শীতের মায়াবী আবেশ

Looks like you've blocked notifications!

ষড়ঋতুর দেশ বলেই পরিচিত সুজলা-সুফলা এই দেশ। ছয়টি ঋতুর মধ্যে চারটির সঙ্গে আমাদের নিবিড় সম্পর্ক। প্রতিটি ঋতুই তার ভিন্ন ভিন্ন রূপে, সৌন্দর্যে, বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। এর মধ্যে শীত আমাদের কাছে হাজির হয় সম্পূর্ণ নতুন ও ভিন্ন আবেশে।
 
হেমন্তের বিদায়ের পর পরই হিম হিম হাওয়া ও কুয়াশার চাদর গায়ে আগমন হয় শীতের। শীতের আগমনবার্তা নিয়ে প্রকৃতিও সাজে নতুন রূপে। এর সঙ্গে রয়েছে ঘাসের কোণে সকালবেলার সোনালি শিশির বিন্দু, সরিষা ফুলের মাঠ আর সারি সারি খেজুরের গাছে রস সংগ্রহের মাটির কলস। ঠিক যেন গাঁয়ের বধূর কলশী কাঁখে পানি বয়ে নিয়ে আসার যে সৌন্দর্য়ের প্রতিরূপ। এ সবই প্রকৃতির এক অপার সৌন্দর্য। শীতের সকালে যে দিকেই চোখ যায়, সবখানে যেন কোমলতা, স্নিগ্ধতা, আর সুরের আবহ যা মনকে আবেগ-অনুভূতিতে ভরিয়ে তোলে।

বাংলায় পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস প্রধানত শীতকাল। শীতের কয়েক দিনের তীব্র ঠান্ডার পীড়া বাদ দিলে শ্রেষ্ঠ ঋতুর খেতাব পাওয়ার বড় দাবিদার এই শীতকালই। কেননা নতুন ধান, মাছ, শাক-সবজি, খেজুরের রস অন্য ঋতুতে ভাবাই দুরূহ ব্যাপার। শীত আসতে না আসতেই সমগ্র প্রকৃতিতে শুরু হয় কাঁপন।

এ নিয়ে রবিঠাকুর বলেছিলেন-

 ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে
পাতাগুলি শির শিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে’
শীত মানেই প্রকৃতির নবরূপ আর কুয়াশার নাচন। উত্তর শীতল হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ঘটে গাছপালা ও নদ-নদীগুলোর। কনকনে শীতের প্রকোপে গাছপালাগুলো হয়ে ওঠে পাতাহীন নগ্ন, নদ-নদী হারায় তার স্রোতের তীব্রতা—যেন এরাও শীতকে বরণ করে নিয়েছে। শীতের সকালে সবুজ ঘাসে, গাছের পাতায়, টিনের চালে শিশিরের সঙ্গে সূর্যালোকের যে মিতালি, এ যেন এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। শিশির ছোঁয়া রোদের আলোয় প্রকৃতি হয়ে ওঠে সতেজ। গ্রাম-গঞ্জে শীতকাল মানে গাছিদের রসের হাঁড়ি। টাটকা, ঠান্ডা খেজুরের রস। সেই খেজুরের রস আর রসের তৈরি গুড় দিয়ে শুরু হয় পিঠা-পুলির উৎসব। নানা রকম পিঠার গন্ধে সকালবেলা শুধু যে খাওয়ার আগ্রহটাই বেড়ে যায় তা নয় বরং বাড়ির আশপাশের প্রতিবেশীরাও একসঙ্গে পিঠা খাওয়ায় বন্ধনটাও থাকে অটুট।

তবে গ্রামীণ শীতকাল আর শহুরে শীতকালের মধ্যে বেশ বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। শহরবাসী ঘুমের মধ্যেই কাটিয়ে দেয় শীতের সকাল। রোদের আলোয় চিকচিক করা শিশিরভেজা ঘাস তাদের সিক্ত করতে পারে না, শোনা হয় না সরষে ক্ষেতে মুখরিত মৌমাছির গুঞ্জন, খাওয়া হয় না পাড়ার সবাই মিলে একসঙ্গে শীতের পিঠা। শহুরে মানুষগুলো শীতকে বরণ করে নানা রংবেরঙের শীতের কাপড়ের মাধ্যমে। শহরের প্রত্যেকটি শপিং মল, দোকান, ফুটপাতগুলোতে বসে বিভিন্ন শীতের পোশাকের মেলা। যেমন : কোট, জ্যাকেট, সোয়েটার, চাদর, মাফলার, টুপি ইত্যাদি। এসব পোশাক গায়ে জড়িয়ে কুয়াশাভেজা রাজপথে শুরু হয় তাদের শীতকালীন কর্মব্যস্ততা। তবে শীতের পিঠা-পুলির উৎসবের দিক থেকে পিছিয়ে নেই যান্ত্রিক শহর ঢাকা। শীত যখন আসি আসি করছে, তখন থেকেই শীতের নানা সব বাহারি পিঠায় জমে ওঠে রাস্তার মোড়, পাড়ার অলি-গলি। চিতই, ভাঁপা, পাটিসাপটার মতো হরেক রকমের পিঠার পসরা নিয়ে হাজির হয় দোকানিরা। সব শ্রেণির লোকজনের সমাগম দেখা যায় পিঠার দোকানের পাশে। বেশ তৃপ্তিসহকারে পিঠা খায় শহরবাসী। 

অন্যদিকে এ শীতই আবার অসহায়-দুঃস্থ মানুষগুলোর কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শীত তাদের কাছে ঠান্ডা রস আর পিঠা-পুলির আবেগ বা উৎসাহ নয় বরং পোশাকহীন হাড়কাঁপুনি কষ্ট। তবে আমরা যারা কিছুটা সচ্ছল, তারা যদি নিজেদের পুরোনো জামাকাপড় এবং অন্যান্য শীত নিবারণের জিনিস দিয়ে তাদের সহায়তা করি, তাহলে সবার শীতই উপভোগ্য ও আনন্দের হতে পারে। কিছু সুবিধা-অসুবিধা মিলিয়ে আমাদের এই শীতকাল। সব মিলিয়ে যেন এক অন্যরকম ভালোলাগার অনুভূতি। তাই তো কবির ভাষায়-

‘একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু’ শীতের সকালের সৌন্দর্যকে দ্যুতিময় করে তোলে।