১৯৭১

অকুতোভয় শিক্ষক শহীদ হবিবুর রহমান

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে উৎসর্গিত প্রাণ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ শহীদ হবিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানি সামরিক জিপ এই শিক্ষককে তুলে নিয়ে যায়। এরপর তাঁকে আর আমরা ফেরত পাইনি।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মম ও পাশবিক হত্যাযজ্ঞ চালায় ঢাকা শহরে। পাক-সেনাদের বর্বরতার এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ভয় আর আতঙ্কে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয় তৎকালীন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ খবর পৌঁছুতেই শিক্ষক, কর্মচারীসহ অনেক সাধারণ মানুষ দলে দলে চলে যেতে থাকেন নিরাপদ আশ্রয়ে। কিন্তু তখনো রয়ে গিয়েছিলেন হাতেগোনা যে কয়জন ব্যক্তি, তাঁদের মধ্যে একজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক হবিবুর রহমান। তাঁর সহকর্মী, বন্ধু এবং পরিচিত অনেকে তাঁকে সে সময় অনুরোধ করেন তাঁদের সঙ্গে চলে যেতে। কিন্তু সবার অনুরোধ হবিবুর রহমান উপেক্ষা করেন দিশেহারা-সংকটাপন্ন সাধারণ মানুষের কথা ভেবে। ২৬ মার্চ ভোররাতের দিকে পাক-সেনারা ঢুকে পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।

শিক্ষকদের আবাসিক ভবনের অনেক বাসাই তখন খালি ছিল। শহীদ হবিবুর রহমান সপরিবারে রয়ে গিয়েছিলেন যে বাসায়, সেই 'প-১৯/বি' নম্বর বাসাটিতে তখনও উড়ছিল কালো পতাকা। এ নিয়ে তাঁর উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয় পাক-সেনাদের সঙ্গে। পরে সৈন্যরা নিজেরাই জোর করে পতাকা নামায়। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের খালি বাসাগুলোতে লুটতরাজ করা শুরু করে পাকিস্তানি সেনারা। হবিবুর রহমান তখন সামনাসামনি গিয়ে তাদের এই ঘৃণ্য কর্মে বাধা দেন এবং অত্যন্ত কঠোর ভাষায় তাদের সমালোচনা করেন। সেনাদের সঙ্গে উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা হয় এই ব্যাপারেও। পাক-সেনারা পরে প্রস্থান করেছিল হবিবুর রহমানের প্রতি একটা ক্ষোভ নিয়ে। ১২ এপ্রিল আরো কয়েকজন শিক্ষকের একটি দল ক্যাম্পাস ত্যাগ করে যাওয়ার সময় তাঁকেও সঙ্গে যেতে অনুরোধ করলে হবিবুর রহমানের জবাব ছিল : 'Like the captain of a ship I shall be the last to leave'।

২৫ মার্চের পরে ইপিআর বাহিনীর একটা অংশ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিল প্রতিরক্ষা শক্তি হিসেবে। তাঁদের জন্য খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করা হতো হবিবুর রহমানের বাড়ি থেকেই। স্ত্রী ওয়াহিদা রহমান নিজ হাতে শত শত রুটি বানাতেন তাঁদের জন্য। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গেও হবিবুর রহমান নিয়মিত যোগাযোগ করতেন এবং তাঁদের বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন। ২৬ মার্চের পরে ইপিআর সদস্যদের হাত থেকে বাঁচার জন্য পাশের বাসার দুই জন অবাঙালি অধ্যাপক সপরিবারে আশ্রয় চান হবিবুর রহমানের বাসায়। নিজের স্বভাবজাত সরল বিশ্বাসেই সেদিন সহকর্মীদের নিজ বাসায় আশ্রয় দেন হবিবুর রহমান।

এপ্রিলের ১৩/১৪ তারিখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বিতীয়বারের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। এর পরপরই হবিবুর রহমানের বাসায় আশ্রয় নেওয়া দুই অবাঙালি অধ্যাপক সপরিবারে বের হয়ে চলে যায় এবং পাক-বাহিনীকে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে তাদের জঘন্য কর্মকাণ্ডে সাহায্য করে। যতদূর জানা যায়, পাক সেনারা দ্বিতীয়বার ক্যাম্পাসে গেলে হবিবুর রহমান তাদের কাছে সেনাসদস্যদের অসদাচরণের কথা তুলে ধরেন। তখন ক্যাম্পে গিয়ে অভিযোগ দায়েরের কথা বলে পাক বাহিনী তাদের পূর্বের জমানো ক্ষোভ এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে হবিবুর রহমানকে ধরে নিয়ে গিয়ে জুবেরী ভবনে তাদের ক্যাম্পে রাখে। পাক-সেনাদের হীন ও জঘন্য কর্মকাণ্ডকে ভালো হিসেবে তুলে ধরে তারা একটি চিঠি লিখে দিতে বলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় এই শিক্ষককে। কিন্তু তাদের এই ঘৃণ্য প্রস্তাবে রাজি হননি হবিবুর রহমান। সম্ভবত সেদিনই তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে বর্বর পশুর দল।

সাধারণ মানুষের কথা ভেবে যিনি চরম বিপদের সময় সুযোগ পেয়েও নিরাপদ স্থানে চলে যাননি। অনেক অবাঙালি অধ্যাপকের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন যিনি নিজের কর্তব্যবোধ থেকে, বর্বর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাতে তাঁকেই দিতে হলো নিজের প্রাণটি। তাঁর ছোট দুই মেয়ে ঊষা ও ঊর্মি তখন সদ্য স্কুলে যেতে শুরু করেছে। বাবার এভাবে হারিয়ে যাওয়াকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি তারা। বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া আর হয় না তাদের। জুবেরী ভবনের আশপাশে তারা খুঁজে বেড়াত তাদের শহীদ বাবাকে। বড়দের কেউ বাবাকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিচ্ছে না, এই নিয়ে তাদের ছিল অনেক অভিমান। ডাকঘরের পিয়ন একদিন জানালেন এ বাসার বাচ্চারা কী সব কাগজ ডাকবাক্সে ফেলে যায়, কাগজে লেখা 'বাবা তুমি ফিরে এসো'।

শহীদ হবিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯২১ সালের ১লা জানুয়ারি নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার বালিয়াধার গ্রামে এক সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমান পরিবারে। পিতা মৌলবি কলিম উদ্দিন ভূঁইয়া ও মাতা সিদ্দীকা খাতুনের ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে হবিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয় সন্তান। পিতার পেশা ছিল মূলত কৃষিকাজ। নিজের অনেক বিষয়-সম্পত্তি সহযোগে সংসারে সচ্ছলতা বজায় রেখেছিলেন কলিম উদ্দিন ভূঁইয়া। হবিবুর রহমানকে ৩/৪ বছরের শিশু অবস্থায় রেখে পরলোকগমন করেন মাতা সিদ্দীকা খাতুন। সন্তানদের লালন-পালনের জন্য দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেন কলিম উদ্দিন ভূঁইয়া। দ্বিতীয় স্ত্রী আছিয়া খাতুনের নিজের গর্ভজাত কোনো সন্তান না থাকলেও পরিবারের ছয় সন্তানকে নিজের ছেলেমেয়ের মতোই আদর-ভালোবাসায় বড় করেন তিনি। ছেলেমেয়েরাও তাদের মা বলতে জানত আছিয়া খাতুনকেই। ১৯৫৬ সালে কলিম উদ্দিন সাহেব মারা যান।

নোয়াখালী জেলার প্রত্যন্ত বালিয়াধার গ্রামটিতেই শৈশবের দিনগুলো কেটেছে হবিবুর রহমানের। গ্রামে পড়াশুনার প্রচলন তেমন ছিল না। হবিবুর রহমানও শৈশবে পারিবারিক ধর্মীয় পরিবেশে ধর্মীয় জ্ঞান এবং আরবি শিক্ষা লাভ করেন। তাঁর বড় ভাই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। আরবি শিক্ষার পাশাপাশি ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন তিনি। অত্যন্ত প্রতিবাদী ও বিপ্লবী ছিলেন তিনি। সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করতে। বাবার জমিজমা গ্রামের প্রভাবশালী লোকজন জবরদখল করতে গেলে তাদেরকে বাধা দিতে গিয়ে সেই লোকদের হাতেই প্রাণ দিতে হয় তাঁকে। অত্যন্ত সরল মনের মানুষ পিতা কলিম উদ্দিন ভূঁইয়া ছেলের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেননি। বড় ভাইয়ের মতো হবিবুর রহমানও শুধু আরবি শিক্ষা নিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি। পড়াশোনার প্রতি তাঁর অদম্য আগ্রহ ছিল সেই ছোটবেলা থেকেই।

মেধাবী বড় ভাইয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুও তাঁকে অনেকটা পরিচালিত করেছিল পড়াশোনার প্রতি। নিজের ইচ্ছায় বালিয়াধার গ্রাম থেকে পাশ্ববর্তী কয়েকটা গ্রামের পরে বটগ্রামের কাছে অবস্থিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। প্রতিদিন দেড়-দুই মাইল পথ পায়ে হেঁটে সেই বিদ্যালয়ে পড়তে যেতেন হবিবুর রহমান। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকতেই তাঁর অসাধারণ মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি সেসময় পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি লাভ করেন। স্কুলজীবনের বৃত্তির অর্থ এবং ছাত্র পড়িয়েই নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতেন তিনি। তাঁর অন্য ভাইবোনেরা বেশিদূর পড়াশোনা করেননি। কিন্তু নিজের অদম্য আগ্রহ ও অধ্যবসায়ের জন্য অজপাড়া গাঁ থেকে হবিবুর রহমান উঠে এসেছিলেন উচ্চশিক্ষার শিখরে।

প্রাথমিক শিক্ষা শেষে হবিবুর রহমান ভর্তি হন নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার তৎকালীন নামকরা 'দত্তপাড়া' উচ্চ বিদ্যালয়ে। এই স্কুল থেকেই ১৯৩৮ সালে পাঁচটি বিষয়ে লেটারসহ স্টার মার্ক পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন তিনি। সেই সময়ে পাঁচ বিষয়ে লেটার পাওয়ার ঘটনা ছিল বিরল। ম্যাট্রিক পাস করার পর হবিবুর রহমান ভর্তি হন উপমহাদেশের তৎকালীন অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। এই কলেজ থেকে তিনি ১৯৪০ সালে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাস করেন এবং একই বছরে ভর্তি হন কলকাতার প্রসিদ্ধ প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিত বিভাগে বিএসসি অনার্স শ্রেণিতে। তিনি ১৯৪৩ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন এই কলেজ থেকে। এরপর তিনি এমএসসি শ্রেণিতে ভর্তি হন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৬ সালে তিনি আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রেকর্ড নম্বরসহ গণিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর এই অসাধারণ ফলাফলে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ও প্রখ্যাত গণিতবিশারদ স্যার জিয়াউদ্দীন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হকের নিকট হবিবুর রহমানকে স্টেট স্কলারশিপ ও চাকরি দেওয়ার জন্য বিশেষ সুপারিশ করে পত্র দেন। এমএসসি ডিগ্রি লাভ করার পর একই বছরে হবিবুর রহমান কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতের প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। এর কিছুদিন পরেই তিনি বদলি হন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে, আরও পরে বদলি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সেখানেই সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করেন তিনি।

১৯৫৪ সালের নভেম্বরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। '৫৪ সালেই তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত শাস্ত্রে ট্রাইপস ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের রিডার পদে উন্নীত হন তিনি। ১৯৬২ সালে তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন এবং ফলিত গণিতের বিভিন্ন উচ্চতর বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ফিরে এসে ১৯৬৪ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এ দায়িত্ব পালন করেন। পরের বছর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ আমীর আলী হলের প্রাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।

১৯৭০ সালে তিনি পুনরায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। '৭১-এর ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে শহীদ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ পদেই নিয়োজিত ছিলেন তিনি। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন হবিবুর রহমান বিয়ে করেন এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের কন্যা ওয়াহিদা রহমানকে। তাঁদের ছেলে মো. খায়রুল এনাম ও আনিসুর রহমান এবং মেয়েরা রোক্সানা রাজ্জাক, শারমীন রহমান চৌধুরী, নাসরিন রহমান মোল্লা ও মোনালিসা হাসান।

সততা, আদর্শ, মূল্যবোধ ও নিয়মনিষ্ঠতার সমন্বয়ে নিজেকে একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে গঠন করেছিলেন হবিবুর রহমান। মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় স্থানীয় হিন্দুদের নিরাপদ এলাকায় স্থানান্তরিত করার কাজে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেছিলেন হবিবুর রহমান।

'৫০-এ ঢাকায় হিন্দুবিরোধী দাঙ্গার সময়ও হবিবুর রহমান অনেক হুমকির মুখে এগিয়ে এসেছিলেন দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে এবং সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। চরম বিপদের মধ্যেও ধীরস্থিরভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারতেন তিনি। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহাকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এর প্রতিবাদে পরিচালিত বিক্ষোভ মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হবিবুর রহমান। তাঁর সুপরিকল্পিত নির্দেশনাতেই ড. জোহার মৃত্যুর পর আহত-নিহতদের খোঁজখবর নেয়ার কাজটি সুসম্পন্ন হয়েছিল।

যেকোনো পরিস্থিতিতে সত্য ও ন্যায়ের পথে অটল থাকতেন হবিবুর রহমান। সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করতেন তিনি, কারো কাজ পছন্দ না হলে তার সামনেই স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতেন নিজের অসন্তুষ্টির কথা।

সহকর্মী ও সাধারণের সঙ্গে হবিবুর রহমানের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল। সদালাপী এবং সকলের সঙ্গে মিশুক একজন মানুষ ছিলেন তিনি। সহকর্মী ও পরিচিতজনদের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় 'হাবিব ভাই'।

গণিত বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন হবিবুর রহমান। শহীদ হবিবুর রহমানের স্মৃতিকে ধরে রাখতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে 'শহীদ হবিবুর রহমান হল'। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সম্মানিত করেছে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে।

কর্মক্ষেত্রের একজন অকুতোভয় আদর্শবান শিক্ষক, পাকিস্তানি শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সব সময়ের সোচ্চার ব্যক্তিত্ব এবং পরিবারের সবার প্রিয় মানুষ হবিবুর রহমান জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের। তাঁর অটুট বিশ্বাস ছিল বাংলার সাধারণ মানুষের স্বাধীনতায় ও মুক্তিতে। পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর বুলেটের সামনে উন্নত শিরে শাহাদাত বরণ করে তিনি তাঁর সেই সাহসী ও গভীর আত্মবিশ্বাসের জানান দিয়েছিলেন। শহীদ হবিবুর রহমানের আমৃত্যু স্বপ্ন ও বিশ্বাসকে যথাযথ সম্মান জানাতে পারবে কেবল স্বাধীন বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের নির্বিঘ্নে জীবন এবং সমাজের সর্বস্তরে সত্য, আদর্শ ও ন্যায়নীতির মহিমান্বিত প্রতিষ্ঠা।

তথ্যসূত্র :

১। শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ; বাংলা একাডেমি; ১৯৯৪।

২। শহীদ হবিবুর রহমানের সংক্ষিপ্ত জীবনী; শহীদ হবিবুর রহমান হল; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; ২০০৭।

৩। www.gunijan.org.bd