শিক্ষা

প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধে সদিচ্ছা আছে কি?

Looks like you've blocked notifications!

‘মূল হোতারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে।’ এই বাক্যটির সঙ্গে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। বিশেষ করে যারা নিয়মিত দৈনিক পত্রিকায় চোখ রাখে তারা কোনো না কোনো নেতিবচাক খবরে এই বাক্যটি পড়ে থাকে। অপরাধীদের ব্যাপারে বলা হয়ে থাকে মূল হোতারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে, দু-একজন চুনোপুটি ধরা পড়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের ধরতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই মূল হোতারা কি চাঁদে বাস করে? কয়েক বছর ধরে দেশের সবচেয়ে আলোচিত একটি বিষয় হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁস। কোন ধরনের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি? যদি কেউ বলতে পারেন তবে তাঁকে পুরস্কৃত করা হবে বললে কথাটি বোধহয় বেশি বলা হবে না।

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে  শুরু করে সর্বশেষ যোগ হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা। শিক্ষা ব্যবস্থার এই হাল সম্পর্কে একজন শিক্ষাবিদ বলেছেন, ‘শিক্ষা এখন কেনাবেচার পর্যায়ে চলে গেছে। টাকা দিলেই প্রশ্নপত্র পাওয়া যায়।’

একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, পরীক্ষার সময় অনেক অভিভাবক ব্যস্ত হয়ে পড়েন ফেসবুক বা অন্য কোনো মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসের তথ্য পাওয়ার জন্য। তারপর খোঁজ করবেন কীভাবে সেটা হাতে পাওয়া যাবে। এই যদি হয় দেশের কতিপয় অভিভাবকের চিত্র তা হলে আর দোষ শুধু অপরাধীদের দিয়ে কী লাভ? একজন অভিভাবক যখন পরীক্ষা শুরু এক ঘণ্টা আগে কেন্দ্রে গিয়ে এর কাছে ওর কাছে ধরনা দেয় প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার খবর জানতে, তখন বুঝতে বাকি থাকে না তার সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে? পরীক্ষার সময় বিভিন্ন কেন্দ্রের সামনে শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকদের মোবাইল ফোনে হুমড়ি খেয়ে পড়ার খবর তো পত্রিকা মারফতই দেশবাসী জেনেছে।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসকে দুর্নীতির নতুন সংযোজন বলেছে। তারা বলেছে, শিক্ষা বোর্ড, বিজি প্রেস, ট্রেজারি ও পরীক্ষাকেন্দ্র হলো  প্রশ্নপত্র ফাঁসের সম্ভাব্য উৎস। ওই সব প্রতিষ্ঠানের একশ্রেণির কর্মকর্তার সাথে কোচিং সেন্টার, প্রতারক শিক্ষক ও বিভিন্ন অপরাধী চক্র মিলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে দুদকের সন্দেহ।

পুলিশের এক হিসেবে দেখা গেছে, এ বছর প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ৭১ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। এর মধ্যে ৩৬ জন গ্রেপ্তার হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় দুর্নীতি করতে গিয়ে। বাকিরা পাবলিক পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত ছিল।

সবচেয়ে অবাক ব্যাপার, এই যে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় কেউ কেউ ধরা পড়ছে। পত্রিকায় খবর বের হচ্ছে। কিন্তু একজনেরও কি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়েছে? হয়নি। কারণ যারাই যখন যেখানে ধরা পড়েছে, দেখা গেছে  তারা এমনই এক প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় ঘটনাটি ঘটিয়েছে যে তা ধামাচাপা দিতে বেশি সময় লাগেনি। কারণ ওই যে মূল হোতারা। মূল হোতারা পর্দার আড়াল থেকে কলকাঠি নেড়ে সব ঠান্ডা করে রেখেছে। শিক্ষামন্ত্রীসহ দেশের  বিশিষ্টজনরা অপরাধীদের ধরার জন্য যতই সুন্দর সুন্দর বাণী আওড়ান না কেন, ফলাফল শূন্য।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় যতক্ষণ পর্যন্ত দুই একজন অপরাধীর বড় ধরনের শাস্তি না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এর থেকে মুক্তির কোনো পথ পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ যে বা যারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে  নষ্ট করার অপতৎপরতায় সরাসরি জড়িত, তারা দেখছে প্রশ্ন ফাঁসের পরে আজ পর্যন্ত কারো তেমন কোনো সাজা হয়নি, কোনো রকমে দায়সারাভাবে সরকারসহ অন্যান্য সংস্থা বিষয়টিকে দেখেছে, সুতরাং অপকর্মটি চালিয়ে যেতে খুব একটা ঝক্কি পোহাতে হবে না।

যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা অপরাধীকে অপরাধী বলে গণ্য করার মানসিকতা গড়ে তুলতে পারব তত দিন পর্যন্ত এই ধরনের অপরাধ কমবে না। কোনো অপরাধী ধরা পড়লেই আগে তার রাজনৈতিক পরিচয় খোঁজা হয় বা তাকে বাঁচানোর জন্য রাজনৈতিক সিল-ছাপ্পর লাগাতে তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। যাতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী তাকে  ধরার পর একটু চিন্তাভাবনা করতে পারে। এই অপসংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারলে শুধু শিক্ষা নয় আমাদের চারপাশে যেসব অপরাধ ঘটছে তা থেকে  মুক্তির কোনো পথ নেই।

প্রশ্নপত্র  ফাঁস কেউ বিদেশ থেকে এসে করেনি, করেছে এ দেশের মানুষ। তাদের পাকড়াও করতে নয় মাস ছয় মাস লাগার কথা না। কারণ আমরা এখনো বিশ্বাস করি বা বিশ্বাস করতে চাই আমাদের সরকারসহ আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ইচ্ছে করলেই যেকোনো অপরাধীকে ধরতে সক্ষম। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছার।

লেখক: ছড়াকার ও সাংবাদিক