শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

নির্মম মৃত্যুর করতলে আজো যাঁরা দিশারি

Looks like you've blocked notifications!

বুদ্ধিজীবীদের আদি পিতা সক্রেটিসের মৃত্যু ছিল নিষ্ঠুর, নির্মমতার মানদণ্ডে নিকৃষ্ট। যদিও তখন আধুনিক বিশ্বের মতো মধ্যবিত্ত শ্রেণি কিংবা বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা তৈরি হয়নি। তবু তিনি ছিলেন মানুষের মুক্তির দিশারী। নতুন চিন্তা আর ন্যায়ের পূজারি। জীবনাভিজ্ঞতা নিংড়ে যুক্তিবাদীতায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠা এই দার্শনিক আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দে হেমলক পান করে মৃত্যুদণ্ডকে মেনে নিয়েছিলেন। সক্রেটিসের পর যিশু খ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য ছিল নতুন ধর্মাদর্শ ও জীবনাদর্শের প্রতি চরম চপেটাঘাত। কারণ তিনিও মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন। মানবতার কথা ছিল তাঁর মুক্তির প্রধান সোপান। তারপর রাজতন্ত্রের সহস্র বছরের ইতিহাসে মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রার অগ্রণী গ্যালিলিওসহ অনেক বিজ্ঞানীকে গিলোটিনে হত্যা করা হয়েছে।

রেনেসাঁস, শিল্পবিপ্লব আর ফরাসি বিপ্লব আধুনিক মানবসভ্যতার বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু তখনো রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির দ্বন্দ্ব নিরসন হয়নি। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংলন্ডের রাজার সঙ্গে রাজনৈতিক দর্শনের ভিন্নতার কারণে মহাকবি জন মিল্টনকে জেলে যেতে হয়েছে; মৃত্যুদণ্ডের খুব কাছ থেকে ফিরে এসেছিলেন তিনি। তবে কয়েক শতাব্দী পূর্বে সৃষ্টিকর্তা প্রসঙ্গে কিংবা ইসলাম অবিশ্বাসের জন্য সুফিবাদের মরমি কবিদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল। অবশ্য এ কথা সত্য ভারতবর্ষে প্রাচীন ও মধ্যযুগে জ্ঞানী, পণ্ডিত ও কবি-সাহিত্যিকদের রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়েছিল। কৌটিল্য কিংবা কালিদাস অথবা জয়দেব এঁরা সবাই রাজসভার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যদিও এঁদের কাউকেই মতাদর্শগত কারণে ক্ষমতাবানদের দ্বারা নিষ্ঠুর মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শে আলিঙ্গনাবদ্ধ হতে হয়নি। কারণ তাঁরা ছিলেন সেই রাজা-বাদশা কিংবা রাষ্ট্রের ক্ষমতাছায়ায় লালিত বুদ্ধিজীবী। অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার বিবর্তনের ইতিহাসে প্রথম থেকেই দুই ধরনের বুদ্ধিজীবীর সাক্ষাৎ পাওয়া যাচ্ছে। একটি ধারা ছিল সক্রেটিস-গ্যালিলিও’র পথ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দাপটের বাইরে যাঁদের অবস্থান; আর অপরটি ছিল ক্ষমতাপরায়ণ ব্যক্তির ছত্রছায়ায় বর্ধিত ব্যক্তিবর্গের স্বীকৃতি- যাঁরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ না করে বেড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিলেন। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সংঘশক্তির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সক্রেটিস কিংবা গ্যালিলিওর প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন থাকলেও সেই পর্যায় তখনো তৈরি হয়নি। তাই প্রতিবাদহীন হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয় তাঁদের। 

নির্দিষ্ট সংজ্ঞা অন্বেষণ না করেও বলা যায়, বুদ্ধিজীবীরা দৈহিক শ্রমের পরিবর্তে মানসিক শ্রম বা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম  প্রদান করেন বেশি। এই শ্রেণিতে আছেন- লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পি, কণ্ঠশিল্পি, সব পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবী। এটা সত্য যে, বুদ্ধিজীবীরাই জাগিয়ে রাখেন জনতাকে, জাগ্রত করেন বিবেক, লালন করেন সকল শুভ প্রত্যয়। চিন্তাধারা ও লেখনির দ্বারা কিংবা গানের সুরে, শিক্ষালয়ে পাঠদানে, চিকিৎসা, প্রকৌশল, রাজনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের সান্নিধ্যে এসে তাঁরা আস্থার জায়গাটি তৈরি করেন। অন্যায়কে অন্যায় বলার সাহস তাঁরাই দেখাতে পারেন। এজন্য সাধারণ মানুষের কাছে বুদ্ধিজীবীরা অতি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু সামরিক জান্তা কিংবা অত্যাচারী শাসকরা সাধারণ মানুষকে উসকানির অজুহাতে বুদ্ধিজীবীদের হয়রানি করেন; সুযোগ পেলে করুণ পরিণতি ডেকে আনেন। ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত রয়েছে ভুরি ভুরি।

বুদ্ধিজীবীদের ওপর সবচেয়ে বড় এবং প্রধান আঘাত আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারি নীতির কারণে। তার দলের নেতৃত্বের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ এবং যুদ্ধের সময় নাজিবাহিনীর হত্যাকাণ্ড ছিল মেধা শূন্য করার ইতিহাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেক রাষ্ট্র হিটলারের নাজিবাহিনীর দ্বারা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের শিকার হয়। শহর আর গ্রামের পর গ্রাম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ইহুদি হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে অন্যান্য দেশের সাধারণ মানুষ করুণ পরিণতির শিকার হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পোল্যান্ডের বুদ্ধিজীবীদের অর্ধেকই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। কোনো কোনো পেশার ২০ থেকে ৫০ ভাগ সদস্য নিশ্চিহ্ন হন।

জার্মান নাজিবাহিনীর নির্মমতার শিকার হন ৫৮% আইনজীবী, ৩৮% চিকিৎসক, ২৮% বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বুদ্ধিজীবী হত্যার এই সারণি দীর্ঘতর হয় ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। সোভিয়েত ইউনিয়নের ৬০% মানুষ হত্যাকাণ্ডের করুণ পরিণতি লাভ করে। নাজিবাহিনী সে দেশ দখল করে গণহত্যা চালায়। ১৯৪১ সালে জার্মানরা লেলিনগ্রাদ দখল নিয়ে অবরুদ্ধ করে এবং নির্মম হত্যার শিকার হন অনেক বুদ্ধিজীবীসহ নানা স্তরের মানুষ। কেবল জার্মানের সাত মিলিয়ন জার্মানি নিহত হন, যার মধ্যে ২ মিলিয়ন সাধারণ জনতা। আশির দশকে এসবই ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয় কম্বোডিয়ায় পলপটের খেমার-রুজ বাহিনীর গণহত্যায় (১৯৭৫-৭৯); ১০ লাখ মানুষ নিধনযজ্ঞে। সে সময় চশমাধারী ব্যক্তি মাত্রকে শিক্ষিত ধরে নিয়ে তার ওপর নির্যাতন চালানো হতো। মাওবাদী খেমাররা নারী-পুরুষ নির্বিশেষ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে পরিণত করে সর্বহারা শ্রমজীবীতে। তাদের আদর্শের বিরোধিতার গন্ধ পেলে সঙ্গে সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে। পাবলিক লাইব্রেরি ও স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাদের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় সব বুদ্ধিবৃত্তির বিপরীতে। ১৯৬৬ সালে আর্জেন্টিনার সামরিক সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অপদস্ত, চাকরিচ্যুত করে। ব্রাজিলে পাওলো ফ্রেইরিকে তাঁর নতুন চিন্তা ধারার জন্য হত্যা করা হয়।

রাশিয়ার বলশেভিক আন্দোলনে (১৯১৭) বুদ্ধিজীবীদের চেয়ে সর্বহারা জনগোষ্ঠীর অবদান ছিল বেশি। এজন্য লেনিন বলেছিলেন, ' We have completed no academies' একই কারণে ১৯২২ সালের দিকে ২০০ জন দার্শনিককে (Tsarist) জার্মানে বিতাড়িত করা হয়। পরের বছর লাটভিয়া ও তুরস্কে বিতাড়িত হন বাদ বাকিরা। এ সময় শ্রমজীবী শ্রেণি থেকে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু ১৯৩০-১৯৫০ কালপর্বে জোশেফ স্ট্যালিন লেনিনের শ্রমজীবী বুদ্ধিজীবীর স্থানে কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীদের প্রতিস্থাপন বা জায়গা করে দেন। ফলে রক্ষণশীল মার্কসবাদে পড়ে তাঁরা সার্বজনীন চরিত্র হারান। 

উল্লেখ্য, সোভিয়েত ইউনিয়নে কেবল ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত দুই হাজার লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পীকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ১৫০০ জন কারাগারে এবং কনসেন্টেশন ক্যাম্পে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৩৬-৩৮ সালের মধ্যে ২৭ জন জ্যোতির্বিদ গুম হন। জোশেফ স্ট্যালিনের মার্কসীয় মতবাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হন লেখকরা। বিপ্লব বিরোধী কর্মকাণ্ড এবং অপতৎপরতার জন্য আক্রান্ত হয়েছেন একাধিক লেখক। জার্মানের ইহুদী বুদ্ধিজীবী ওয়ালটার বেনজামিনকে স্টালিনের গুপ্তচর ১৯৪০ সালে হত্যা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও সেই সময় সেপ্টেম্বরে তাঁর মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করা হয়েছিল। লেখক ও সমালোচক এবং বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জ্ঞানী ব্যক্তির করুণ পরিণতি এভাবে এসেছে। বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান থেকে পালিয়ে আসা যেসব ইহুদিরা গঠন করেছিল ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগঠন এবং স্ট্যালিন যাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন; ১৯৪৫ সালের পর যুদ্ধ শেষে স্নায়ু যুদ্ধের সময় তাঁরাই হয়ে গেলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের শত্রু। কেবল সেই সংগঠনের সদস্যরা নন তাঁদের সঙ্গে অনেক নিরীহ ইহুদিদের হত্যা করা হলো সোভিয়েতবিরোধী হিসেবে। রাজনীতির জটিল তন্তুজালে আবদ্ধ হলেন বুদ্ধিজীবীরা।  ইতালীয় ফ্যাসিবাদের জন্মদাতা বুদ্ধিজীবী ছিলেন গিয়োভান্ন। ১৯২৫ সালে ফ্যাসিবাদের যে ধারণার সূচনা তা মুসোলিনের দ্বারা কীর্তিত হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধের সময়। বিপরীতে আন্তোনিও গ্রামশির সঙ্গে ছিল তাঁর তত্ত্বের ভিন্নতা। এজন্য গ্রামশিকে জেল খাটতে হয়েছে অনেকদিন।

স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় ১৯৩৬ সালে বুদ্ধিজীবীদের বিপক্ষে শাসক শ্রেণির অবস্থান গিয়োভান্ন ধারণার পরিণাম। সে সময় কবি লোরকাকে নির্মমভাবে হত্যা করে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যরা। কিউবান গেরিলা নেতা, চিকিৎসক, লেখক বিপ্লবী আর্নেস্ট চে গেভারা ১৯৬৭ সালে বলিভিয়ায় ধৃত হয়ে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন। অথচ চে সম্পর্কে জা পল সার্ত্র বলেছেন, " not only an intellectual but also the most complete human being of our age" and the "era's most perfect man." .

পৃথিবীর অনেক প্রান্তেই নতুন বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। রাজতন্ত্রের পতন হয়েছে; গণতন্ত্র ফিরে এসেছে কিন্তু প্রাণ দিতে হয়েছে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অন্যতম মহানায়ক মাও-কে গণহত্যার জন্য দায়ী করা হয়ে থাকে। ৬৫ মিলিয়ন মানুষের হত্যা ছিল চীনের বিপ্লবের অনিবার্যতা। বিরুদ্ধাচারীদের ফাঁসি, কারারুদ্ধ করা সাধারণ ঘটনা ছিল। মাওয়ের প্রধান শত্রু ছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। তার আগে চীনের রাজতন্ত্র ৪৬০জন জ্ঞানীকে হত্যা করেছিল আর তিনি ৪৬ হাজার বুদ্ধিজীবীর কবর রচনা করেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬ সালের সেই ঘটনাগুলো রোমহর্ষক নিঃসন্দেহে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ফল হচ্ছে অর্ধ লক্ষ বুদ্ধিজীবীর প্রাণ। রিপাবলিক চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় চেয়ারম্যান মাও-এর নির্দেশে রেড গার্ডরা সে দেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। তখন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। রাষ্ট্রের শত্রু আখ্যা দিয়ে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার এই ইতিহাস চীনের বিপ্লবকে কি মহিমান্বিত করেছে?

বিশ্বযুদ্ধের হলোকাস্ট ও চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মতো রাজনৈতিক পটভূমি রয়েছে ১৯৭১ সালের অসংখ্য বুদ্ধিজীবী হত্যার পিছনে। বিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত উপমহাদেশের দেশভাগ পাল্টে দিয়েছিল আগের সব হিসাব-নিকাশ। তবে রাষ্ট্রীয় শাসকদের আগ্রাসী মনোভাব নতুন মাত্রা অর্জন করেছিল। পাকিস্তান নামক নতুন রাষ্ট্রে হত্যা করা হয়েছে যুক্তিবাদী মানুষকে, হত্যা করেছে যুক্তিতে অবিশ্বাসী মানুষরা। এই মানুষরা বুদ্ধিজীবীদেরও অবিশ্বাস করেছে। কারণ বাংলাদেশে বুদ্ধির জয়গান সর্বত্রই। অবশ্য এই শতাব্দীতেই বুদ্ধিজীবীদের ক্ষমতা কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।  উল্লেখ্য, পাকিস্তান আমলের আগেই পূর্ববাংলা ভূখণ্ডে বুদ্ধিজীবী হত্যার সূচনা হয়েছিল। ঢাকায় ১৯৪২ এর ৮ মার্চ এক সর্বভারতীয় ফ্যাসিবিরোধী সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে লেখক সোমেন চন্দ গুণ্ডাদের দ্বারা নির্মমভাবে খুন হন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বাংলাদেশ ভূখণ্ডে উদার মানবতাবাদী এবং সাম্যবাদী চিন্তা চেতনার বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের স্পষ্টত প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।

১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানি নির্যাতনের বিরুদ্ধে সব গণ-আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন এই দুই ধারার বুদ্ধিজীবীরা। তাঁরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে বাঙালিদের বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলেই জনগণ ধীরে ধীরে নিজেদের দাবি ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে যা পরবর্তীতে তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে। এজন্য বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। তাই ১৯৭১ সালে যুদ্ধের শুরু থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী বাছাই করে করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে। ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইটে’র পরিকল্পনার সঙ্গেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পাকিস্তানি সেনারা অপারেশন চলাকালীন খুঁজে খুঁজে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে ২৫ মার্চের রাতেই হত্যা করা হয়। তবে, পরিকল্পিত হত্যার ব্যাপক অংশটি ঘটে যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে।

মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন। স্বাধীনতার পর ধ্বংসপ্রাপ্ত বঙ্গভবন থেকে তাঁর স্বহস্তে লিখিত ডায়েরি পাওয়া যায় যাতে অনেক নিহত ও জীবিত বুদ্ধিজীবীর নাম লেখা রয়েছে। ডিসেম্বরের ৪ তারিখ থেকে ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। ডিসেম্বরের ১০ তারিখ থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নেওয়া হতে থাকে। মূলত ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন হয়। অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখকসহ চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসররা জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায়। সেদিন প্রায় ২০০ জনের মতো বুদ্ধিজীবীকে তাঁদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ অন্য আরো অনেক স্থানে অবস্থিত নির্যাতন কেন্দ্রে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁদের ওপর বিভৎস নির্যাতন চালানোর পর নৃশংসভাবে রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে হত্যা করে ফেলে রাখা হয়। 

সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী যাঁরা ব্যবসায়ী কিংবা ব্যবহারিক জীবনের চেয়ে ভাববাদী জগতের মানুষ হয়েও মানবকল্যাণে কাজ করেছেন তাঁরাই যুগে যুগে নির্যাতিত হয়েছেন। নির্মম মৃত্যুর আলিঙ্গনে আবদ্ধ শহীদদের নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। মানবসভ্যতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বুদ্ধিজীবীরা নিজের কালে জনপ্রিয় ছিলেন। এমনকি রাষ্ট্রক্ষমতার প্রতি আস্থার চেয়ে বুদ্ধিজীবীদের ব্যক্তিগত চরিত্রের প্রতি অন্ধ আনুগত্য সাধারণ মানুষের বেশি ছিল। এজন্য বুদ্ধিজীবীদের বিপক্ষে সবসময়ই এক শ্রেণির মানুষের আক্রোশ রাজনীতির ময়দানে উত্তাপ বিলিয়েছে। এর কারণ সম্ভবত বুদ্ধিজীবীরা সমকালীন রাজনীতিকে নিজস্ব চিন্তা ধারায় প্রভাবান্বিত করেছিলেন; এমনকি স্রোতের বিপরীত ধারা তৈরি করেছেন। কখনো আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের লেখনি দিয়ে নাড়া দিয়েছেন কোনো কোনো শিক্ষক। তাঁদের আবেদন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে অধিকারের প্রশ্নে ঝাঁকে ঝাঁকে তরুণ শিক্ষার্থী রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠেছেন জীবন পরিচালক; সুখ-দুঃখের সাথী। এভাবে সক্রেটিস কিংবা হুমায়ূন আজাদ হয়ে উঠেছেন নতুন শতাব্দীর দিশারী। হত্যার নির্মমতা তুচ্ছ হয়ে গেছে তাঁদের চিন্তাধারা ও সৃষ্টিশীলতার কাছে। 

লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়