জাবি সিনেট নির্বাচন

একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ

Looks like you've blocked notifications!

প্রতি বছরের জুনের শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথা অনুযায়ী সিনেট অধিবেশন বসে। সিনেট সদস্যরা নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য প্যানেল তৈরি করেন। মাননীয় আচার্য সেখান থেকে একজনকে উপাচার্য নিয়োগ দেন। এই সিনেট বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার আইন প্রণয়ন করে। বছরজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট পর্ষদ যে কাজ করে, তার বৈধতা দেয় সিনেট। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বজননীতা রক্ষায় ভবিষ্যতের নির্দেশনাও আসে সিনেট থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন এবং বার্ষিক বাজেটও পাস করা হয় সিনেটেই। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ‘দ্বিতীয় পার্লামেন্ট’  বলেও অভিহিত।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে রাখে শিক্ষকদের দায়িত্বসুলভ পাঠদান ও ব্যবস্থাপনা এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষ দায়িত্বপালন। শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়েরও মানদন্ড। এসব সূচকে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি আমরা। এখন দরকার এমন প্রতিনিধি, যারা এই বিষয়ে প্রশাসনের সাথে আলোচনা করতে পারে? সিনেটে রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি তেমনই পর্ষদ, যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিষয়ে ওয়াকিফহাল হয়ে প্রশাসনকে পরামর্শ দিতে পারে।

২. আগামী ৩০ ডিসেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেটে রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন। এবার তিনটি প্যানেলসহ মোট প্রার্থী ১১৯ জন। আর ভোটার চার হাজার ৩৭৩। ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিভিন্ন ক্যাটাগরির মোট ৯৩ জন সদস্য নিয়ে সিনেট গঠন করা হয়। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে ২৫ জন নির্বাচিত হন।

সব শেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। তার মেয়াদ শেষ হয় ২০০১ সালে। মেয়াদ শেষের ১৬ বছর পর এবারের ভোট। শিক্ষক রাজনীতিতে  সক্রিয় একটি পক্ষের দুজন শিক্ষক হাইকোর্টে কোনো এক ইস্যুতে মামলা ঠুকে দেন। সেই স্থগিতাদেশ জটিলতাতেই চলে যায় প্রায় দেড় যুগ। আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার প্রেক্ষাপট কী ছিল, জানতে ইচ্ছে করে। বছরের পর বছর একই সদস্যরা সিনেটে হাজিরা দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে তাঁদেরই ভূমিকাই বা কী ছিল?

৩. জাহাঙ্গীরনগরের ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র থেকেই শিক্ষার্থীদের এমফিল, পিএইচডি গবেষণার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে, হতে পারে সেন্টার অব এক্সিলেন্স- এমন ভাবনা কি প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের আছে? আমরা ৩৮ ব্যাচ ভর্তি হওয়ার সময়ও অভিভাবকরা চিন্তিত ছিলেন, কবে না শেষ হয় ছেলেমেয়ের পড়াশোনা। অথচ নির্ধারিত সময়ের আগেই, বলতে গেলে সাড়ে তিনবছরের মাথাতেই শেষ হয়ে যায় আমাদের স্নাতক পর্বের পরীক্ষা। অথচ, এখন আবারও বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট শুরু হয়েছে। এই জট কমাতে শিক্ষকদের ভূমিকাই প্রধান। তাঁরা কজন ঠিক মতো দায়িত্ব পালন করছেন? অনেকেই কি ব্যস্ত বেসরকারি বিশ্বিদ্যালয়ে পড়ানো, ব্যবসা-বাণিজ্য বা জমির বিকিকিনি নিয়ে? মেডিকেল সেন্টারের জরাজীর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে সুবিধা নিতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। প্রতিবছর শিক্ষার্থী বাড়লেও পুরনো অবকাঠামোতেই লাইব্রেরী। বিশ্ববিদ্যালয়ে গেল কয়েক বছরে অনেকগুলো বিভাগ ও ইনস্টিটিউট চালু হয়েছে। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য মেডিকেল ও লাইব্রেরীর উন্নয়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। হুটহাট ভবন নির্মাণ ও গাছ না কাটার সিদ্ধান্ত এই ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিতে পারে বহুগুণ।

৪. এবারের সিনেটে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের নেতৃত্বে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী’ ব্যানারে সারাদেশেই প্রচারণা চলছে। এই প্যানেলে স্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, উচ্চপদস্থ সরকারি আমলা, বড় ব্যবসায়ীসহ অভিজাত শ্রেণির। তবে, এই প্যানেল নিয়ে ২৫ ব্যাচের পরের শিক্ষার্থীরা মনঃক্ষুণ্ণ হতে পারে, কাছাকাছি ব্যাচের প্রতিনিধি না পেয়ে।

জাহাঙ্গীরনগরে আওয়ামী শিক্ষক রাজনীতিতে বরাবরই প্রভাবশালী অধ্যাপক কবির। সিনেট নির্বাচনে আওয়ামী দুই পক্ষকে এক করতে না পারার ব্যর্থতা কি তিনি অস্বীকার করবেন? মজার ব্যাপার হলো, তাঁর প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত অনেক শিক্ষকই এখন তার প্রতিপক্ষ প্যানেলে। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা কী বুঝব, দেনদরবারে মনোমালিন্য, না কি প্রশাসনের ক্রিমটা খাওয়ার প্রতিযোগিতা? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদেরও খায়েস নির্বাচনের ফলটা নিজ কোর্টেই রাখতে। ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের একটি অংশকে নিয়ে গড়ে উঠেছে প্রশাসন সমর্থিত আরেকটি প্যানেল। সাথে বাম দলের একটি অংশ। ক্যাম্পাসে নিপীড়ন ইস্যুতে সক্রিয় ভুমিকা রাখলেও, নির্বাচনে নিপীড়ন শিক্ষককে সাথী করার অভিযোগ প্রতিপক্ষ প্রার্থীরা প্রচারের হাতিয়ার বানিয়েছেন।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন শিক্ষক ও ছাত্রদলের রাজনীতিকদের নিয়ে গঠিত হয়েছে আরো একটি প্যানেল। এই প্যানেলেরও রয়েছে ইমেজ সংকট। কয়েকজন শিক্ষক, যারা বিভিন্ন সময় আওয়ামী নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন। বিএনপির নীতি-নির্ধারকদের প্রার্থী বাছাইয়ে আরো উদার হওয়ার সুযোগ ছিল।

৫. এর বাইরেও রয়েছেন গোটা চল্লিশেক প্রার্থী। যারা, স্বতন্ত্র পদে নির্বাচন করছেন। অনেকেই আবার, ছাত্ররাজনীতির পরিচয়কে হাইলাইটস করে প্রচারণা চালাচ্ছেন- এটুকুই কি যথেষ্ঠ? এমন অনেক প্রার্থী রয়েছেন, যারা একাডেমিক ফলাফলে প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে অনেক কম নিচে অবস্থান করছেন। পেশাগত অবস্থানেও দুর্বল। সর্বোপরি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণার মান নিয়ে যাদের এক্কেবারেই কোনো ভাবনা নেই, দক্ষতা তো নেই-ই। বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক চর্চা চালুর ব্যাপারে যাদের অনীহা, বলতে গেলে গণতন্ত্র, সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক চর্চার পরিবেশ বজায় রাখার ব্যাপারে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও একাডেমিক জ্ঞানের ক্ষেত্রেও তারা পিছিয়ে খানিকটা। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড নিয়েও তারা একগুঁয়ে। তবে, এই স্বতন্ত্রধারায় বেশ কিছু যোগ্য প্রার্থীও রয়েছেন।

দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা ও গবেষণায় নিযুক্ত অন্তপ্রাণ ব্যক্তিরাই এই পদে নিযুক্ত হন, যাদের ধ্যান-জ্ঞানই থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটেও রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বপালন করেছেন ড. ফরাস উদ্দিন, রামেন্দ মজুমদারদের মতো প্রখ্যাত ও বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব। আমরাও চাই, এমন প্রার্থীরা বিজয়ী হয়ে আসুন, সুষ্ঠু বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় যাঁরা প্রকৃতই ভূমিকা রাখতে পারবেন।

লেখক : বিজনেস রিপোর্টার, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর