ফিরে দেখা ২০১৭

২০১৭ সালে বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি

Looks like you've blocked notifications!

মানুষের মননশীলতা বিনির্মাণ ও বিকাশের মাধ্যমে মানবিক বোধ জাগ্রত করে কোনো জাতিগোষ্ঠীকে প্রাগ্রসর পথের দিশা দেখায় শিল্প-সংস্কৃতি। কিন্তু বাংলাদেশের সংস্কৃতির বাঁকবদল ঘটে নানা জটিল পথে। যে মূল্যবোধের ওপর দেশটা প্রতিষ্ঠিত, সেই অবস্থানের বদল ঘটছে ধীরে ধীরে। মানবিক সংস্কৃতিকে দখল করছে ধর্মভিত্তিক বিধিবদ্ধ আচারনিষ্ঠা। খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের মুক্তসংস্কৃতি এখন বেশ কোণঠাসা। গেল বছরটা নেতিবাচক এই ইতিহাসের এক বড় উদাহরণ।

বছরের শুরুর দিকেই সুপ্রিম কোর্টের সামনে ভাস্কর মৃণাল হক নির্মিত ন্যায়বিচারের প্রতীক ‘গ্রিক দেবী থেমিসের অনুরূপ’ একটি ভাস্কর্য স্থাপনকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ। হেফাজতে ইসলামেরসহ অপরাপর কয়েকটি ইসলামী দল এই ভাস্কর্য কোর্ট চত্বর থেকে অপসারণের দাবি জানায়। ভাস্কর হক সে সময় জানান, আদালতের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ভাস্কর্যটিকে বাঙালিয়ানা দিতে শাড়ি পরানো হয়। বিশ্বের অনেক দেশ, এমনকি রক্ষণশীল ইসলামী রাষ্ট্র ইরানের আদালতের সামনেও থেমিসের প্রতিমূর্তি আছে, সেগুলো অবশ্য গ্রিক দেবীর আসল প্রতিরূপ। কিন্তু মৃণাল সেন আমাদের দেশের ‘জাস্টিসিয়া’কে শাড়ি পরিয়ে শিল্পবোদ্ধাদেরও বিতর্কের মুখে পরেন। অন্যদিকে ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে নারীমূর্তি অপসারণের দাবিতে অনড় থাকে ইসলামী দলগুলো। শেষ পর্যন্ত তাদের দাবির মুখে পিছু হটে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় কোর্ট সম্মুখ থেকে বাঙালি ‘থেমিস’কে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়।

বছরের শেষের দিকে এসে প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটেছে কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে। সেখানে কিছুদিন আগে ভাস্কর সুষেন আচার্যের নির্মাণে একটি মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। যেখানে দুজন পুরুষ মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি একজন নারী মুক্তিযোদ্ধাকেও রাখা হয়। কিন্তু ভাস্কর্যের পার্শ্ববর্তী এলাকায় থাকা ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসা থেকে নারী ভাস্কর্যের ব্যাপারে আপত্তি তোলা হয়। এমনকি আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দরাও ওই নারী ভাস্কর্যকে ইসলামবিরোধী বলে সাব্যস্ত করে। শেষ পর্যন্ত পুরো ভাস্কর্য থেকে নারী মুক্তিযোদ্ধাকে পুরুষে রূপান্তর করলে সংক্ষুব্ধ মৌলভিরা শান্ত হন। কিন্তু মুক্তচিন্তার মানুষ ও নারীবাদীরা বিষয়টিকে নারীর অপমান ও ধর্মান্ধতার কাছে প্রগতিশীল সংস্কৃতির বলয় হিসেবেই দেখছেন।

সংস্কৃতির ওপর ধর্মীয় বাতাবরণ থাকা সত্ত্বেও এ বছর বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র ও মঞ্চনাটক আপামর জনসাধারণ ও সুধী সমাজে বেশ সাড়া ফেলে। বিশেষ করে বছরের শেষ প্রান্তিকে দীপঙ্কর দীপন পরিচালিত ও সানী সানোয়ারের রচনায় দেশের প্রথম পুলিশ থ্রিলিং মুভি ‘ঢাকা অ্যাটাক’ দেশ-বিদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলে। বেশ কয়েকটা সপ্তাহ ধরে দেশের সিনেমা হলগুলোতে দর্শক সরগরম থাকে। চলচ্চিত্রবোদ্ধারা এই মুভিকে বাংলা চলচ্চিত্রের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে সাব্যস্ত করেন। এর পরে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ছবি ‘ডুব’ নিয়েও বেশ হৈচৈ হয়। বিশেষ করে কিংবদন্তি লেখক হুমায়ূন আহমেদের বায়োপিক কি না, এ নিয়ে চলচ্চিত্র মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলে। ভারতের ইরফান খান ও বাংলাদেশের নুসরাত ইমরোজ তিশা অভিনীত ছবিটিতে চলচ্চিত্রকারের ডিরেকটরিয়াল মুন্সিয়ানা বেশ প্রশংসা পায়। বছরের শেষ দিকে এসে তৌকীর আহমেদের পরিচালনায় ‘হালদা’ ছবি নিয়েও দর্শকরা ভালো আগ্রহ দেখান। কিন্তু বছরজুড়েই বাংলা সিনেমার হালের জনপ্রিয় নায়ক শাকিব খান ও অপু বিশ্বাসের সংসার নিয়ে গণমাধ্যমগুলো নানামুখী রসালো খবর পরিবেশন করে। ‘আব্রাম’ নামে তাদের এক শিশুসন্তান থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত আইনি পথে শাকিব ও অপুর সংসার বিচ্ছেদে গড়িয়েছে। অন্যদিকে চলচ্চিত্রপাড়া সারা বছর ব্যতিব্যস্ত থেকেছে শিল্পী ও প্রযোজকদের রাজনৈতিক ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে।

যে সময়টিতে মঞ্চনাটক নিয়ে কথা বলতে ভুলে গিয়েছে তরুণ সমাজ, সে সময় বাংলা মঞ্চনাটকের দিকপাল সৈয়দ জামিল আহমেদ ‘রিজওয়ান’ মঞ্চে এনে তাক লাগিয়ে দেন। ধর্ম, রাষ্ট্র, আইন এবং শান্তির নামে পৃথিবীজুড়ে হতা-ধর্ষণ-লুটপাট বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয় নাটকটির গল্পে। নাটবাঙলা প্রযোজিত এই নাটকটি মঞ্চায়নের আয় বন্যার্তদের সাহায্যার্থে ব্যয় করা হয়। উর্দুকবি আগা শাহী আলীর 'এ কান্ট্রি উইদাউট এ পোস্ট অফিস' কাব্যগ্রন্থ অবলম্বনে 'রিজওয়ান'-এর নাট্যরূপ দেন ভারতের প্রখ্যাত নাট্যকার অভিষেক মুখার্জি। নাটকটির অনুবাদ করেন ঋদ্ধিদেশ ভট্টাচার্য্য। সেপ্টেম্বরে মঞ্চস্থ নাটকটিতে তিতাস জিয়া তাঁর দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দিয়ে দর্শকদের হৃদয় কাড়েন।

বছরের প্রথম কোয়ার্টারে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হন বাংলাদেশি বর্ষীয়ান ঔপন্যাসিক কাশেম বিন আবুবাকার। ইসলামী ভাবধারার এই ঔপন্যাসিক দেশের মূলধারার গণমাধ্যমে বরাবরই আলোচনার বাইরে ছিলেন। শিল্পের মানদণ্ডে আবুবাকারের লেখনী কালোত্তীর্ণ নয়—এমনটা বলা হলেও সাধারণ পাঠকের কাছে তিনি দারুণ জনপ্রিয়।

বছরের শুরুতে বাঙালির মননশীলতার প্রতীক বইমেলাকে ঘিরে সরগরম থাকে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। গেল বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বইমেলা চত্বরে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ এবং বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়ের ঘটনাকে মাথায় রেখে এবারের মেলায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হয়। পুরো এলাকায় সিসি ক্যামেরার পাশাপাশি পুলিশের ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে সন্দেহজনক গতিবিধি লক্ষ রাখা হয়। মেলায় আগত বিদেশি এবং দেশি যেকোনো প্রকাশক বা লেখকের চাহিদা অনুযায়ী বাড়তি নিরাপত্তাও দেয় পুলিশ। তবে কিংবদন্তি কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণের পর এখনো বইয়ের বেস্ট সেলিং-এ তাঁকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি অন্য কোনো লেখক।

বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যিক প্রবাহ, সমকালীন জীবনসংস্কৃতি ও জীবনধারার নানা দিক উপস্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে ১০ দিনব্যাপী বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সিলেট শহরে সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন করা হয়। সেখানে বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিল্পীরা পারফরম্যান্স করেন। নভেম্বরে বিশ্বের বুকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তুলে ধরার প্রত্যয়ে রাজধানীতে সপ্তমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় ‘ঢাকা লিট ফেস্ট-২০১৭।‘ গেল সাত বছরে ৩৩টি দেশ থেকে তিন শতাধিক লেখক, সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ এই উৎসবে অংশ নেন। এ বছর এই উৎসবের বিভিন্ন অধিবেশনে প্রবীণ ও প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পাশাপাশি তরুণ এবং প্রান্তিক লেখকদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। পাশাপাশি শিশুদের জন্য রাখা হয় অঙ্ক শেখা, গল্প বলাসহ আরো কয়েকটি আয়োজন।

নভেম্বরেই দেশি-বিদেশি শিল্পীদের অংশগ্রহণে রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে তৃতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হয় ‘ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ফোক ফেস্ট’। মাছরাঙা টেলিভিশনে অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচারিত হওয়ায় অনুষ্ঠানস্থলে না গিয়েও দর্শকরা খ্যাতিমান ফোক শিল্পীদের পরিবেশনা উপভোগ করতে পারেন।

নানা ঝক্কিঝামেলা শেষে গেল কয়েক বছরের মতো বছরের শেষ সময়ে এসে অনুষ্ঠিত ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব‘। এ অনুষ্ঠানটি একদিকে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ শাস্ত্রীয়সংগীতের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার এবং শ্রোতা ও শিল্পী সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছে।

স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর ২৫ মার্চ দিনটিকে জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করেছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে চালানো হচ্ছে কূটনোতিক তৎপরতা। গেল বছর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ এবং সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি ইউনেস্কোর প্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে।

গেল বছর আমরা বেশ কয়েকজন প্রথিতযশা শিল্পীকে হারিয়েছি। তাঁরা তাঁদের নিজ কর্মগুণেই দর্শক-শ্রোতার মনে চির জাগরূক থাকবেন। দীর্ঘদিন রোগভোগের পর পপশিল্পী লাকী আখন্দ মারা যান এপ্রিলে। আগস্টে প্রয়াত হন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরুষ রাজ্জাক এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জনপ্রিয় শিল্পী আবদুল জব্বার। নভেম্বরে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন শুয়াচান পাখির অমর শিল্পী এবং শ্রোতাপ্রিয় বাঁশুরিয়া বারী সিদ্দিকী। নিশ্চিতার্থেই প্রয়াত এই শিল্পীদের জীবন ও কর্ম আগামীর মানুষকে পথ দেখাবে।

শত প্রতিকূলতা, ধর্মীয় উগ্রবাদীদের রক্তচক্ষু এবং পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণায় বিশ্বাসীদের বাধাগ্রস্ততা সত্ত্বেও বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি এখন পর্যন্ত তার পথ হারিয়ে ফেলেনি। বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে চলছে শিল্পের আনন্দরথ। শিল্প ও শিল্পীরা সরকারি প্রণোদনা পেলে আপন ঐতিহ্যকে সারথি করে নিশ্চিতই আরো এগিয়ে থাকত আধুনিক বাঙালিয়ানা। আসছে বছর আলোর পথের দিশারীদের চিনিয়ে দেওয়া পথে শিল্প ও সংস্কৃতি ফিরে পাক নতুন গতি।

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।