নাগরিক ভারতে যাবেন, তাঁরা ১ আগস্ট থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ট্রাভেল পাস নিয়ে নির্দিষ্ট কয়েকটি বন্দর দিয়ে ভারতে যেতে পারবেন।

দীর্ঘ ৬৮ বছরে তাঁদের জীবন ছিল গভীর অন্ধকারে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১১১টি ছিটমহলের মধ্যে ৪২টিতে এবং ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশি ছিটমহলগুলোর ১৬টিতে কোনো মানুষের বাস নেই। বাকি ছিটমহলগুলোর দেশীয় পরিচয়ের চেয়ে বড় পরিচয় ছিল তাঁরা ছিটের মানুষ। প্রকৃত অর্থে তাঁদের কোনো সরকার ছিল না। তাঁদের স্কুল ছিল না, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল না, যোগাযোগব্যবস্থার কোনো উন্নয়ন হয়নি। ছিটমহলের মানুষ মেয়ের বিয়ে দিত অন্য একজনের বাবা পরিচয়ে। স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে হলে অন্য একজনকে স্বামী পরিচয়ে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হতো। সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে হলে মিথ্যা ঠিকানা ব্যবহার করতে হতো। কেউ জমি দখল করলেও কিছুই করার ছিল না। কোনো অপরাধের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা ছিল না। সংখ্যালঘু হওয়ায় তাঁদের সব অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোতে বহুবার অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। লুটপাট চলেছে সব সময়ে। ছিটের বাইরে বেরোলেই বিএসএফ এসে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে ধরে নিয়ে গেছে। অভিযোগ আছে, পর্যাপ্ত ঘুষ দিতে না পারলে তাঁদের জেলে দেওয়া হতো। জেলজীবন শেষ হলে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হতো বাংলাদেশি কোনো বর্ডারে। বাংলাদেশি ছিটমহলবাসীকে শুধু শারীরিক-মানসিক নির্যাতন নয়, অনেককে মেরেও ফেলেছে। কিন্তু কোনো বিচার হয়নি। ছিটমহলের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও তাঁরা সেখানে পড়ালেখা করতে পারেননি।

গত ৭ মে ভারতের লোকসভায় ’৭৪-এর স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুমোদনের পর থেকেই ছিটমহলগুলোতে চলছে আনন্দের বন্যা। ছিটমহলবাসীর চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক লেগেই আছে। তাঁরা সরকার পাবে, নিজের পরিচয় পাবে, স্বাধীন ভূখণ্ড পাবে, শিক্ষা-চিকিৎসাসেবা পাবে, অপবাদ থাকবে না, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন হবে, সীমানাবিহীন প্রাচীর থাকবে না, মিথ্যার বেসাতি সাজাতে হবে না। শোষণ-নির্যাতন-বঞ্চনা-নিগ্রহ-নিষ্পেষণ-অবহেলা-উপেক্ষা-নাগরিকত্বহীনতা সবকিছুরই অবসান হচ্ছে ১ আগস্ট থেকে। উভয় দেশের ছিটমহলবাসী উদযাপন করছে এই দিনটি। দিনটি তাঁদের কাছে স্বাধীনতা দিবস। 

ছিটমহল বিনিময় প্রক্রিয়ার কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে কিছু কিছু ছিটমহলবাসীর জন্য সমস্যা আরো ঘনীভূত হয়েছে। তবে এ সমস্যা নিশ্চয়ই দীর্ঘ হবে না। কারণ, ছিটমহলবাসীর যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্যই এ চুক্তির বাস্তবায়ন।

ছিটমহলবাসীর বড় সমস্যা হচ্ছে—২০১১ সালে উভয় দেশের প্রচেষ্টায় যে জরিপ হয়েছিল, সেই জরিপে বাদ পড়েছেন কয়েক হাজার ছিটমহলবাসী। আমরা আশা করছি, তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করার কাজটি শিগগিরই সমাপ্ত হবে।

ছিটমহলবাসী দীর্ঘদিন ধরে জমি বিক্রি করেছেন সাদা কাগজে কিংবা স্ট্যাম্পে সই করে, যা জমি বিক্রির পদ্ধতিতে পড়ে না। যেসব ছিটমহলবাসী ভারতে যাবেন, তাঁদের ভূমি ব্যবস্থাপনা কী হবে—এখনো তা বলা হয়নি। ছিটমহল নিয়ে বড় সমস্যার সমাধান হলো। আশা করি, এসব তুলনাসুলভ ছোট ছোট সমস্যারও সমাধান হবে অনতিবিলম্বে।

ছিটমহল বিনিময়ের পরপরই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উভয় রাষ্ট্রের উচিত কয়েকটি কাজ করা। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, যোগাযোগ, পরিচয়পত্র এসবের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যারা মিথ্যা ঠিকানা ব্যবহার করে লেখাপড়া করেছে, তাদের জন্য চাকরির শর্ত শিথিল করে চাকরির ব্যবস্থা করাও প্রয়োজন।

৬ মে, ২০১৫-এর আগে যাঁরাই ছিটমহলে গেছেন, তাঁরাই জানেন কতটা হাহাকার নিয়ে, হতাশার অন্ধকারে ডুবে ছিলেন ছিটমহলবাসী। ৬ মের পর থেকে ছিটমহলগুলোতে চলছে সীমাহীন আনন্দের বন্যা। এই আনন্দের বন্যায় যেন কালো দাগ না পড়ে। তাঁদের নিয়ে যেন আর নতুন করে কেউ কোনো নোংরা রাজনীতির বলয় নির্মাণ করতে না পারে, সেদিকে সরকারের বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশ-ভারত উভয় সরকার মিলে ঐতিহাসিক যে কাজ করল, তা যেন সমুজ্জ্বল থাকে।

লেখক : তুহিন ওয়াদুদ, সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর ।