খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস
গৌরবের ২৭ বছর
১৯৯১ সালে ২৫ নভেম্বর চারটি ডিসিপ্লিনে মাত্র ৮০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করে বর্তমানে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। বাংলাদেশে একমাত্র রাজনীতিমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। এখনো খুলনাবাসী খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের বুকে ধারণ করে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জনে গর্বিত এবং সমস্যায় হয় ব্যথিত।
তাই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস খুলনাবাসী সবাই উৎসবমুখর পরিবেশে পালন করে থাকে। খুলনার মানুষ এই বিশ্ববিদ্যালয়েকে এতই ভালোবাসে যে তাদের সন্তানদের প্রথমেই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে বলে তারপর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা চিন্তা করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো রাজনীতির লেজুরবৃত্তি ও সেশনজট মুক্ত ক্যাম্পাস। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব ভালো গুণাবলি থাকা উচিত প্রায় সব গুণাবলিই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান। দক্ষ ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আন্তর্জাতিক মানের ফ্যাকাল্টি মেম্বার, পর্যাপ্ত গবেষণা এবং সিনিয়র ছাত্রছাত্রীদের গঠনমূলক দিকনির্দেশনা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে গেছে এক স্বতন্ত্র অবস্থানে। রাজনীতি মুক্ত মানেই রাজনীতি হীনতা নয়, বরং অন্যান্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও যথেষ্ট রাজনীতি সচেতন। এটি দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে থিসিস বা গবেষণা ব্যতীত কোনো স্তরেই ডিগ্রি দেওয়া হয় না।
কোয়ালিটি গবেষণা ব্যথিত কোনো শিক্ষার্থী এখান থেকে পাস করতে পারে না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশে সুনামের সহিত তাদের কর্মক্ষেত্রেও পরিচিত। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজের স্বাধীনতা ও নেতৃত্বের সমন্বয় খুবই প্রয়োজনীয়। একটি ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয় এমন পরিবেশে উদ্ভাসিত হয় যা প্রতিযোগিতা, সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, উদ্ভাবন এবং এভাবে এগিয়ে যায় উন্নতির শিখরে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কাজের স্বাধীনতা, নেতৃত্ব এবং শিখন ও শেখার পরিবেশ প্রদান করে যা ভবিষ্যতের নেতাদের উদ্বুদ্ধ এবং সর্বাত্মক ব্যক্তিত্বের উন্নয়নকে তুলে ধরে উদ্ভাবনী প্রকল্পগুলোতে কাজ করার জন্য শিক্ষার্থীদের উৎসাহ জোগায়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি বৃত্তির পাশাপাশি ডিসিপ্লিন ভিত্তিক বৃত্তির ব্যবস্থা থাকায় অনেক গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন নিশ্চিত করছে। বিভিন্ন দেশীয়ও এবং আন্তর্জাতিক মানের কর্মশালার, সেমিনার এবং অন্যান্য কর্মসূচি আয়োজনের মাধ্যমে নতুন নতুন জ্ঞানের সাথে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পরিচিত করা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রুটিন কাজ। ১৯৯১ সালে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের পরিচয় হয় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। চার বছরের ব্যবসায় প্রশাসন এ স্নাতক ডিগ্রি (ব্যবস্থাপনা) দেবার ক্ষেত্রে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ বাংলাদেশের মাঝে এক অগ্রদূত। বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা পদ্ধতিগুলোর উন্নয়নের জন্য এই অনুষদ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই প্রতিশ্রুতি তার ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন ফোরামে যেমন AMDIB (Association of Management Development Institutions of Bangladesh) and AMDISA (Association of Management Development Institutions in South Asia ) তে সক্রিয় অংশগ্রহণ মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে বাংলাদেশ নৌ কর্মকর্তাদের জন্য নিয়মিত ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি থেকে এই প্রতিশ্রুতি আরো দৃশ্যমান হয়ে উঠে।
খুলনা সাতক্ষীরা মহাসড়কের পাশে ১০১ একর জায়গার ওপর বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। এমন শান্ত ক্যাম্পাস বাংলাদেশে আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। ক্যাম্পাসে ঢোকার পথেই দেখবেন বড় বড় মেহগনি এবং শিরীষগাছ। পাশেই প্রশাসনিক ভবন। ক্যাম্পাসের কোনো ভবনের গায়ে লেখা নেই কোনো রাজনৈতিক দলের স্লোগান। নেই কোনো মিছিল মিটিং। শিক্ষার্থীরা হলে সিট পায় মেধার ভিত্তিতে। অংশগ্রহণ করতে হয় না কোনো মিটিং মিছিলে যা বাংলাদেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কল্পনাও করা যায় না। ২০১৭ সালে এসেও বাংলাদেশে যে রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করা যায় তার একমাত্র উদাহরণ এই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্র আন্দোলন বা কোন্দলের কারণে একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি শিক্ষা কার্যক্রম, রাজনীতির দুরবিত্তপনায় কোনো কোমলমতি শিক্ষার্থীর রক্তে রঞ্জিত হয়নি এই সবুজ ক্যাম্পাস।
বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামানের নেতৃত্বে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। ২৮টি ডিসিপ্লিন এবং দুটি ইনস্টিটিউটের সব শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষা শুরু এবং শেষ হয় একই একাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে। জানুয়ারি মাসের এক তারিখে প্রথম সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হয় এবং পরীক্ষা শেষ করে রেজাল্ট প্রকাশ করা হয় জুনের ৩০ তারিখের মধ্যে। দ্বিতীয় সেমিস্টার শুরু হয় জুলাইয়ের এক তারিখে এবং ফালাফল প্রকাশসহ শেষ হয় ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে। দ্বিতীয় সেমিস্টারে উঠার আগেই শিক্ষার্থীরা তাদের প্রথম সেমিস্টাররে ফলাফল জেনে যায়। নেই কোনো সেশন জট ও রেজাল্ট জট।
শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমে সমান ভাবে অংশ গ্রহণ করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দেশের সব জাতীয় উৎসব যথাযথভাবে পালন করে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ডজন খানিক সাংস্কৃতিক সংগঠন শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। তার মধ্যে নৃ-নাট্য (নাটক), থিয়েটার নিপুন(নাটক),ব-পাঠ(পাঠক), ছায়াবৃত্ত(আবৃতি), ৩৫ মিমি(মুভি ক্লাব), খুলনা ইউনিভার্সিটি ফটোগ্রাফিক সোসাইটি (ফটোগ্রাফি ক্লাব), ওঙ্কার-শৃনুতা, ভৈরবী(সংগীত), রোটারেক্ট ক্লাব (সেচ্চাসেবক), বাধন (রক্তদান কর্মসূচি ), স্পার্ক (নাচের ক্লাব), নয়েজ ফ্যাক্টরি (ব্যান্ড সংগীত), অন্বেষ- খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সংগঠন, নৈয়ায়িক (খুবি-বিতর্ক সংগঠন) এবং কুয়েস- খুলনা ইউনিভার্সিটি ইকোনমিক সোসাইটি। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সংগঠনের অনুষ্ঠান হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা।
এত সাফল্যের পরও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সীমাবদ্ভতা আজও বিদ্যমান। ছাত্র ও ছাত্রী হলের স্বল্পতা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নির্বিঘ্নে করার জন্য টিএসসি, একাডেমিক ভবন, কেন্দ্রীয় মসজিদ ও মন্দির নির্মাণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরের রাস্তা সম্প্রসারণ ও আধুনিক করণ। বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহর জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন। একটি আধুনিক মেডিকেল সেন্টার নির্মাণ, শিক্ষক কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক বাসভবন নির্মাণ, পরীক্ষার হল নির্মাণ এবং জমি অধিগ্রহণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান এবং ভবিষ্যৎ প্রকল্পগুলো সঠিক সময়ে শেষ হলে এই সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয় এক নতুন সীমায় উন্নীত হবে। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে স্থানের জন্য দরকার গবেষণায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ এবং সরকারের আন্তরিকতা।
শুভহোক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। নতুন নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবন এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিত থাকুক আজীবন।
সহকারী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।