রোহিঙ্গা সংকট

শরণার্থীরা কি মিয়ানমারে ফিরবে?

Looks like you've blocked notifications!

রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে গত ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ যে সমঝোতা (পরে যেটিকে সরকারের তরফে বলা হয় ‘অ্যারেঞ্জমেন্ট’) করেছে, তার ফলে সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে অনেকে আলো দেখার চেষ্টা করছেন। ভাবছেন, রাখাইনে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা তাঁদের নিজভূমে ফিরতে পারবেন।

কিন্তু আসলেই সেটি হবে কি না বা হলেও শেষমেশ কতজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফেরত নেবে এবং এই প্রক্রিয়া শেষ হতে কত দিন লাগবে, তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ রয়েছে। এই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন খোদ অর্থমন্ত্রীও। সন্দেহ এ কারণে যে, মিয়ানমারের সঙ্গে ওই সমঝোতা বা অ্যারেঞ্জমেন্টে যেসব শর্ত রয়েছে, তা কতটা বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করছে––সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুটা ক্ষেপে গিয়ে বলেছেন, দেশের স্বার্থ ঠিক করে সরকার। 

‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’––এই পররাষ্ট্রনীতির কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধে জড়াতে চায় না। আবার যেহেতু মিয়ানমারের সঙ্গে পরাক্রমশালী চীন ও রাশিয়া প্রত্যক্ষভাবে আছে এবং এই ইস্যুতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বন্ধু বলে বিবেচিত ভারতের ভূমিকাও মাঝামাঝি, ফলে বাংলাদেশকে বেশ কৌশলেই এগোতে হচ্ছে। একদিকে মানবিক কারণে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়া এবং এর ফলে পরিবেশ, অর্থনীতি, জীববৈচিত্র্যের সমূহ ক্ষতি মেনে নেওয়া; এখন আবার আশ্রিতদের ফেরত পাঠানোর ইস্যুতে মানবিক কূটনীতি––সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এক জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি।

তবে যে ইস্যুটি সামনে আসছে না, তা হলো––ধরা যাক ওই সমঝোতার আলোকে শিগগিরিই একটি  চুক্তি হলো এবং ধীরে ধীরে অনেক রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফেরত নিল, কিন্তু এই মানুষগুলোকে আশ্রয় দেওয়ার ফলে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ এলাকার যে হাজার কোটি টাকার বনভূমি, পরিবেশ, প্রতিবেশ, হাতির আবাসস্থল ধ্বংস হলো, দেশের অর্থনীতি এবং স্থানীয় জনসাধারণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল তার ক্ষতিপূরণ কীভাবে হবে? মিয়ানমার যদি রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ও, তারা বাংলাদেশের এই অর্থনীতি, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও স্থানীয় জনসাধারণকে ক্ষতিপূরণ দেবে কি না? কেননা, এই ক্ষতির জন্য তারাই দায়ী। তাদের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার ফলেই এসব ক্ষতি হয়েছে এবং রোহিঙ্গা সংকট সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশ যেহেতু কোনোভাবেই দায়ী নয়, সুতরাং যৌক্তিক কারণেই মিয়ানমারের কাছ থেকে এর ক্ষতিপূরণ আদায় করা উচিত। প্রয়োজনে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।

বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে হওয়া সমঝোতায় বলা হয়েছে, ৯ অক্টোবর ২০১৬ এবং ২৫ আগস্ট ২০১৭-এর পরে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় বাস্তুচ্যুত রাখাইন রাজ্যের অধিবাসীদের (মিয়ানমার রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করে না) মিয়ানমার ফেরত নেবে। দলিল স্বাক্ষরের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে।

তবে মূল ফাঁকিবাজিটা অন্য জায়গায়। তা হলো, প্রত্যাবাসনকারীদের নাগরিকত্ব পরিচয় যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে। প্রক্রিয়ায় জটিলতা দেখা দিলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করবে। এ ক্ষেত্রে ১৯৯২-পরবর্তী প্রত্যাবাসন চুক্তি যাচাই প্রক্রিয়ার আদর্শ হিসেবে ধরা হবে। ২৪ নভেম্বর মিয়ানমার টাইমসের খবরে বলা হয়েছে : The official said that applications forms will be sent to Bangladesh for the refugees to fill up with their personal details and the completed forms will be returned to Myanmar for verification. “If these (personal details) are all right, the repatriation would be arranged immediately. অর্থাৎ মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য আবেদন ফরম পাঠাবে এবং সেখানে তারা নিজেদের সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্য দেবে। সেই তথ্য যাচাই-বাছাইয়ে যাঁরা সঠিক বলে প্রমাণিত হবেন, তাঁদেরই ফেরত নেওয়া হবে। দেশটির সরকার এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য অনেক নতুন গ্রাম তৈরি করেছে বলেও খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। তার মানে হলো, নাগরিকত্ব পরিচয় যাচাইয়ের নামে মিয়ানমার কালক্ষেপণ করবে এবং সামান্য কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গাকে হয়তো তারা ফেরত নেবে। কিন্তু বিশালসংখ্যক রোহিঙ্গার বোঝা হয়তো বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন এবং এর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গা, বিশেষ করে যারা নানাভাবে বাংলাদেশের মূল স্রোতধারায় মিশে যাবে (অতীতে যা হয়েছে), তাদের বোঝা বইতে হবে আজীবন।

দেখা যাচ্ছে, দুদেশের সরকারের মধ্যে হওয়া সমঝোতায় শুধু স্বেচ্ছায় মিয়ানমার ফিরতে আগ্রহী প্রত্যাবাসনকারীরা এই সমঝোতার আওতাধীন এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় জন্ম নেওয়া (রাখাইনে ধর্ষণের কারণে) শিশুদেরকে বাংলাদেশের আদালতের মাধ্যমে প্রত্যায়িত (সার্টিফাই) করতে হবে বলে যে শর্ত যুক্ত করা হয়েছে, সেটিও রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াকে জটিল এবং কখনো কখনো অসম্ভব করে তুলতে পারে। তবে ধারণা করা যায় এবং সরকারের কথায়ও এটি মোটামুটি আন্দাজ করা যায় যে, মিয়ানমার যেহেতু রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে রাজি হয়েছে, তাতে শর্ত যা-ই হোক, তাতেই সরকার আপাতত খুশি।

এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, যদি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা স্বীকার করা না হয়, তাহলে সেখানে ফের সহিংসতা শুরু হবে এবং দলে দলে তারা আবারও বাংলাদেশ পালিয়ে আসতে শুরু করবে। বাংলাদেশ আবারও মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিতে থাকবে, বিশ্ব জনমত বাংলাদেশকে বাহবা দেবে এবং নানাবিধ চাপে পড়ে মিয়ানমার কোনো একটা সমঝোতা কিংবা চুক্তি করে কিছু রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেবে। অর্থাৎ এই ইঁদুর- বিড়াল খেলা চলতেই থাকবে।

সুতরাং রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য যেটি সবচেয়ে বেশি জরুরি  তা হলো মিয়ানমারে তাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা, সেটি দেশটির সরকার দেবে না। তাদের পূর্ণ মানবাধিকার স্বীকার করবে না; তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতাও নিশ্চিত করবে না। ফলে এখানে হস্তক্ষেপ করতে হবে জাতিসংঘকে। তারা মিয়ানমারের রাখাইনে অথবা অন্য কোনো স্থানে রোহিঙ্গাদের জন্য সেফ জোন বা নিরাপদ এলাকা তৈরি করে সেখানে শান্তিরক্ষী মিশনের সদস্যদের দায়িত্ব দিতে পারে বলে মত এসেছে। কিন্তু মিয়ানমার এই শর্তও পুরোপুরি মানবে কি না সন্দেহ। ফলে সমাধান চীন ও রাশিয়ার হাতে। অর্থাৎ মানবাধিকারের প্রশ্নে চীন ও রাশিয়া যদি মিয়ানমারের পক্ষ ত্যাগ করে, তাহলে রোহিঙ্গা সংকট দ্রুতই সমাধান হতে পারে। কেননা, মিয়ানমারের সকল মাস্তানির উৎস এ দুটি দেশ।

রোহিঙ্গা সংকটের মূল কারণ জাতিগত বিদ্বেষ। সুতরাং যত দিন না মিয়ানমারের সরকার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা তাদের দেশে থাকা অন্য ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে সহনশীল ও শ্রদ্ধাশীল না হচ্ছে, তত দিন এই সংকট চলবেই। আন্তর্জাতিক চাপে কিছুদিন সহিংসতা বন্ধ থাকবে, পুনরায় শুরু হবে। আবার রাখাইনের মতো আপাতবিচ্ছিন্ন অঞ্চলে যেহেতু মূলধারার গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও খুব সক্রিয় নয়, ফলে সেখানে নীরব নির্যাতন চলতে থাকলেও তার খবর বিশ্ব জানবে না। সুতরাং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের মূল শর্ত হচ্ছে সে দেশের সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সুমতি। এই সদিচ্ছা ও সুমতি না ফেরা পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত এই জাতিগোষ্ঠীর করুণ ইতিহাস প্রলম্বিতই হতে থাকবে। পোপ ফ্রান্সিস মিয়ানমারে গিয়ে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ করলেন কি করলেন না, কিংবা বাংলাদেশে এসে শব্দটিকে কত কায়দা করে উচ্চারণ করলেন, তা দিয়ে এই সংকটের অন্ধকার সুড়ঙ্গে আলো জ্বালবার কোনো সুযোগ নেই।

লেখক : সাংবাদিক