শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস

‘আমরা তোমাদের ভুলব না’

Looks like you've blocked notifications!

‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী

ভয় নাই ওরে ভয় নাই

নিঃশেষে প্রাণ, যে করিবে দান

ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই অমর পঙক্তির চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে জাতি আজ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করবে। দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের আজ মর্মন্তুদ একটি দিন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের উষালগ্নে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হারানোর দুঃসহ যন্ত্রণার দিন। দুঃখ ভারাক্রান্ত মনেই জাতি আজ স্মরণ করছে তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।

তবে ১৪ ডিসেম্বরকে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের দিন হিসেবে স্মরণ করা হলেও মূলত ১০ ডিসেম্বর থেকেই ইতিহাসের এ ঘৃণ্যতম অপকর্মের সূচনা হয়। একাত্তরের ডিসেম্বরের এই হত্যাযজ্ঞের শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত সংখ্যা আজও নিরূপণ করা যায়নি। ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সংকলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট এক হাজার ৭০ জন।

এই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ডা. আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান, ড. ফজলে রাব্বী, সিরাজ উদ্দিন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, অধ্যাপক জিসি দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সাংবাদিক খন্দকার আবু তাহের, নিজামউদ্দিন আহমেদ, এস এ মান্নান (লাডু ভাই), এ এন এম গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ নাজমুল হক, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, সেলিনা পারভীনসহ আরো অনেকে।

মুনীর চৌধুরী :

আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী (২৭ নভেম্বর ১৯২৫-১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১) একজন বাংলাদেশি শিক্ষাবিদ, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক, ভাষাবিজ্ঞানী, বাগ্মী এবং শহিদ বুদ্ধিজীবী। ১৯৭১ সালের মার্চে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুনীর চৌধুরী ফিরে আসার কিছুকাল পরই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এ সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আদেশে মে-জুন মাসে ইংরেজি বিভাগের প্রধান হিসেবে এবং জুলাই মাস থেকে কলা অনুষদের ডিন হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মুনীর চৌধুরীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীদের সহযোগী আল-বদর বাহিনী তাঁর বাবার বাড়ি থেকে অপহরণ করে এবং সম্ভবত ওই দিনই তাঁকে হত্যা করে।

আবদুল আলীম চৌধুরী :

শহীদ ডা. এ এফ এম আবদুল আলীম চৌধুরী (পুরো নাম : আবুল ফয়েজ মোহাম্মদ আবদুল আলীম চৌধুরী) (জন্ম : ১৯২৮- মৃত্যু : ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১) ছিলেন চিকিৎসক ও বুদ্ধিজীবী। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর শহীদ ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীকে রাজাকার-আলবদর বাহিনী তাঁর বাসা থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায় এবং ওই দিন রাতে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নির্মমভাবে হত্যা করে।

সিরাজুদ্দীন হোসেন :

সিরাজুদ্দীন হোসেন (জন্ম : ১৯২৯-মৃত্যু : ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১)  স্বাধীনতার প্রাক্কালে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর আলবদর ও রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে তাঁর রাজধানীর চামেলীবাগের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

শহীদুল্লা কায়সার :

শহীদুল্লা কায়সার (জন্ম : ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৭ - মৃত্যু : ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১)  প্রকৃত নাম ছিল আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তার স্থানীয় সহযোগী আল-বদরের হাতে অপহৃত হন। ধারণা করা হয় যে, অপহরণকারীদের হাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

গোবিন্দ চন্দ্র দেব :

গোবিন্দ চন্দ্র দেব (১ ফেব্রুয়ারি, ১৯০৭ - মার্চ ২৬, ১৯৭১) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনবিদ্যার একজন অধ্যাপক ছিলেন। তিনি জি সি দেব নামেই সমধিক পরিচিত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবী-সম্প্রদায়কে ধবংস করার একটি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্ষণজন্মা মণীষী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে হত্যা করেছিল।

জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা :

জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (১০ জুলাই, ১৯২০- ২৭ মার্চ, ১৯৭১) অন্যতম পরিচয় তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবীদের একজন। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার সময় তিনি ঢাবির জগন্নাথ হলে আবাসিক শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সেদিন তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা গুলিবিদ্ধ ও আহত হন। চারদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন থাকার পর ৩০ মার্চ, ১৯৭১ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

সৈয়দ নাজমুল হক :

সৈয়দ নাজমুল হক (জন্ম : ১৯৪১ – মৃত্যু : ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে অকুতোভয় সাংবাদিক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ লগ্নে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, রাজাকার ও আল-বদর বাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অংশ হিসেবে তিনি অপহৃত ও পরে শহীদ হন।

সেলিনা পারভীন :

সেলিনা পারভীন (৩১ মার্চ, ১৯৩১- ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১) একজন বাংলাদেশি সাংবাদিক। ১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। দেশ স্বাধীন হতে আর মাত্র তিনদিন বাকি। সাংবাদিক সেলিনা পারভীন তখন বাস করতেন সিদ্ধেশ্বরীতে। ১১৫ নং নিউ সার্কুলার রোডে তাঁর বাড়িতে থাকত তিনজন মানুষ। তাঁর মা, পুত্র সুমন আর ভাই জনাব উজির। সেদিন শীতের সকালে তাঁরা সবাই ছিলেন ছাদে। সেলিনা পারভীন সুমনের গায়ে তেল মাখিয়ে দিচ্ছিলেন। সুমন যখন ছাদে খেলাধুলা করছিল তখন সেলিনা পারভীন ছাদে চেয়ার টেনে একটি লেখা লিখছিলেন। শহরে তখন কারফিউ। রাস্তায় মিলিটারি। পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বিমান থেকে চিঠি ফেলা হচ্ছে। হঠাৎ দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ হলো। সেলিনাদের বাড়ির উল্টো দিকে খান আতার বাসার সামনে ফিয়াট মাইক্রোবাস ও লরি থামল। সেই বাসার প্রধান গেইট ভেঙে ভিতরে ঢুকে গেল কিছু আল-বদর কর্মী। তাদের সবাই একই রঙের পোশাক পরা ও মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা। এক সময় সেলিনাদের ফ্ল্যাটে এসেও কড়া নাড়ে তারা। সেলিনা পারভীন নিজে দরজা খুলে দেন। লোকগুলো তাঁর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এবং এ সময় সেলিনা পারভীনের সাথে লোকগুলোর বেশ কিছু কথা হয়। এরপর তারা সেলিনা পারভীনকে ধরে নিয়ে যায়। ১৮ ডিসেম্বর গুলি ও বেয়নেটে ক্ষত-বিক্ষত সেলিনা পারভীনের মৃতদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে।

এভাবেই একাত্তরে ৩০ লাখ শহীদের মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যার ঘটনা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। তাঁরা শহীদ হন এক সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী তাদের পরাজয় আসন্ন জেনে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবী নিধনের এই পরিকল্পনা করে। ইতিহাসের এই বর্বোরোচিত হত্যাকাণ্ডের কুলাঙ্গারদের প্রতি আজ ঘৃণা জানাবে কোটি কোটি দেশপ্রেমিক বাঙালি।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন