১৯৭১

স্বাধীনচেতা দুরন্ত এক তরুণ টিটো

Looks like you've blocked notifications!

স্বাধীনচেতা দুরন্ত এক তরুণের নাম টিটো। স্কুলের গণ্ডি পেরুবার আগেই  গোলাম মোহাম্মদ দস্তোগীর টিটো অংশ নিয়েছিলেন জানবাজি লড়াইয়ে,পাক হানাদার নিধনে। বিজয় তখন নিশ্চিত, অপেক্ষা শুধু চূড়ান্ত বিজয়ের ক্ষণগণনার। তারিখটা ছিল ১৪ ডিসেম্বর। সাভার ডেইরিফার্ম এলাকায় মরণপণ লড়াইয়ে  সাহসী এই যোদ্ধা নিজের নামটা তুলে দিলেন শহীদের স্বর্ণফলকে। শত্রুর বুলেটে নিভে গেল তাঁর হিরন্ময়প্রাণ ।

ক্ষণজন্মা এই মানুষটি জন্মেছিলেন  মানিকগঞ্জ শহরের সেওতা গ্রামে। প্রগতিশীল, আজন্মসংগ্রামী এক পরিবারে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এমন পরিবার দুর্লভ। দুর্লভ এজন্য যে,একই পরিবার থেকে শাহাদাৎ বরণ করেছেন দুই ভাই,টিটো,তোজো। যুদ্ধে যাবার মতো বয়স হয়েছে অথচ যুদ্ধে যাননি টিটোদের পরিবারে এমন একজন মানুষও ছিলেন না।

টিটোর বাবা গোলাম মোস্তফা ছিলেন তৎকালীন মহকুমা শহরের সুপরিচিত,শ্রদ্ধেয় একজন মানুষ। বামধারার রাজনীতি করে পাকিস্তান সরকারের কোপানলে পড়েছেন বহুবার, কিন্তু আদর্শচ্যুত হননি।  টিটোর চাচা গোলাম মর্তুজাও ছিলেন স্বাধীনচেতা, আদর্শবাদী সংগ্রামী এক মানুষ।   

গোলাম মোস্তফা এবং গোলাম মর্তুজা, এই দুই ভাইয়ের একান্নবর্তী পরিবারকে আলোকিত করে জন্মেছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনন্য সেনানীরা। আপন এবং চাচাতো ভাইয়েরা মিলে টিটোরা ছিলেন ১১ ভাই ১ বোন। ভাই-বোনদের মাঝে জি এম জাহাঙ্গীর, জি এম আলমগীর, জি এম শাহ্গীর, গোলাম কিবরিয়া তজু, জি এম মোস্তাকিম হিটো (সাবেক প্রাক্তন সচিব) , জি এম দস্তগীর টিটো, জি এম বন্দেগীর লিটো এবং বড় বোন সামসুন্নাহার ছায়া মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন।

জি এম সগীর কুটু, জিএম রাহ্গীর বিল্টু, গোলাম শামীম লাবু বয়েসে ছোট ছিলেন বলে অস্ত্রহাতে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করতে পারেননি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধটা বুঝতেন। তাই ঘরে বসে সময়ও কাটাননি। যুদ্ধকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন মানিকগঞ্জ শহরে অবস্থানরত পাকবাহিনীর নানা খবরাখবর। পথ দেখিয়ে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়েছেন পথ হারিয়ে ফেলা মুক্তিযোদ্ধাদের। 

টিটোর স্কুলজীবনের বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ইকবাল হোসেন খান তাঁর এই শহীদ বন্ধুর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমরা একসাথে মানিকগঞ্জ মডেল হাইস্কুলে পড়েছি। আমাদের ব্যাচের মধ্যে টিটো ছিল অসম্ভব দুরন্ত এক তরুণ, এক কথায় ডানপিটে। বিরল এক সরল মন ছিল তার। সেই সাথে ছিল অদ্ভুত রকমের এক সাহসী, প্রতিবাদী মন। আমরা এক সাথে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছি, ফুটবল খেলেছি। খুব ভালো খেলত টিটো। ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পরই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার। এরপর আর টিটোর সাথে দেখা হয়নি। আমরা  বিচ্ছিন্ন ভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যাই।’

টিটোর সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম স্বপন তাঁর লেখা ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনযাপন’ গ্রন্থে শহীদ টিটো সম্পর্কে লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের জন্য সীমান্ত পেরিয়ে আসার পরই তাঁর সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় হয় টিটোর। এরপর থেকে তাঁরা একই সাথে শেষ দিন পর্যন্ত যুদ্ধের সময় পার করেছেন। শফিকুল ইসলাম স্বপন তাঁর গ্রন্থে সাভারের কাছে শিমুলিয়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে টিটোর সক্রিয় ভূমিকার কথা গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন।

গোলাম দস্তগীর টিটো বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর কমান্ডে থেকে বিভিন্ন রণাঙ্গণে অসীম সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছেন। টিটোর শেষ লড়াইটি ছিল ১৪ ডিসেম্বর, সাভারের ডেইরি ফার্ম এলাকা সংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী দেশের সব রণাঙ্গণে পর্যুদস্ত হয়ে রাজধানী ঢাকার দিকে পালিয়ে আসছিল। নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা এমন একটি সুসজ্জিত বাহিনীকে ডেইরিফার্ম এলাকায় প্রতিরোধ করেন। শুরু হয় মুখোমুখি প্রচণ্ড লড়াই।  অসীম সাহসিকতার সাথে এই লড়াইয়ে অংশ নেন টিটো। যুদ্ধের একপর্যায়ে থেমে যায় হানাদার বাহিনীর গোলাগুলি। ঠিক সেই সময় পাকবাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত ভেবে বাঙ্কার ছেড়ে বাইরে আসেন তরুণ টিটো। অস্ত্র উঁচিয়ে জয়বাংলা স্লোগান দিতে থাকেন । ঠিক সেই সময়ই হানাদার বাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে লুটিয়ে পড়েন টকবগে তরুণ এই মুক্তিযোদ্ধা। নিভে যায় নক্ষত্রসম এক জীবনবাতি।

ঢাকা আরিচা মহাসড়ক সংলগ্ন সেই স্থানেই তাঁকে সমাহিত করেন সহযোদ্ধারা। যেখানে ‘টিটোর স্বাধীনতা’ নামে নির্মিত হয়েছে টিটোর সমাধিসৌধ।

সাবেক সচিব, বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তাকিম হিটোর সন্তান এবং শহীদ টিটোর ভাতিজা, বিডি নিউজ২৪-এর সিনিয়র রিপোর্টার,গোলাম মুজতবা ধ্রুব অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই বলেন, তাঁদের পরিবারের পূর্বজেরা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে আত্মোৎসর্গ করা থেকে শুরু করে যে অসামান্য অবদান রেখেছেন তার যথার্থ মূল্যায়ন আজও হয়নি। এমন কি শহীদ টিটো, শহীদ তোজো চাচার নামে মানিকগঞ্জ শহরে যে দুটো সড়কের নামকরণ করা হয়েছে সে সড়কের নামফলকগুলো নানা ধরনের পোস্টার, আগাছায় প্রায় সারা বছরই ঢেকে থাকে। এই শহীদ পরিবারের বাস্তুভিটার পাশ দিয়ে ডিস্ট্রিক বোর্ডের যে রাস্তাটি চলে গেছে তা আজও সংস্কার করা হয়নি। এ রাস্তায় আজ রিকশাও চলে না। এই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারটির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য হলেও রাস্তাটির সংস্কার জরুরি, জরুরি নাম ফলকগুলোকে দৃষ্টগ্রাহ্য অবস্থায় রাখা।

তথ্যসূত্র :

১. গোলাম মুজতবা শহীদ টিটোর ভাতিজা, বিডিনিউজ২৪-এর সিনিয়র রিপোর্টার, ।

২. মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম স্বপনের লেখা ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনযাপন’