পদ্মাবতী বিতর্ক

ইতিহাসের চেয়েও বেশি কিছু

Looks like you've blocked notifications!

চিতোরের রানী পদ্মিনী ও দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির ইতিহাস আশ্রয়ী সঞ্জয়লীলা বানসালি পরিচালিত বলিউড চলচ্চিত্র ‘পদ্মাবতী’ নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। গণ অনুভূতি, রাজনৈতিক হিসেবনিকেশ ও উগ্রবাদী বিতর্ক ছাড়িয়ে আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু এখন শিল্প ও শিল্পের স্বাধীনতা বনাম রাষ্ট্রের ক্ষমতা। সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতা এখন বেশ কোণঠাসা। মুক্তমত এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে হিন্দুত্ববাদীদের রক্তচক্ষুর হিসেব মেনে।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর ভারতীয় শাসনব্যবস্থার প্রকৃত ইতিহাসকে পেছনে ফেলে ‘পদ্মাবতী’ রচনা করতে যাচ্ছে ইতিহাসের চেয়েও বেশি কিছু।

‘রাজপুত কর্ণী সেনা’ বলে এক উগ্রবাদী গোষ্ঠী সিনেমাটিকে ঘিরে প্রায় বছরখানেক ধরে যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে। সিনেমার সেট পুড়িয়ে দেওয়া, পরিচালকের গায়ে হাত তোলা থেকে শুরু করে পদ্মিনী চরিত্রে রূপ দেওয়া দীপিকা পাড়ুকন ও পরিচালকের মাথার দাম নির্ধারণ করে দেওয়াসহ কী সব ঘটে চলেছে তার কুলকিনারা নেই। ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে নানাকালেই বিস্তর কল্পগল্প প্রচলিত হয়ে এসেছে। এর সবটার সত্যাসত্য ইতিহাসবিদরা নিরূপণ করে উঠতে পারেন না। এমন পরিস্থিতিতে একজন প্রতিথযশা শিল্পী যদি তেমন ইতিহাসকে আশ্রয় করে নিজের বিচারবুদ্ধির মিশেলে মহত্তম এক জীবনবাদী গল্প বলতে চান তবে তার নাক কাঁটতে যাওয়া মানে সভ্যতার চাকাকেই বাধাগ্রস্ত করা। গণতন্ত্রের কথা বলা আধুনিক ভারত কি তবে পেছন দিকে হাঁটা শুরু করেছে?

বানসালির ছবিটি মুক্তির আগেই সব পক্ষ বিচারক সেজে তা নিষিদ্ধের দাবি জানাচ্ছে। চলচ্চিত্রটিতে যদি কোনো অসঙ্গতি থেকেও থাকে তা আলোর মুখ দেখার আগেই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোটা এক অনিশ্চিত অন্ধকারকে সমর্থন করার সমান কথা। ভারতীয় রাজনীতিবিদরাও এখন নিজেদের ভোটব্যাংক শক্তপোক্ত রাখতে ‘রাজপুত কর্ণী সেনা’ নামের উগ্রবাদী মৌলবাদীদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র কিংবা বিহারের মূখ্যমন্ত্রীরা পর্যন্ত বলে দিয়েছেন তাদের রাজ্যে ‘পদ্মাবতী’ মুক্তি দেয়া চলবে না। এমন সিদ্ধান্তের বিপরীতে এসে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি অবশ্য ইউটার্ন নিয়েছেন।

মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন তাঁর রাজ্যে বানসালির এই সিনেমা মুক্তি দিতে সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন না। এখানেও বিজেপিবিরোধী রাজনীতি আছে। তারপরও মুসলিম মৌলবাদীদের তোষণকারী হিসেবে নাম কামানো মমতার সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত শিল্পের স্বাধীনতার পক্ষেই যাচ্ছে।  

‘পদ্মাবতী’র বিরুদ্ধে আন্দোলনতর কর্ণী সেনাদের দাবি, বানসালি তাঁর সিনেমায় পদ্মিনীকে অপমানজনকভাবে উপস্থাপন করেছেন। তিনি নাকি রাজস্থানের চিতোরের মহারানী পরমা সুন্দরী পদ্মিনীর (সিনেমায় পদ্মাবতী) সঙ্গে দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির প্রেমকথা চিত্রায়িত করেছেন। এক স্বপ্নদৃশ্যে নাকি পদ্মিনী ও আলাউদ্দিন খিলজি একসাথে হাত ধরাধরি করে নেচেছেন। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের দাবি, চিতোর দখলকারী আলাউদ্দিন খিলজি পদ্মিনীর রূপে মাতোয়ারা হয়ে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রানী পদ্মিনী এমন অপমানের হাত থেকে বাঁচতে আগুনে ঝাপ দিয়ে আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন। খিলজি কর্তৃক চিতোর দখল বা বিপুল হিন্দুকে মেরে ফেলবার কথা থাকলেও পদ্মিনীর এমন ইতিহাস ইতিবাসবিদদের জানা নেই। যুগ যুগ ধরে চলে আসা পদ্মিনীকেন্দ্রিক কল্পগল্পই এখন উগ্রবাদী ও তাদের পৃষ্ঠপোষক ক্ষমতাসীন ডানপন্থি জাতীয়তাবাদী বিজেপি পার্টিবাজদের কাছে একমাত্র মান্যকর মিথ।

ইতিহাসে তাদের মন নেই। তাদের ভাবনায় কাজ করছে একটাই কিছুতেই মুসলিম শাসক খিলজির জন্য হিন্দু পদ্মিনীর অনুরাগ দেখানো যাবে না। তাতে নাকি সমগ্র রাজপুত নারীর অপমান হয়। এ কথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, পশ্চিম থেকে মুসলিম শাসকরা ভারতবর্ষ দখল করে হিন্দুদের সম্পদ লুট করে তাদের হঠিয়ে দীর্ঘদিন ভারতবর্ষ শাসন করেছে। পরবর্তীকালে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গায় দুই পক্ষেরই লাখো মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। সেই পূর্ব ইতিহাস ধরে রেখে যদি হিন্দুত্ববাদীরা এই আধুনিক যুগেও জাতি-ধর্ম-বর্ণের ভিত্তিতে মানুষের বিভাজন কল্পনা করে মামুলি একটা চলচ্চিত্র নিয়ে বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতি তৈরি করে তা হয় চরম প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং আধুনিক সভ্যতার জন্য অশনিসংকেত।     

বানসালি বারবার ঘোষণা দিয়েছেন, হিন্দুদের অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে এমন কোনো দৃশ্য `পদ্মাবতী`তে নেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ছবির মুক্তি আটকাতে কর্ণী সেনারা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থও হয়। সেই পিটিশন অবশ্য খারিজ করে দিয়েছে শীর্ষ আদালত। অন্যদিকে ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন (সিবিএফসি) মুভিটি ছাড় পাবে কি না এ ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। আর মুভিটির বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠন করেছে রাজস্থান সরকার। সর্বোপরি সিনেমাটিকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। ভারতের চলিচ্চিত্রের ইতিহাসেই এটি একটি অভাবনীয় ঘটনা যে, কোনো একটি উগ্রবাদী দলের চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রই এখন একটি চলচ্চিত্রের মুক্তির অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভারতের শিল্প সমঝদার বা শিল্প সংশ্লিষ্টরা বিচ্ছিন্নভাবে চলচ্চিত্রটির পক্ষে সরব হলেও সামগ্রিকভাবে সব পক্ষ এখনো এক হতে পারেনি। কারণ শিল্পীদেরও রাজনীতি করে খেতে হয়। শাসকদলের হুমকি মাথায় নিয়ে বানসালির ‘পদ্মাবতী’র পক্ষে দাঁড়াবেন এমন বুকেরপাটা আছে কয়জনার?

তারপরও পদ্মাবতী বিতর্ককে পার্লামেন্টে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন অভিনেত্রী জয়া বচ্চন। সিনেমাটি তৈরির সময় রাজস্থানে বানসালি লাঞ্ছিত হওয়ার পরই তা পার্লামেন্টে উত্থাপন করেন জয়া বচ্চন। আগামী ১৬ ডিসেম্বর শুরু হতে যাওয়া শীতকালীন অধিবেশনে তিনি বিষয়টি আরো শক্তভাবে উপস্থাপন করবেন। পার্লামেন্টে বলিউডের অন্য সদস্যরা তাঁকে সমর্থন করবেন বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।

দীপিকা পাড়ুকন, শহিদ কাপুর ও রণবীর সিংয়ের মতো হাই প্রোফাইল পারফর্মারদের নিয়ে ২০০ কোটি টাকা বাজেটের এই ছবি মুক্তির মাধ্যমে শিল্পীর স্বাধীনতা সমুন্বত রাখা যাবে নাকি মুক্তমত দমনে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ব্যবহৃত হবে- এমনটাই এখন চলচ্চিত্রটির ভবিতব্য। আমরা এর আগে সাহিত্যনির্ভর ‘দেবদাস’ বা ইতিহাস নির্ভর ‘যোধা আকবর’ ছবিও দেখেছি। বিতর্ক সেখানেও ছিল। কিন্তু পদ্মাবতীর মতো হুলস্থূল কাণ্ড এর আগে ঘটেছে এমনটা দেখা যায়নি। কথাসিহিত্যিক বা চিত্রনাট্যকার যখন ইতিহাসনির্ভর গল্প লিখেন সবক্ষেত্রেই যে তিনি ইতিহাসের প্রতি অনুপুঙ্খ থাকতে পারেন বা থাকতে বাধ্য এমন নয়। সমাজ ও মানবীয় সভ্যতার প্রতি দায়বদ্ধ শিল্পী তাঁর মনের শিল্পভাবনাটা প্রকাশ করবার অধিকার রাখেন। একজন উগ্রবাদী এবং শিল্প সম্পর্কে অজ্ঞেয় ব্যক্তির চেয়ে ইতিহাসের প্রতি দায় প্রকাশ করবার সক্ষমতা নিশ্চিতই একজন শিল্পীর বেশি থাকে।

সঞ্জয়লীলা বানসালিদের মতো তেমন শিল্পীর মত প্রকাশ করবার স্বাধীনতাকে দমন করা মানে সভ্যতার পথকে রুদ্ধ করে দেওয়া। ভারতরাষ্ট্রকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এ কালের চলচ্চিত্র ‘পদ্মাবতী’কে মুক্তি দিয়ে উত্তরাধুনিক সভ্যতাকে স্বাগত জানাবে, নাকি তারা মধ্যযুগের অন্ধকার ইতিহাসে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে।

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন