১৯৭১

একজন সাহসী শহীদ আবদুর রব

Looks like you've blocked notifications!

১৯৭১ সাল। বাঙালি জাতি স্বাধীকার আন্দোলনে সোচ্চার সেখানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন পিছিয়ে থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীর একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধে। এতে শহীদ হন এই প্রতিষ্ঠানটির ১৫ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারী। এরমধ্যে অন্যতম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) প্রথম সাধারণ সম্পাদক শহীদ আব্দুর রব।

দেশের প্রতিটি আন্দালন সংগ্রামে এই মানুষটির সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছিলেন বিভিন্ন ছাত্র সংসদের প্রতিনিধি। আবদুর রবের জন্ম ১৯৪৫ সালে বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়ার বান্ধাবাড়ি গ্রামে। তাঁর পিতার নাম আবেদ আলী মিয়া। আড়াই বছর বয়সে পিতার সাথে রব চট্টগ্রামে আসেন। পরিবারের প্রথম সন্তান রব শৈশবে এনায়েত বাজার কলিমুল্লাহ প্রথমিক বিদ্যালয়, পরে মুসলিম হাই স্কুলে পড়াশুনা করেন। ১৯৬৫ সালে এসএসসি পাস করার পর চট্টগ্রাম কলেজে আইএ তে ভর্তি হন। ১৯৬৮ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন তিনি। সেখানে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) প্রথম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। চট্টগ্রাম কলেজে থাকাকালীন হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টবিরোধী আন্দোলন, ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানে রব ছিলেন সামনের কাতারের সংগ্রামী ছাত্রনেতা। তিনি নাটকে অভিনয় ও নাটক পরিচালনা করতেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে- মানচিত্র এলবা, শেষ ফল, আমরা ভাবছি, চাঁদের ছেলে।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তাঁর মাকে বলেছিলেন, “মা তোমার তো আরো ছেলে আছে, আমাকে তুমি ওদের হয়ে মরতে দাও।” মাকে বলা এসব কথা যে এমন ভাবে সত্য হবে কে জানত।

১৯৭১ সালের ২ মার্চে চট্টগ্রামের লালদীঘিতে সাহিত্য সংস্কৃতিসেবীদের প্রতিরোধ সংঘ আয়োজিত এক সমাবেশে ছয় ছাত্র সংগঠনের পক্ষে তিনি বক্তব্য দেন। ৮ মার্চ মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতে সামরিক ট্রেনিংয়ের জন্য পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করেন তিনি। ১০ মার্চ চাকসু ভিপি মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও জিএস আবদুর রব সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের তাদের অস্ত্র জমা না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এক বিবৃতি প্রদান করেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিদের পরিচালিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর পরিপেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ আর মল্লিক, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, ড. আনিসুজ্জামান ও রেজিস্ট্রার খলিলুর রহমান, চাকসু ভিপি-জিএসের উপস্থিতিতে সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী, ইপিআর বাঙালি সেনা ও গ্রামবাসী মিলে ক্যাম্পাস ঘেরাও করে রাখা হবে যেন পাকিস্তানি সৈন্যরা বিশ্ববিদ্যালয়কে দখলে নিতে না পারে।

যেভাবে মৃত্যুবরণ করেন

১১ এপ্রিল বাঁশখালির সাবেক সংসদ সদস্য সুলতানুল কবিরের সাথে পটিয়ার ডাকবাংলোয় দেখা হয় শহীদ সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, শহীদ ফিরোজ, শহীদ আব্দুর রবের সাথে। তাঁরা সেখানে বসে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং বান্দরবানগামী ইপিআরের একটি লরিতে উঠে পড়েন। বান্দরবান পৌঁছে তাঁরা সেখানকার এসডিও আবদুর শাকুরের সাথে দেখা করে ভারতে যাওয়ার রুট নিয়ে খোঁজ খবর নেন। এসডিও তাদের ভুল পথে এসেছেন বলে জানান। তিনি (এসডিও) তাদের বিকল্প সহজ পথ হিসেবে চন্দ্রঘোনা, কাপ্তাই, পাহাড়তলী হয়ে রামগড় দিয়ে ভারতে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পরে তাঁরা চৌদ্দ মাইল পথ হেঁটে চন্দ্রঘোনার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। পথিমধ্যে তাঁদের সাথে যোগ দেন রামুর সিদ্দিক ও মিরসরাইয়ের রুস্তম। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর তাঁরা একটি জিপ লক্ষ করলেন। তাঁরা জিপটি থামানোর চেষ্টা করলেও জিপটি দ্রুত বেগে চলে যায়। পরে জিপটি কিছু দূর যাওয়ার পর ছড়ার (পাহাড়ি খাল) মধ্যে অচল হয়ে পড়ে। পরে গাড়িটির কাছে গিয়ে দেখা হয় কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজের অধ্যাপক দিলিপ চৌধুরী, বোয়ালখালী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মোজাফফর আহমদ, ইউনুস, নরুল ইসলাম, ইদ্রিসের সাথে। সবার অভিন্ন লক্ষ্য জেনে এক সঙ্গে যাওয়া শুরু করলেন। সবাই ধরাধরি করে জিপটি খাড়া করে চড়ে বসলেন। রাতেই তাঁরা চন্দ্রঘোনা পৌঁছালেন। কিন্তু কর্ণফুলীতে কোনো ফেরি না থাকা সারা রাত বসে থেকে পরের দিন সকালে পার হলেন। দোভাসী বাজারে নাস্তা সেরে আবারও যাত্রা শুরু করলেন। তবে যাত্রা শুরু করার আগে স্থানীয় জনগণ তাঁদের বাঁধা দেয়। কারণ কাপ্তাই রোডে ইতিমধ্যে পাকিস্তানি আর্মি এসে পড়েছে। কিন্তু অদম্য এই সব যোদ্ধা রওনা দিলেন। জিপের সামনে সিটে বসলেন দিলীপ, রব, মোজাফফর। পিছনের সিটে সুলতান, সাইফুদ্দিন, ফিরোজ, সিদ্দিক, রুস্তম, নুরুল ইসলাম। জিপে ছিল বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণার কপি, প্রচারপত্র, অয়্যারলেস সেট, কিছু বেতার যন্ত্রপাতি। জিপের সামনে ছিল একটি মেশিনগান, কয়েকটি রাইফেল ও কয়েকটি হ্যান্ড গ্রেনেড। জিপটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমান চুয়েট)-এর সামনে আসলে রব দেখতে পেলেন কলেজে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। তিনি সবাইকে সাবধান করার জন্য চেঁচিয়ে উঠলে ড্রাইভার কড়া ব্রেক কষলেন। ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও পাশে স্কুলের ছাদে আগে থেকে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যরা বৃষ্টির মতো গুলি বর্ষণ করলেন। ঝাঁক ঝাঁক মেশিনগানের গুলিবৃষ্টি শুরু হয়। কোনো আড়াল নেই কোথাও। প্রথম গুলিতে গাড়ি অচল হয়ে যায়। পরে অরক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধের চেষ্টা করলেন। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ অস্ত্র না থাকায় বেশিক্ষণ প্রতিরোধ করতে পারলেন না। এক এক করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন ভবিষ্যৎ ছাত্রনেতা সাইফুদ্দিন খালেদ আর চাকসু সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রব। এভাবে মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বইয়ে নিজের স্মৃতি বর্ণনা করেন বাঁশখালির সাবেক সংসদ সদস্য সুলতান-উল কবির চৌধুরী।

শহীদের স্মৃতিতে নির্মিত স্থাপনা

শহীদ আবদুর রবের স্মৃতি ধরে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি হলের নামকরণ করেন তাঁর নামে। তা ছাড়া তাঁর নামে একটি সড়কের নামকরণও করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ফটকে শহীদদের স্মৃতি নির্মাণ করা হয় ‘স্মরণ’ নামে স্মৃতি ভাস্কর্

তথ্যসূত্র :

মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বইয়ের ‘পাহাড়তলী ট্র্যাজিডি : প্রতিরোধ যুদ্ধে চার শহীদ’