২০১৮
ভয়ংকর, না আরো ভয়ংকর?
২০১৭ সাল শেষ করে ২০১৮-এর প্রথম দিনে কাগজে-কলমে বিশ্বের জাতিসমূহের অভিভাবক সংস্থা জাতিসংঘের মহাসচিব এত কঠিন একটি বাস্তবতার কথা বলেছেন, যা সচরাচর এমন দায়িত্বের জায়গা থেকে বলা হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আশার ফানুস ওড়ান এমন দায়িত্বশীলরা। মানুষকে বলেন, এ বছর আমরা এই এই করেছি, ওই ওই করেছি, বিশ্ব অনেক স্থিতিশীল ছিল, সামনে আরো ভালো হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু অ্যান্তোনিও গুতেরেস নামের লাতিন ভদ্রলোক এসবের ধারেকাছে যাননি। তিনি পরিষ্কার বলেছেন, ‘২০১৭ সালে আমরা একটি ভয়ংকর খারাপ বছর পার করেছি। আগের বছরের চেয়ে এ বছর পৃথিবীতে যুদ্ধ ও সংঘাত বেড়েছে। মানুষের প্রাণহানি আমরা কমাতে পারিনি। দেশে দেশে মানবতার চরম লঙ্ঘন হয়েছে এ বছর। বাস্তবতা হলো, আগামী বছরেও আমি কোনো শান্তির বা স্বস্তির কিছু দেখতে পাওয়ার আশা করি না।’
যে সংস্থার গঠনই হয়েছে বিশ্বের যাবতীয় অশান্তি দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য, তার শীর্ষকর্তাই যখন এমন সরল স্বীকারোক্তি আর অশনিসংকেত দিয়ে রাখেন, তখন দর্পণে মুখ রাখতে গিয়ে সহসাই প্রশ্ন আসে মনে, নতুন বছরেও ঘটনাপঞ্জির চেহারা কি একই রকম থাকবে? আমরা কি পুরোনো বছরের মতোই প্রমাণ করব, মানুষ হিসেবে আমরা নিচের দিকে যেতেই ভালোবাসি? বিদেশ বলি আর দেশ বলি, মানবতার লঙ্ঘনেই কি আমরা ব্যস্ত থাকব? ৫২ সপ্তাহ পার করে ২০১৯ সালেও কি পেছনের আয়নায় ফিরে দেখব ২০১৭-এর সমান্তরাল ছবি? মিস্টার গুতেরেসের আশঙ্কা যদি সত্য হয়, তাহলে দর্পণের ছবির অবস্থা এবারের চেয়ে খারাপও হতে পারে।
দুঃখের বিষয় এই, বহির্দেশে যাই হোক তাই হোক, বাংলাদেশে কিন্তু মিস্টার গুতেরেসের আশঙ্কা সত্যি হতে শুরু করেছে বছরের একেবারে প্রথম সপ্তাহ থেকেই। সতেরো সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা আর টেলিভিশনে বছর শেষের যে ময়নাতদন্ত হয়েছে, তাতে ধর্ষণ ও শিশু হত্যার অনেকগুলো ঘৃণ্য চিত্র ছিল। চলন্ত বাসে ধর্ষণ শেষে হত্যার শিকার টাঙ্গাইলের রূপা কিংবা বগুড়ায় ধর্ষণের পর মা-মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা শেষ হওয়া বছরটিতে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ছিল নরসিংদীতে জীবন্ত কিশোরীকে পুড়িয়ে মারার মতো লোমহর্ষক ঘটনাও। বছর শেষে এসব ঘটনাকে স্মরণ যেমন করা হয়েছে, তেমনি প্রত্যাশা করা হয়েছে নতুন বছরটিতে এমন ঘটনা আমরা আর দেখব না।
কিন্তু বছরের ৫২ সপ্তাহের একটি সপ্তাহও এখনো পার হয়নি, আমাদের শুনতে হচ্ছে ধর্ষণ, হত্যা আর অমানবিক সব ঘটনার খবর। দুটি ঘটনা খুবই হৃদয়বিদারক হয়েছে। শরীয়তপুরে মাত্রই প্রাথমিকের গণ্ডি পার হওয়া এক কিশোরী শিকার হয়েছে ধর্ষণ আর করুণ মৃত্যুর। আর সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে অবসরপ্রাপ্ত এক শিক্ষকের জীবন চলার একমাত্র অবলম্বন পেনশনের টাকা ছিনিয়ে নিতে তাঁর গায়ে মল ছিটিয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা! টাকা তো নিয়েছেই। এসব ঘটনা শুনে আর পড়ে বছরের শুরুতেই মনটা বেদনায় ছেয়ে যায়। আমরা কি কখনো নতুন ভোর দেখব না? পুরোনো সব ঘটনারই পুনরাবৃত্তি চলতে থাকবে?
শরীয়তপুরের কিশোরী মেয়েটিকে ধর্ষণ করে এক বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি। এর ফলে তার গর্ভে চলে আসা অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানের অ্যাবরশন করাতে গিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় ওই ধর্ষক ব্যক্তিরই স্ত্রী। এদের সহযোগিতা করে আবার স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী। সমাজের কিছু অমানুষের এমন হীন তৎপরতায় শেষ পর্যন্ত ১২-১৩ বছর বয়সেই যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে পৃথিবী ছাড়তে হয় হতভাগ্য কিশোরীকে। মৃত্যুর আগমুহূর্তে কী মনে হয়েছিল ব্যথাতুর এই কিশোরীর, সে কি অভিশাপ দিয়ে গেছে নষ্ট এই পৃথিবীকে, যে তার শৈশব আর কৈশোরকে হত্যা করেছে গলাটিপে? কিংবা সে কি প্রশ্ন রেখে গেছে, তবে তাকে কেন আনা হলো এই ভ্রষ্টভূমে? সে কি তার মা-বাবা আর সমাজকেও কটাক্ষ করে গেছে? হয়তো।
চলে যাওয়া কিশোরীর মনে যাই আসুক, আমাদের মনে প্রশ্ন এসেছে ২০১৭ সালের অনাচার ২০১৮ সালেও চলমান থাকবে কি না? আমাদের সমাজ, আমাদের প্রশাসন, আমরা এসব অপকর্ম চলতে দিতেই থাকব কি না? আমরা কি ২০১৮ সালের রূপার মতো আরো আরো মেয়েদের চলন্ত বাসে ধর্ষিত হতে দেবো, নরসিংদীর আজিজাদের মতো কিশোরীদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারতে দেবো, নাকি আমরা কিছু একটা করব, যাতে এসব ঘটনা না ঘটে বা কম ঘটে? আমরা যারা কিছু করার ক্ষমতা রাখি এবং আমাদের যাদের কর্তব্যও বটে এসব ঘটনা রোধে কিছু একটা ব্যবস্থা নেওয়া, তারা কি পূর্বের ন্যায় অলস প্রহর কাটাব নাকি আরেকটু তৎপর হব, আরেকটু আন্তরিক হব? বেঁচে থাকা রূপাদের আর আজিজাদের বাঁচাতে, নিরাপদ কৈশোর দিতে, নিরাপদ জীবন দিতে আমরা কী করব? এসব প্রশ্ন করা এবং উত্তর খোঁজার দরকার আছে। ২০১৮ সাল পুরোটা এখনো পড়ে আছে। মাত্র একটি সপ্তাহ গেছে, ৫১টি বাকি আছে।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে ঘটেছে একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা। তবে কেবল একটি ছিনতাইয়ের চেয়েও এ ঘটনা আমাদের ব্যথিত করে ঘটনার শিকার ব্যক্তির সামাজিক অবস্থানগত কারণে। একজন শিক্ষক সারা জীবন যিনি দেশ গড়ার কারিগর বানিয়েছেন, অন্যের সন্তানদের শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষ হওয়ার দীক্ষা দিয়েছেন, তিনি ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন এবং তাও তাঁর নিজ এলাকায়। ছিনতাইকারীরা তাঁর ছাত্রদের কারো কারো সমবয়সী কিংবা সরাসরি তাঁর ছাত্রও হতে পারে। যেহেতু একই এলাকায় তিনি শিক্ষকতা করেছেন। প্রথম কষ্টের জায়গাটা হলো, এই সমাজের তরুণ প্রজন্ম একজন শিক্ষককেও হেনস্তা করতে ছাড়েনি। দ্বিতীয়ত, ছিনতাইয়ের সুবিধার জন্য এরা মহান এই শিক্ষাগুরুর গায়ে মল ছিটিয়ে দিয়েছে! এই প্রথম এমনটা শুনলাম। শুনে গা-টা গুলিয়ে ওঠে—এ কেমন প্রজন্ম আমাদের সমাজে বেড়ে উঠছে?
ঘটনার গভীরে গেলে বেদনার ক্ষতও যেন আরো গভীর হয়। এই শিক্ষক তাঁর এই পেনশনের টাকা দিয়েই অবসরোত্তর জীবনসংগ্রামে টিকে আছেন। নষ্ট প্রজন্ম তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে দুবেলা অন্নের জোগানটুকুও। এই শিক্ষক এখন একটি মাস কী খাবেন, কী পরবেন? পেনশনের টাকা পেলে একবেলা ভালো কিছু খাবারের আয়োজনের মতো ছোট ছোট অনেক স্বপ্নও হয়তো ছিল অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষকের। সেসব স্বপ্ন না হয় গেল, কিন্তু তাঁর গায়ে যে মলের গন্ধ মেখে দিল এই প্রজন্মের তরুণেরা—এই দুঃখ, এই ব্যথা কী করে সইবেন প্রবীণ মানুষটি? তিনি তো সারা জীবন সম্মানের সঙ্গেই বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছেন। শেষ জীবনে এই অসম্মানের গ্লানি তাকে কেন স্পর্শ করে গেল?
২০১৮ জুড়ে এমন ঘটনা রোধে আমাদের কী কী পরিকল্পনা আছে? আদৌ সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা আছে কি না? নাকি এ বছরের শেষেও জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের মতো ‘আরেকটি খারাপ বছর’ পার করার হা-হুতাশই আমাদের একমাত্র উপায় হবে? অপরাধীরা অপরাধ সংঘটনের উপায়ের অভাব বোধ করবে না আর আমরা উপায় খুঁজতে খুঁজতে উপায়হীন হওয়ার ভান করে পড়ে থাকব—এমনটা আর কত?
লেখক : সাংবাদিক, আরটিভি