অভিমত

২০১৮ সালে আমাদের প্রত্যাশা

Looks like you've blocked notifications!

২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ শুরু হলো। একটি বছর খুব দ্রুতই শেষ হয়। কারণ বছরজুড়ে পৃথিবীতে এতো ঘটনা ঘটতে থাকে যে মানুষের পক্ষে সময়ের হিসাব-নিকেশ করে জীবন সাজানো কঠিন হয়ে ওঠে। আর কেবল পৃথিবী কেন এখন বিশ্বব্রহ্মা- খুব কাছের আমাদের। এজন্য অজানা বিশ্বলোকের ঘটনাও মানব জীবনকে প্রভাবান্বিত করে। তবু নতুন বছর নতুন প্রত্যাশায় জেগে ওঠে। জীবন নতুন সময়ের বৃত্তে আবর্তিত হয়। ২০১৮ সময়বৃত্তে শুভ কিছু অপেক্ষা করছে- এই স্বপ্নে মানুষ বড় বেশি আন্দোলিত হতে চায়। কিন্তু ভাল কিছু নির্মাণ করতে মানুষকেই নিরন্তর চেষ্টা করতে হয়। কিছু মানুষের কর্মপ্রচেষ্টায় এগিয়ে চলে পৃথিবী।

সেই মানুষই আমাদের আদর্শ। ভাল মানুষ, আদর্শ মানুষ ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পাবে এই প্রত্যাশা নিয়ে নতুন বছরের পথ চলা শুরু হলো। কিন্তু বাস্তবতা আরো বেশি নিষ্ঠুর। আমাদের মতো বেশি মানুষের দেশে সর্বত্র হয়রানি ও নাজেহাল হওয়া একটা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যদিও ডিজিটাল বাংলাদেশ জীবনকে অনেকটা সহজ করে দিয়েছে তবু সাধারণ মানুষের চলার পথ খুব সহজ-সরল নয়। একদিকে জঙ্গিবাদী তৎপরতা অন্যদিকে রাজনৈতিক সহিংসতা মানুষকে হরহামেশায় বিপন্ন করে। নতুন বছর বিপন্ন ও বিষণ্ণতা মুক্ত হবে এই প্রত্যাশা আমাদের।

২.

২০১৭ সালে বিশ্বজুড়ে বীভৎস সব ঘটনায় আমরা হতভম্ব ছিলাম। কেবল ২৪ আগস্ট থেকে মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রম করে ধেয়ে আসতে থাকা রাখাইন মুসলিমদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়া ছিল পৃথিবীর অন্যতম ঘটনা। মিয়ানমার ক্রমাগত ধিক্কৃত হলেও সেখানকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রতি তাদের সরকারের বোধোদয় হয়েছে বলে মনে হয় না। বরং চীন-রাশিয়া আমাদের বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও মিয়ানমারের আচরণকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের উৎকণ্ঠা ও উত্তর কোরিয়ার উপর্যুপরি পরমাণু বোমার হুমকি আমাদের দেশকেও স্পর্শ করেছে।

বিশ্বব্যাপী জঙ্গি সংগঠনগুলো কোণঠাসা হলেও অনেক দেশেই অভিনব পন্থায় মানুষ মারা হয়েছে। কোথাও বা গাড়ি চালিয়ে, কোথাও বা বোমা হামলায় হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। ২০১৭ সালে যৌন হয়রানীর প্রশ্নে মুখ খুলতে শুরু করেছেন বিশ্বের নারীরা; প্যারাডাইস পেপারসে আবারও ক্ষমতাশালীদের গোমর ফাঁস হয়েছে, আরবে বইতে শুরু করেছে উদরনীতির হাওয়া। কিন্তু নতুন মেরুকরণে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে যোগ হয়েছে নতুন উত্তেজনা। সিরিয়া ঘিরে ক্রেমলিন-পেন্টাগনের দাবা খেলা আর জেরুজালেম প্রশ্নে ট্রাম্পের নতুন পদক্ষেপের পর আরব বিশ্বে নতুন অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।  বেশ কয়েকটি জঙ্গি দল ২০১৭ সালে পাকিস্তানে বেশ কয়েক দফা হামলা চালিয়েছে। আদালতের আদেশে মুক্তি হয়েছে বিতর্কিত নেতা হাফিজ সাঈদের। আইনমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে হট্টগোল লাগিয়ে দিয়েছিল কট্টরপন্থি গোষ্ঠীগুলো। আর বিশ্বজুড়ে ভূমিকম্প, খরা ও বন্যার দুর্যোগ তো ছিলই।

বিশ্বব্যাপী নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্যে আমাদের দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেও বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক হামলা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতাদের অপকর্মের কারণে দুর্ণাম কুড়াতে হয়েছে দলকে। তবে জঙ্গিবাদ দমনে সাফল্য রয়েছে ব্যাপক বর্তমান সরকারের। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় এদেশের সক্ষমতা দেখেছি আমরা। বিশেষত বন্যা ও বন্যাত্তোর ফসলহানির কথা সকলের মনে আছে। দেশের ভেতর বড় বড় প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে। তবে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রশ্নফাঁসের একাধিক ঘটনা সরকারের শুভ প্রচেষ্টাকে মুখ থুবড়ে ফেলেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিউক্লিয়ার যুগে প্রবেশ করেছি আমরা। অন্যদিকে ডিজিটাল যুগে ফোর জি’তে অনুপ্রবেশ ঘটেছে আমাদের। যদিও বিচার বিভাগ নিয়ে নানামুখী সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল ২০১৭ সালে।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নানা অপঘটনার প্রভাব ছিল ২০১৭ সালে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন প্রণয়ন থেকে শুরু করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. হোসনে আরা বেগম জলি কর্তৃক হিন্দু সম্প্রদায়ের অপর এক অধ্যাপকের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক আচরণ বারবার আলোচনায় এসেছে। জালিয়াতি করে গ্রেড-২ পদোন্নতি নেওয়া ড. জলি কর্তৃক অপর এক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অধ্যাপককে নিচু শ্রেণির হিন্দু থেকে খ্রিস্টান হয়েছে বলে গালমন্দ করারও অভিযোগ আছে। কোনো অভিযোগেরই বিচার পাননি ভুক্তভোগীরা।

৩.

এসব এবং আরো অনেক ঘটনা মূল্যায়ন করে আমরা বলতে পারি, নতুন বছরের সূচনা মুহূর্তে আমাদের প্রত্যাশা ২০১৮ সাল থেকে জঙ্গিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমরা দেখতে চাই দেশের মানুষ নিরাপদে যার যার ধর্ম পালন করছে; বাঙালির আবহমান উৎসবসমূহ নির্বিঘ্নে উদযাপিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে আমরা নিজেরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছি। দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিজেদের আয় বৃদ্ধি করে সচ্ছলতা এনেছে নিজ পরিবারে। দেখতে চাই সুশাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ায় সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহ রক্ষা পাচ্ছে। অপরাধীদের দ্রুত বিচারের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। নতুন বছরে এসব আশা আর আকাঙ্ক্ষায় দুলে উঠুক আমাদের জীবন। কিন্তু জঙ্গিগোষ্ঠীর নানা অপতৎপরতার ইতিহাসও আমাদের মনে রাখতে হবে। জিয়া মুসা বাসার গান্ধীসহ ডজনখানেক শীর্ষ জঙ্গি নিয়ে পুলিশের ঘুম হারাম এখন, ছদ্মবেশে ঘুরছে জঙ্গি সদস্যরা, জায়গা বদল করছে ঘনঘন।

বিভিন্ন জায়গায় তাদের নাশকতার প্রস্তুতি ও ধ্বংসাত্মক কাজের সন্ধান পাওয়া গেছে। র‌্যাব ও পুলিশের অভিযানে অনেকে ধরাও পড়েছে। এই অভিযান কেবল নয় বিচার ও শাস্তি হওয়া পর্যন্ত আমাদের দেখতে হবে জঙ্গি সদস্যরা নির্মূল হচ্ছে কিনা। আবার কেবল আইনি প্রক্রিয়া নয় সামাজিকভাবে তাদের প্রতিরোধ করাও জরুরি। একইসঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মকা- বৃদ্ধি করে তরুণ সমাজকে দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে হবে। যেমন তরুণ সমাজ জেগেছিল ২০১৩ সালে।

সে সময় শাহবাগে ‘গণজাগরণ মঞ্চে’ তরুণ প্রজন্মের জমায়েতে উপস্থিত হয়ে জনপ্রিয় লেখক প্রফেসর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছিলেন, তরুণ সমাজ নিজেরাই জেগে উঠেছে। তরুণরা নিজেরাই ঠিক করেছে কী করতে হবে। একাত্তরেও এমনটি হয়েছিল। কাউকে বলে দিতে হয়নি। তিনি আরো বলেছিলেন, রায় ঘোষণার পর আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মনে হতাশা জমেছিল, ক্ষোভ জেগেছিল। এখন মনে দুঃখ নেই, হতাশা নেই তবে ক্ষোভ আছে। দুঃখ নেই এজন্য, রায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে আমার দেশের তরুণ প্রজন্ম। একাত্তরে তরুণরাই দেশ স্বাধীন করেছিল। ’৫২ সালেও বলে দিতে হয়নি তাদের কী করতে হবে। তিনি আন্দোলনরত সারাদেশের তরুণদের উদ্দেশে চিৎকার দিয়ে বলেছিলেন, এখন তোমরা যা সিদ্ধান্ত নেবে আমরা তোমাদের পেছনে পেছনে যাব। তোমরা আমাদের রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ উপহার দাও, কলঙ্কমুক্ত বাংলাদেশ উপহার দাও। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলো ন্যায়বিচার। আর ফাঁসি ছাড়া সব তরুণ যেন রাজপথ ছেড়ে না যায়- সেই আহ্বানও জানান তিনি। আর সেদিনের সেই প্রতিবাদ সমাবেশের পর বিচারিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ও কার্যকর হয়েছিল।

২০১৭ সালে ৩০ নভেম্বর মহামান্য পোপ ফ্রান্সিস বাংলাদেশে এসে নটরডেম কলেজে তরুণদের উদ্দেশে যে নির্দেশনা দিয়ে গেছেন তাতেও উজ্জীবনার কথা ছিল। তিনি ফেসবুকের আসক্তি ছেড়ে পরিবারকে সময় দিতে বলে গেছেন তরুণ সমাজকে। ঠিক সে কাজটিই করেছিল এখানকার তরুণ সমাজ কয়েক বছর আগে। তবে সেই ঘটনায় ছিল দেশপ্রেমের প্রকাশ। মূলত কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে কারাদণ্ডের রায় প্রত্যাখ্যান করে যারা সেই ৫ ফেব্রুয়ারি(২০১৩) ঢাকার শাহবাগে সমবেত হয়েছিল তারা কোনো রাজনৈতিক প্লাটফর্মের কর্মী নন। তারা মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান; যে মধ্যবিত্ত অনেকের কাছে সুবিধাবাদী শ্রেণি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সেদিন ছাত্র-ব্লগারদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল সাধারণ মানুষ। আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল ‘শাহবাগ স্কয়ার’। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাস বর্জন করে আন্দোলনে যোগ দিতে শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানানো হয়। শাহবাগের সেই আহবান ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যান্য এলাকায়।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বিভিন্ন ব্যানারে খণ্ড খণ্ড মিছিলে ভরে যায় সমগ্র দেশ। শহীদ মিনারের খোলা ময়দান পরিণত হয় প্রতিবাদ চত্বরে। সে সময় ‘জেগেছে মানুষ, ফুঁসছে দেশ। প্রাণে প্রাণে আজ একাত্তরের মৃত্যুঞ্জয়ী সাহস’ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। উজ্জীবিত অগণিত হাত আর গগণবিদারী স্লোগানে উচ্চারিত হয়েছে একটাই দাবি— ‘কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই, যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাই’। তপ্ত রোদের মধ্যে বসে সাধারণ শিক্ষার্থীরা জাগরণের গান গেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের এই চেতনা বর্তমান তরুণ সমাজের অন্যতম পাথেয়।

তরুণ সমাজের প্রত্যাশা ২০১৫ সালে পূর্ণতা পেয়েছে তিনজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ায়। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া যে গতিশীল হয়ে উঠেছিল তা সকলের কাছে স্পষ্ট। সেসময় সংশয় এবং সন্দেহ দূর হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ওপর আস্থাও প্রতিষ্ঠিত হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সারা বিশ্বের মিডিয়া উৎসুক হয়ে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়েছিল। কারণ এই বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশ আধুনিক ও সভ্য জাতির মর্যাদায় আসীন হয়েছে। বাঙালি হিসেবে গ্লানি মুক্তির দিন আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে- বিশ্বের মানবতাবাদী কর্মীদেরও প্রত্যাশা ছিল তাই। একইসঙ্গে বিশ্ববাসী দেখতে পেয়েছিল এই বিচার প্রক্রিয়া বানচালের জন্য জামাত-শিবিরের নাশকতার তাণ্ডব। ছাত্র-শিবির ও জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা একত্রিত হয়েছিল দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পায়তারা করে বিচার বাধাগ্রস্ত করার জন্য।

২০১৫ সালের ২৮ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দেয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ২০১৬ সালের ৮ মার্চ সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে সাজা বহাল থাকে একাত্তরের বদর নেতা মীর কাসেম আলীর। এদের সকলকেই ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলান হয়েছে। বলাবাহুল্য, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ ছিল স্বচ্ছ ও ন্যায়ভিত্তিক। এটি গঠন করা হয়েছে বৈশ্বিক আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত রোম স্টাটিউটের কাঠামো অনুসারে। ফলে এই বিচার প্রক্রিয়া উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ। যে কেউ গিয়ে বিচার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। উপরন্তু বিশ্বে বাংলাদেশের এই ট্রাইব্যুনালই একমাত্র যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইব্যুনাল, যেখানে বিবাদীরা বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আপিল করতে পারে।

৪.

২০১৭ সালে মুক্তচিন্তার দিশারি ও ব্লগার হত্যার তাণ্ডব কমে এসেছে। যদিও প্রগতিশীল ব্যক্তিদের হত্যার হুমকি থেমে নেই। এ বছর জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী তরুণ প্রজন্ম দেখেছে এতোদিন যাদের নেতা ও ধর্মপ্রাণ মুসলিম হিসেবে কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে আদেশ পালন করে মানুষ হত্যা করেছে; বোমা-গ্রেনেড মেরে মুক্তবুদ্ধির মানুষদের নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে; সেই কর্মীরা জানত না কত বড় অপরাধীদের পিছনে তারা তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিয়ে দিনের পর দিন সময় নষ্ট করছে। তাদের সেইসব তথাকথিত ধর্মপ্রাণ মুসলিম নেতারা ফাঁসিতে ঝুলেছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সারা বিশ্ববাসীর নজরে এসেছে। অপরাধগুলো ভয়াবহ। জামাতি নেতারা কখনো বাংলাদেশ চায়নি; তাই মুক্তিযুদ্ধের পরও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এইসব অপরাধী মানুষগুলো পাকিস্তান ও ইসলামের নামে বাঙালি জাতিকে চিরতরে অন্ধকারে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিল; তারা ধর্ষণ ও নির্মম হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা, প্ররোচনা এবং অনেকক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে একাত্তরের নয় মাস আমাদের পবিত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল।

আমাদের অকুতোভয় মুক্তিসেনাদের দৃঢ়তায় তাদের সব প্রচেষ্টাই ভেস্তে যায়। দেশ স্বাধীন হয়। আর দেশ স্বাধীন হয়েছিল বলেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে সামরিক শাসকদের সমর্থনে তার সুফল ভোগ করেছে একাত্তরের অপরাধীরাও। তাদের সন্তানরা নিজেকে শিক্ষিত করার সুযোগ পেয়েছে। উচ্চশিক্ষা পেয়েছে, তাদের সমর্থকরা স্বাধীন দেশে বিচরণ করছে। কেউ কেউ নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে, কিন্তু সুস্থ ধারায় তাদের ফিরে আসতে হবেই; দায়িত্ব নিতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বোঝানোর।

আসন্ন নির্বাচনের আগে হরতাল, পুলিশের ওপর হামলা ও নাশকতা ত্যাগ করতে হবে। কারণ এসব কর্মী-সমর্থকরা গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদ-সাঈদীর কবল থেকে বের হওয়ার সুযোগ পেয়েছে; এখন নিজেকে গড়ে তুলতে হবে সোনার বাংলা ও জয় বাংলার প্রতিধ্বনির মধ্যে দিয়ে। শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি তাদের পাথেয় হবে। কারণ তাদের নেতাদের পিছনের ইতিহাস ভয়ঙ্কর।

৫.

২০১৮ সালে আমরা যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চাই। এজন্য দরকার বর্তমান তরুণ প্রজন্মের প্রগতিশীল উদ্দীপনা। রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে তরুণদের সন্ত্রাস প্রতিরোধের আন্দোলনকে জোরদার করে তুলতে হবে। কারণ সরকারি দলের ওপর আস্থা থাকলেও স্বাধীনতা-বিরোধীরা এখনো সক্রিয়। যতদিন যুদ্ধাপরাধীদের সন্তান ও সমর্থকদের দাপট শেষ না হচ্ছে, তত দিন গণদাবিতে সোচ্চার থাকা দরকার। আর যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক ও নির্বাচন করতে অক্ষম জামায়াত-শিবিরকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তাদের অপতৎপরতা বন্ধের জন্য আমাদের ঐক্যের প্রয়োজন। বাংলাদেশের মাটিতে এই প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদীদের স্থান হবে না। তাদের শেকড় যতো গভীরে থাকুক তরুণ সমাজ তা উৎপাটন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অন্যদিকে কঠোর শাস্তি চাই জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর। তাদের বিচার প্রক্রিয়াও দ্রুত সম্পন্ন হতে হবে। যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গিবাদীদের বিরুদ্ধে এখন তরুণরাই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। নতুন বছরে প্রতিষ্ঠিত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে তারই প্রতিফলন দেখা যাবে।

লেখক : অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়