২০১৭

এ বছরটিও ছিল ঘটনাবহুল

Looks like you've blocked notifications!

বাংলাদেশের জন্য ২০১৭ ছিল একটি বর্ণাঢ্য ঘটনাবহুল বছর। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা ঘটনা এবং অঘটনে পরিপূর্ণ এ বছর। এ বছর সন্ত্রাসের বড় ধরনের ঘটনা ঘটে। সারা বছর সন্ত্রাস এবং সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতায় সংবাদপত্রের পাতা ভরপুর ছিল। বছরের শেষের দিকে ঘটে দুনিয়াজুড়ে আলোচিত, সমসাময়িক পৃথিবীর মর্মান্তিক শরণার্থী সংকট। বাংলাদেশ রাজনৈতিক অস্থিরতার দেশ বলে পরিচিত। এ বছরও তা থেকে ব্যতিক্রম কিছু ছিল না। অব্যাহত অস্থিরতার সঙ্গে যোগ হয় অনিশ্চয়তা। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা-ব্যাংকগুলোতে অরাজকতা, সর্বসেক্টরে দুর্নীতির নিদর্শন। শিক্ষাব্যবস্থায় ধস-প্রশ্নপত্র ফাঁস-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাস গোটা বছরকে কালিমা লিপ্ত করেছে। নারী জাতির প্রতি নিগ্রহ, অসম্মান এবং ধর্ষণের মতো পৈশাচিক ঘটনার ব্যাপকতা বিবেককে বিদ্রোহী করে তোলে। এ বছর সামাজিক অবক্ষয়ের ঘটনা প্রবল আকার ধারণ করে। সামাজিক বিজ্ঞানীরা একে মানবিক বিপর্যয় বলে অভিহিত করে। 

বছরটি শুরু হয় অঘটন দিয়ে। ১ জানুয়ারি ২০১৭ সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সরকারদলীয় সাংসদ মনজুরুল ইসলাম (লিটন) নিজ বাসভবনে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে গার্মেন্ট শিল্পে ব্যাপক আন্দোলন আর একটি অরাজকতার সূচনা করে। পরবর্তীকালে এ ক্ষেত্রে মালিক, সরকার এবং আইএলওর প্রতিনিধিরা এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুযায়ী ‘ত্রিপক্ষ’ রেডিমেন্ট গার্মেন্ট শ্রমিকদের উন্নয়নে কতিপয় কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা নববর্ষ উৎসব উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়। উৎসাহে ভাটা পড়ে বছরজুড়ে বিয়োগান্তক ঘটনার রেশে। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি হামলার পরবর্তী ঘটনাবলি ‘ফলোআপ’ প্রতিবেদনগুলো মানুষকে হকচকিত করে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার বিবরণী ছিল সারা বছর ধরে বেদনাবিধুর সংবাদ। 
নির্বাচনের আরো এক-দুই বছর বাকি থাকলেও ২০১৭ সাল গোটা বছরব্যাপী নির্বাচনী উত্তেজনা ছড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে নির্বাচনী জনসভা করে এ উত্তেজনার সূত্রপাত করেন। তখন অনেকেই ধারণা করছিলেন, সরকার আগাম নির্বাচন বা মধ্যবর্তী নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু বছর শেষে বোঝা গেল, তা আর হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলো, এমনকি গণমাধ্যম আগামী নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিরোধ এ সময়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ বছরই নতুন করে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। কমিশনপ্রধান তাদের বক্তব্য, বিবৃতি এবং কার্যব্যবস্থার মাধ্যমে আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বেকার নির্বাচন কমিশন সরকারের তল্পিবাহক হিসেবে বদনাম কুড়ায়। 

২০১৬ সালের সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনা সম্ভবত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি। ডিজিটাল কায়দায় এই চুরি সংঘটিত হয়। এর দায় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে পদত্যাগ করতে হয়। ৮০৮ কোটি টাকা বেহাত হয়। কীভাবে একটি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ভেঙে অন্য একটি আন্তর্জাতিক দুর্বৃত্তমহল-এ চুরি করতে পারল, তা নাগরিক সাধারণে বিস্ময়ের উদ্রেক করে। ২০১৭ সালজুড়ে এ টাকা উদ্ধারের চেষ্টা কিছুটা সফল হলেও পুরোপুরি সফল হয়নি। অর্থমন্ত্রীর বাগাড়ম্বরতা এ বছর বেশ রসিকতার সৃষ্টি করে। 

বছরটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে রেকর্ড সৃষ্টি করে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালের প্রথম ছয় মাসে ৫২ জন গুম হয়েছেন। তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন ৮৭ জন। পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা হয়েছে ১২৬টি। প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও এনজিও ব্যক্তিত্ব ফরহাদ মজহারের গুমের ঘটনা বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে নাগরিক বিবেক বিচলিত করে। পরে পুলিশ নাটকীয়তার আশ্রয় নেয়। সর্বশেষ গুমের ঘটনায় নিখোঁজ হয়েছেন একজন সাবেক রাষ্ট্রদূত। সারা বছর ধরে বিরোধী দল এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে হামলা, মামলা এবং জেল-জুলুম অব্যাহত থাকে। বছরটিতে অসংখ্য খুনখারাবি সংঘটিত হয়। বেশ কয়েকটি জায়গায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। 

জনসাধারণের জন্য এ বছরটি সবচেয়ে সংবেদনশীল ছিল। চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধিতে নিম্ন আয়ের মানুষ কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়। চালের মূল্য প্রতি কেজি ৭০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, বিশেষ করে শাকসবজির মূল্য তিন-চার গুণ বৃদ্ধি পায়। পেঁয়াজের মূল্য দাঁড়ায় ১৪০ টাকা। এ মূল্য বৃদ্ধি গত ৫০ বছরের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা অভিযোগ করছেন, উৎপাদন ও সরবরাহ এ জন্য দায়ী নয়। প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে। 

বছরের শেষটা নানা বিষয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে অতিবাহিত হয়। ১. প্রতিবেশী মিয়ানমারের সর্বশেষ হিসাবানুযায়ী প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। বছরের শেষ দিকে এক রকম আকস্মিকভাবেই তারা বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। সরকার প্রথম দিকে রোহিঙ্গা প্রশ্নে অনমনীয়তা প্রদর্শন করলেও পরবর্তীকালে এ নিয়ে কঠোর মনোভাব পরিহার করে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে মানবিক বিপর্যয় ঘটলে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি লাভ করে বাংলাদেশ। দৃশ্যমান সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকলেও কূটনৈতিক পর্যায়ে তিক্ততা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের নিকটতম বন্ধু ভারত এ সময়ে বাংলাদেশকে সমর্থনদানে ব্যর্থ হয়। চীন শক্তভাবে মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বন করে। এ বছরের শেষ কয়েক মাস এসব খবরে সংবাদপত্র ঠাসা থাকে। 

২. বিচার বিভাগ নিয়ে সরকারের তামাসা বিবেকবান মানুষকে আহত করে। সরকার ষষ্ঠদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অভিশংসনের দায়িত্ব জাতীয় সংসদের প্রতি অর্পণ করে। বিরোধী রাজনীতিকরা হাইকোর্টে এ সংশোধনী বাতিল চেয়ে আবেদন করে। হাইকোর্ট সরকারের বিপক্ষে রায় দেয়। অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট ও সরকারের বিরুদ্ধে তথা ষষ্ঠদশ সংশোধনী বাতিল করে। শুধু তাই নয়, উচ্চ আদালত সরকারের শাসন প্রক্রিয়া নিয়েও কতিপয় গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করে। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এতে সরকারের রোষানলে পড়েন। 

অনেক জটিলতা ও কুটিলতা শেষে প্রধান বিচারপতিকে অপমানজনকভাবে বিদায় নিতে হয়। বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনেও উত্তেজনা ছড়ায়। সরকার ডিসেম্বরের প্রথম দিকে নিম্ন আদালত নিয়ন্ত্রণে এক নীতিমালা প্রণয়ন করে। এতে করে বিচার ব্যবস্থার কফিনে সর্বশেষ পেরেক ঠোকা হয়েছে বলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির প্রধান মন্তব্য করেন। 

৩. শেষের দিকের আরেকটি ঘটনা পোপ ফ্রান্সিসের বাংলাদেশ সফর। ১ ডিসেম্বর রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্য তিনি বাংলাদেশে আগমন করেন। খ্রিস্টান ধর্মগুরুর এই সফর অনেকের মধ্যেই আগ্রহের সৃষ্টি করে। 

৪. এর আগে বাংলাদেশের সব বাম দল একাত্ম হয়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি এবং সরকারি অপশাসনের বিরুদ্ধে ৩০ নভেম্বর হরতাল আহ্বান করে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে হরতালের ধার কমে গেলেও এই হরতালের আহ্বান আলোচনার জন্ম দেয়। 

মানুষ কথায় কথায় বলে, যায় দিন ভালো যায়। ২০১৭ বাংলাদেশের মানুষকে শান্তি, স্বস্তি এবং স্থিতি—কোনোটিই দেয়নি। ২০১৮ জনগণের ভাগ্যে কী বয়ে আনছে, তা অজানা। তবে বর্তমান দেখে ভবিষ্যৎ অনুমান করা যায়। সেই ভবিষ্যৎ আশার নয়, আশঙ্কার। আর যদি জনসাধারণ ভাগ্যের পরিবর্তন করতে চায়, সেই দায়ও তাদের। আমরা শুধু আশা করতে পারি, অতীতের গ্লানি মুছে, নতুন সূর্য নতুন দিনের সূচনা করবে। 

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।