সুপারবাগস ও বাংলাদেশের পোলট্রি

Looks like you've blocked notifications!

ডিম নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দুটি তুলকালাম কাণ্ডের কথা হয়তো অনেকেরই মনে আছে। সবর্শেষটি ঘটেছিল ঢাকায় গত অক্টোবরে, বিশ্ব ডিম দিবসে জাতিকে ৩ টাকা দরে ডিম খাওয়াতে গিয়ে। মানুষের চাপ ও চাহিদার বিপরীতে ডিমের জোগান দিতে না পেরে হট্টগোলে পিছু হটেছিলেন আয়োজকরা, পরে তাঁরা দুঃখও প্রকাশ করেন। 

আর প্রথমটি ঘটেছিল গত জুলাইয়ে চট্টগ্রামের পটিয়ায়। বাসায় আনা ডিম নকল সন্দেহ হওয়ায় বিচারক থানায় মামল ঠুকে দিয়ছিলেন দোকানদার সহ তিনজনের নামে, গ্রেপ্তার হয়েছিলেন দুজন। পরে তদন্ত ও গবেষণায় পাওয়া ডিমগুলো নকল ছিল না, ছিল কেন্ডলিং ডিম (কেন্ডলিং ডিম হলো সেসব ডিম যা বাচ্চা ফুটানোর উদ্দেশে হ্যাচিং মেশিনে দেওয়া হয়। সাত-আটদিন পর পরীক্ষা করে যদি দেখা যায় , ডিমগুলো থেকে বাচ্চা ফোটানো সম্ভব নয় তখন বাচাই করে কিছু ডিম বাজারে বিক্রি করা হয়। এই ঘটনার পর ভোক্তাদের আশ্বস্ত করতে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশে নকল ডিম নেই ঘোষণা দিয়ে সবাইকে নির্ভয়ে ডিম খাওয়ার বিজ্ঞাপনও দিতে হয়েছিল। 

বাংলাদেশে ডিম নিয়ে এই তুলকালাম কাণ্ডের মধ্যেই ডিম নিয়ে আরেক কেলেংকারি ঘটে যায় ইউরোপে। নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, বেলজিয়াম থেকে যুক্তরাজ্যে আমদানি করা ডিমে ফিপ্রোনিল নামক নিষিদ্ধ কেমিক্যালের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। ইউরোপজুড়ে শুরু হয় তোলপাড়। ধ্বংস করা হয় প্রায় সাত লাখ ডিম। ফিপ্রোনিল হচ্ছে এক ধরনের কীটনাশক যা খামারে ব্যবহার করা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠে। এ ঘটনায় ইউরোপে বন্ধ হয়ে যায় অনেক পোলট্রি খামার। 

প্রশ্ন হচ্ছে উন্নত বিশ্বে পোলট্রি এবং পোলট্রিজাত পণ্য বিশেষ করে ডিম এবং মাংস নিয়ে তারা যতটা সচেতন, সে তুলনায় আমরা এখন পর্যন্ত কতটা সচেতন হতে পেরেছি। বিচারকের কাছে ডিম বিক্রি করে দোকানদারকে ডাণ্ডাবেরি পড়তে হয়েছিল। কিন্তু হ্যাচিং ডিম বিক্রি করা কোম্পানি কীভাবে বাচাই করে এই ডিম বাজারে ছাড়ল, আর সেখানে হ্যাচিং প্রতিষ্ঠানটির কোনো দোষ ছিল কি না, থাকলে তার কোনো শাস্তি হয়েছিল কি না সে খবর ভোক্তারা জানেন না।

দেশ-বিদেশে এসব লকাকাণ্ড আর কেলেংকারি নিয়ে কথা বলার একটাই কারণ সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা। আর যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাতটাও ওই গবেষণার কারণেই। সেটি হচ্ছে সুপারবাগস। বিশ্বজুড়ে এই সুপারবাগস নিয়ে বেশ তোলপাড় চলছে। আমাদের সচেতন ভোক্তাদের অনেকেই হয়তো বিষয়টি জানেনও।  

সুপারবাগস কী? অনেকের মনে এই প্রশ্ন জাগাও স্বাভাবিক। আবার প্রশ্ন জাগতে পারে সুপারবাগসের সাথে পোলট্রির সম্পর্ক কী? সুপারবাগস হচ্ছে সেসব ব্যাকটেরিয়া যাদের আপনি অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে মারতে পারবেন না অর্থাৎ তারা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, প্রাণী খাদ্যের মাধ্যমেই তৈরি হচ্ছে এই সুপারবাগ। সম্প্রতি চীনের ডালিয়ান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (Dalian University of Technology in China) তাদের এক গবেষণায় বলেছে, প্রাণীখাদ্যে ব্যবহৃত ফিশ মিল, বোনমিল, চিকেনমিল এ তারা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীনের অস্তিত্ব পেয়েছেন। চীন, রাশিয়া, পেরু, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গা থেকে নমুন সংগ্রহ করে তারা এই গবেষণা করেছিলেন। ফিশ মিল, বোনমিল, চিকেনমিল হচ্ছে প্রাণীখাদ্য তথা পোলট্রি ফিডের অন্যতম একটি উপাদান।

আর কানাডা ও ফ্রান্সের একদল গবেষক বলছেন, বাণিজ্যিক খামারের কারণেই এই অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জিন তৈরি হচ্ছে। কারণ বাণিজ্যিক খামারগুলোতেই প্রাণীদের ওষুধ বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানোর প্রবণতা বেশি। সম্প্রতি জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল কোয়ালিটি’তে তাদের এই গবেষণা প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। 

প্রাণী থেকে অর্থাৎ ডিম ও মাংস থেকে মানুষের শরীরে ঢুকে যায় এই সুপারবাগ। অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীন ধারণ করা ব্যাকটেরিয়া তথা সুপারবাগস নিয়ে বিশ্বময় উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় বলা হচ্ছে এই সুপারবাগসের কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতিবছর মারা যেতে পারে প্রায় ১ কোটি মানুষ যা ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যার চেয়ে বেশি। 

উন্নত বিশ্বই যেখানে এই প্রাণী খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশের অবস্থাটা কোন পর্যায়ে তা সহজেই অনুমেয়। কারণ এখানে পোলট্রি শিল্পের বিকাশের শুরুর দিকে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়েছে গ্রোথ হরমোন হিসেবে। ২০০৯ সালে সরকারের বিধিনিষেদের কারণে তা কমে আসে। নতুন পশু খাদ্য আইনেও এনমিলে ফিডে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কী সব বন্ধ হয়ে গেছে? 

বন্ধ যে হয়নি তার কিছু প্রমাণ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরেও আছে। পোলট্রি শিল্পের উদ্যোক্তারাও এ বিষয়টি নিয়ে অবগত। আর প্রান্তিক খামারিরা কারণে অকারণে ওষুধ কোম্পানি কিংবা হাতুড়ে ডাক্তারের পরমর্শে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছেন খামারে। বাংলাদেশে পোলট্রি শিল্প নিয়ে কাজ করা বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার গবেষকরা জানিয়েছেন এখনো খামারিরা অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করছেন অ্যান্টিবায়োটিক। বিশেষ করে মানুষের অ্যান্টিবায়োটিক সিপ্রোফ্লক্সাসিনও ব্যবহার হচ্ছে পোলট্রিতে। আর বিদেশ থেকে আমদানি করা ফিশমিল বোনমিল তো রয়েছেই।

সুপারবাগসের কথা যদি আলাদা করেই রাখি, তারপরও কী আমরা পোলট্রি শিল্পের ফিডের মানের ক্ষেত্রে খুব ভালো জায়গায় অবস্থান করছি? আমাদের দেশের গবেষণার ফলাফলও তো কপালে ভাঁজ ফেলার জন্য যথেষ্ট।

বছর দুই আগে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট পোলট্রির ফিড এবং মাংস ও ডিমের ওপর গবেষণা করে যে তথ্য দিয়েছে তা যে কোন সচেতন মানুষেরই উদ্বেগের কারণ। রেডি ফিডগুলো নিরাপদ হলেও পোলট্রিতে যে খোলা খাবার ব্যবহার করা হয় তার প্রায় ১৫ শতাংশ নমুনাতে লেড, ক্রোমিয়াম ও আর্সেনিকের মতো ভারী ধাতুর উপস্থিতি মিলেছে। ব্রয়লার মাংসের একই হারের নমুনাতেও অনুমোদিত মাত্রার দ্বিগুণ ক্রোমিয়াম এবং সহনশীল মাত্রার চেয়ে একটু বেশি ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে। যদিও ডিমে এ ধরনের ক্ষতিকর কিছু পাওয়া যায়নি। তবে ডিম পারা মুরিগর ৫০ শতাংশ নমুনাতে অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে ৪-৬ গুণ ক্রোমিয়াম পেয়েছেন গবেষকরা। ডিম ছাড়া পোলট্রি ও পোলট্রিজাত দ্রব্যের ২৫ শতাংশ নমুনাতেই সালমোনেলা জীবাণুর উপস্থিতিও পেয়েছে প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট যা কি না জনস্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি।
এ গবেষণার ফলাফলও আমাদেরকে আরো সতর্ক হওয়ার বার্তা দেয়। পোলট্রিজাত পণ্যগুলোও পরীক্ষা করা জরুরি। কারণ আমাদের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা দেওয়াও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বাংলাদেশের ভোক্তারাও সচেতন হতে শুরু করেছেন তা টের পাওয়া যায় সুপার শপগুলোতে। সেখানে সচেতন ভোক্তারা সাধারণ ডিমেরে চেয়ে প্যাকেটজাত ডিম এবং প্যাকেটজাত বিশেষায়িত ডিমের প্রতিই আগ্রহী হন বেশি। যারা চড়া দাম দিয়ে কেনার সামর্থ্য রাখেন তাঁরা সেসব ডিম কিনে নিয়েই বাসায় ফিরেন। এমন বেশ কিছু ভোক্তার সাথে সুপার শপে কথা হয়েছিল। তাঁদের কথা একটাই, স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ঝুঁকি নিতে চান না তাঁরা। কারণ পোলট্রি খাদ্য নিয়ে নানা গুজব (কোনো কোনো ক্ষেত্রে সত্যি) তাঁদের কানেও আসে। কিন্তু এ রকম ভোক্তার সংখ্যা বাংলাদেশে একেবারেই কম, তা বলাই যায়।

দামে কম হওয়ায় ব্রয়লার মাংসের প্রতি সাধারণ ভোক্তাদের আগ্রহ থাকলেও সামর্থ্যবানরা কিন্তু বাজারে গিয়ে খোজেন দেশি মুরগি কিংবা পাকিস্তানি মুরগির দিকে। কারণ পোলট্রি খাদ্য নিয়ে সন্দেহটা অমূলক এমন অকাট্য প্রমাণ তাদের কাছে তুলে দেওয়া যায়নি। 

কাজেই এখানে মান নিয়ন্ত্রণে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া যাবে না। মানুষের স্বাস্থ্য এর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকেই এখানে নেতৃত্বে থাকতে হবে।

কারণ এ শিল্পটির অভিভাবক প্রতিষ্ঠান তারা। জনবলের সংকট হয়তো থাকতে পারে, সেটি জনস্বার্থেই দ্রুত সমাধান করে নিরাপদ পোলট্রি নিশ্চিত করা দরকার।

ইতোমধ্যেই সাভারে একটি আধুনিক ল্যাবরেটরি বা পরীক্ষাগার নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি ভালো উদ্যোগ বলতে হবে, কিন্তু প্রাণীসম্পদ চাইলে ফুড সেফটি ল্যাবরেটিরও সহযোগিতা নিতে পারে। মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে এত গুরুত্ব দিতে হচ্ছে এই কারণে যে, এটি বড় স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। আর সংশ্লিষ্ট সবার জবাবদিহিতার জায়গাটাও তো এখান থেকেই তৈরি হবে।

কারণ দেশে বর্তমানে যে প্রোটিনের জোগান রয়েছে তার প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ ভাগ জোগান আসছে পোলট্রি থেকে। এটি খাদ্যের জোগানের দিক থেকে একটি বড় অর্জন। আরেকটি বড় অর্জন তার সাথে যোগ করতে হবে সেটি হচ্ছে কর্মসংস্থান। নিঃসন্দেহে বলা যায় পোলট্রি শিল্প গ্রামীণ উন্নয়নেও একটি বড় ভূমিকা রাখছে। গতিশীল রেখেছে গ্রামীণ অর্থনীতিকে। বাংলাদেশ পোলট্রিশিল্প কেন্দ্রীয় কাউন্সিল-বিপিআইসিসির পরিসংখ্যান বলছে এ খাতে কর্মরত আছেন অন্তত অর্ধকোটি মানুষ। অর্থাৎ গার্মেন্টস শিল্পের পরেই দেশের সবচে বড় কর্মসংস্থানের বাণিজ্যিক খাতটি হচ্ছে পোলট্রি। কাজেই ধরে নেওয়া যায় দেশের অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান উল্লেখ করার মতো। পরিসংখ্যান বলছে জিডিপিতে এর অবদান ২.৫ শতাংশ। 

আর এই অর্জনের বড় কৃতিত্বের দাবিদার খামারি এবং এ খাতের বড় শিল্প উদ্যোক্তাদের। কাজেই পোলট্রি শিল্পের উদ্যোক্তাদেরও দায়িত্ব নিতে হবে মান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এবং অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রেও। ইতিমধ্যেই উদ্যোক্তারা ঘোষণা দিয়েছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের হবে বাংলাদেশের পোলট্রি শিল্প এবং বিদেশে রপ্তানিও করবেন তাঁরা। আর ২০২১ সালের মধ্যে পোলট্রিকে কৃষির চেয়েও বড় খাতে পরিণত করার লক্ষ্যও রয়েছে তাঁদের। এতসব লক্ষ্যের মধ্যে যেন জনস্বাস্থ্য উপেক্ষিত না হয়, সুপারবাগস মুক্ত পণ্য যেন শুধু সুপারশপ কেন্দ্রিক না হয় এমন আশা করা ভোক্তাদের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। জনস্বাস্থ্য বান্ধব পোলট্রি শিল্পের বিকাশ সবার জন্যই মঙ্গলজনক।

লেখক : সিনিয়র করেসপনডেন্ট, এনটিভি