ক্রিকেট

মাশরাফি, তোমাকে অভিবাদন

Looks like you've blocked notifications!

বিপিএলের পাঁচ আসরে চারবারই শিরোপা উঠল বাংলার বাঘেদের শিরোমনি, মাশরাফি বিন মুর্তজার হাতে। মাশরাফি মানেই যেন অজেয়কে জয় করার এক অমোঘ নেশা। একটা সময়ে পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে পড়ে যাওয়া দলকেও শিরোপা জিতিয়ে নিজেকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেলেন মাশরাফি। অধিনায়ক মাশরাফি, পেসার মাশরাফি, মারকুটে মাশরাফি আর যোদ্ধা মাশরাফিকে ছাপিয়ে এ যেন অন্য এক মাশরাফি। 

মাশরাফি নিজের যোগ্যতা দিয়ে গোটা জাতিকে এতটাই কাবু করে ফেলেছেন যে, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া- মানুষ খেলা দেখে রংপুর রাইডার্সের নয়, গেইল ম্যাককালামের নয়, একজন মাশরাফি বিন মুর্তজার দলের। ম্যাচ জেতান গেইল ম্যাককালাম আর পেরেরারা; মাঠে আওয়াজ ওঠে ‘মাশরাফি’। বাইশ গজের ক্রিজ যেখানেই হোক, ঢাকা, সিলেট কিংবা চিটাগং, মাশরাফি মানেই গ্যালারিতে সমুদ্রের গর্জন, যে গর্জনের ভাষা একটাই, স্লোগান একটাই- ‘মাশরাফি, মাশরাফি’। 

সেই মাশরাফি, যিনি রেকর্ড পরিমাণবার শুয়েছেন অপারেশনের টেবিলে, যিনি তাঁর পায়ে চলার ভবিষ্যৎকে স্রষ্টার হাতে সঁপে দিয়ে লড়াইয়ে নামেন দেশের জন্য, লাল-সবুজ পতাকার জন্য; যিনি এখনো প্রতিবার মাঠে নামার আগে, হাঁটুতে জমা পানি সূঁচ দিয়ে টেনে বের করেন। যিনি এমনকি শেষ বয়সে তাঁর দুটি পা ঠিকঠাক চলতে নাও পারে- এমন ভয়ানক কালো আশংকা মাথায় নিয়েও বোলিং লাইন আপে দৌড়ান। যিনি এখনো খেই হারানো দলের জন্য পাঞ্জেরির মতো দায়িত্ব পালন করেন।

দলের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যান রান পাচ্ছেন না? ঠিক আছে, মাশরাফি নিজেই বাঘা ব্যাটসম্যান হয়ে যান। এই কদিন আগেই তিন নম্বরে নেমে ব্যাটিংয়ে যে ঝড় তিনি তুললেন, গোটা টুর্নামেন্টেই তখন পর্যন্ত এমন ঝড় উঠেছে হাতেগোনা। 

মাশরাফি মানেই সীমাহীন প্রেরণার উৎস। গেইল, ম্যাককালামের মতো তারকা প্লেয়ার দলে থাকা সত্ত্বেও একসময়ে পয়েন্ট টেবিলের একেবারে তলানিতে পড়ে গিয়েছিল রংপুর রাইডার্স। কিন্তু কী জাদু বলেই না মাশরাফি সেখান থেকে রাইডার্সদের টেনে তোলা শুরু করলেন। শুরুটা করেছিলেন নিজের হাতেই। তিনে উঠে এসে মারকুটে ব্যাটিংয়ের প্রদর্শনী করে অন্যদের যেন বললেন, দেখ- কীভাবে ব্যাটিং করতে হয়। তারপর টানতে টানতে আশাহীন একটা দলকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে এলেন ফাইনালেই! এমন সব ‘আশ্চর্য’ উপহার দিতে পারেন কেবল মাশরাফিই। 

শেষ তিনটি ম্যাচে মাশরাফির রংপুর ভর করেছে ক্রিস গেইল, ব্রেন্ডন ম্যাককালাম আর চার্লস জনসনের ওপর। কিন্তু আগুনটা জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন মাশরাফিই। টপ ফোরে ওঠার পর ড্রেসিংরুমে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এখন সেরা চার, এখান থেকে যেকোনো কিছুই হতে পারি আমরা, এমনকি চ্যাম্পিয়নও!’ ক্রিস গেইল তাঁর বিপিএল সর্বোচ্চ ইনিংস খেলে ম্যান অব দ্য ফাইনাল হওয়ার পর বলেছেন, অনুপ্রেরণার সবটুকু তিনি নিয়েছেন মাশরাফির ওই স্পেশাল স্পিচ থেকেই। মাশরাফির নেতৃত্বে খেলে এবং চ্যাম্পিয়ন হয়ে দারুণ প্রীত বলেও জানান এই ক্যারিবীয় ব্যাটিং দানব।

মাশরাফি এভাবেই ঢুকে পড়েন অন্যের মনোজগতেও। ঢাকার মেয়র আনিসুল হক যেমন বলতেন ‘আমি’ নয়, ‘আমরা’। মাশরাফিও এই একই মন্ত্রই জপ করেন। খেলার মাঠে বৃত্তের মধ্যমণি হয়ে তিনি এটাই বলেন, ‘আমরা পারব।’ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি পারেন, তাঁর দল পারে। 

শেরেবাংলা স্টেডিয়ামকে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যেমন কুয়াশা আর নিয়ন আলো যতটা না আচ্ছন্ন করতে পেরেছে, তার চেয়ে বেশি মায়াচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন একজন মাশরাফি। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে, ঘরে ঘরে ড্রয়িং রুমে টিভি সেটের সামনে এদিন যাঁরা বসেছেন, শিরোপাটা তাঁর হাতে উঠুক এই প্রত্যাশাটা খোদ মাশরাফির চেয়েও অনেকেই বেশি করে করেছেন। মন থেকে চেয়েছেন, এই পাগলাটাই যেন শিরোপাটায় চুমু খেতে পারে!

স্টেডিয়ামের ভেতরে যারা টাকা খরচ করে গেছেন, সবার কাছে এটা যেন আগে থেকেই জানা, আজ কার হাতে উঠবে বিপিএলের শিরোপা। এর আগে তিন তিন বার যিনি এই মঞ্চে শিরোপা তুলে ধরেছিলেন, সেই মাশরাফিই আবারও সেটি তুলে ধরে জানান দিলেন, বাংলাদেশে মাশরাফি একজনই; হয়তো গোটা দুনিয়ায়ও।

ক্রিকেট দুনিয়ায় পা পা করে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন যাত্রায় আমরা প্রথম পেয়েছিলাম একজন আশার ফুলকে। যাকে ভালোবেসে বলতাম এ্যাশ। প্রায় কাছাকাছি সময়ে আমরা পেয়ে যাই এক দুরন্ত বালককে। ভালোবেসে তাকে বলি ‘ম্যাশ’। ফিক্সিং কেলেংকারিতে এ্যাশ অনেকটাই সত্যিকারের ছাই হয়ে গেলেও, ‘ম্যাশে’র আগুন যেন কখনো নেভার নয়। যে আগুন তিনি শুধু জ্বালান না, ছড়িয়ে দেন জনে জনে। মাশরাফি তাই অনন্ত অনুপ্ররেণার এক অতল আধার। যুগে যুগে মাঠে ময়দানে আর জীবনযুদ্ধে মানুষ প্রেরণা নেবে মায়াবী মাশরাফির কাছ থেকে। 

অভিনন্দন প্রিয় মাশরাফি। তোমাকে অভিবাদন জানানোতেই আমাদের যত আনন্দ। 

লেখক : সাংবাদিক, আরটিভি