রাজনীতি

কেমন হবে এবারের নির্বাচন?

Looks like you've blocked notifications!

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বর্তমান সরকার চার বছর মেয়াদ পূর্ণ করেছে ১২ জানুয়ারি। গত চার বছরে সরকার কী করেছে, বিরোধী দলগুলোর ভূমিকাই বা কী ছিল? আর জনগণই বা কী পেয়েছে? ঘুরেফিরে এ প্রশ্নগুলোই সামনে আসছে এখন। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ নিয়ে মানুষের বাড়তি আগ্রহ ছিল। অবশ্য তাঁর বক্তব্যে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু না থাকলেও রাজনীতিতে আলোচনার খোরাক জুগিয়েছেন।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচনের তোড়জোড় চলছে মহাজোট এবং ২০ দলীয় জোটের মধ্যে। ইউনিয়ন থেকে নতুন করে উত্তর ও দক্ষিণ সিটির সঙ্গে যুক্ত দুই এলাকার মানুষও নির্বাচনমুখর। মার্চ-এপ্রিলে সিলেট, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল—চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এরপর আছে গাজীপুরে। এ বছরজুড়েই নির্বাচনী ডামাডোল।

দশম সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ আলোচনার টেবিলে কিছু কৌশলী প্রস্তাব রাখলেও বিএনপি তা প্রত্যাখ্যান করে। এবারের দৃশ্যপট ঠিক উল্টো। বিএনপি নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় বসার ক্রমাগত দাবি জানিয়ে আসছে। আর তা প্রত্যাখ্যান করে চলেছে আওয়ামী লীগ।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশ না নেওয়া বিএনপির ভুল ছিল কি না, এ নিয়ে দলের ভেতরে ও বাইরে চার বছর ধরে চলছে নানা বিশ্লেষণ। অবশ্য এবার পুরোপুরি নির্বাচনীমুখী দল বিএনপি। খালেদা জিয়া বলেছেন, বিএনপিকে নির্বাচন থেকে বাইরে রাখা যাবে না।

রাজনৈতিক দলগুলো এখন নির্বাচনীমুখী। নির্বাচনী মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের পুরোমাত্রায় সক্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ জন্য দেশজুড়ে ১২ লাখ পোলিং এজেন্টকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কর্মসূচি শুরু হচ্ছে। অন্যদিকে, বর্তমান সরকারের সময় সারা দেশে নেতাকর্মীদের ওপর মামলা-হামলা, নির্যাতন ও গুম-খুনের তথ্য সংগ্রহ করেছে বিএনপিও। গুমের শিকার নেতাকর্মীদের ছবিসহ তালিকা তৈরি করে বই বের করার কার্যক্রমও শুরু করেছে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের একটি উইং।

‘তত্ত্বাবধায়ক’ শব্দটি উচ্চারণ না করে এবারও নির্দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে বিএনপি। তবে শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন করতে অনড় আওয়ামী লীগ।

এই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের ঘটনাপ্রবাহটি পাঠকদের একটু মনে করিয়ে দিতে চাই। ১৯৯৮ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম সলিমুল্লাহ। তখন হয়তো তিনিও বুঝতে পারেননি, দেড় দশক পর এই রিট হয়ে উঠবে জাতীয় রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহের প্রধান নিয়ন্ত্রক! এম সলিমুল্লাহর ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতেই আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকালেই ২০১১ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন এ বি এম খায়রুল হক। ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনোভাবেই সংবিধানসম্মত নয়। তবে দেশের সার্বিক প্রয়োজনে আরো একবার বা দুবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যেতে পারে। এ রায় ঘোষণার মাত্র দেড় মাস পরেই সংবিধানের যে সংশোধনী হয়, তাতে বাদ দেওয়া হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা।

বিএনপি নেতারা অবশ্য বিভিন্ন বক্তৃতায় বলে থাকেন, এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতেই ১৭৩ দিন হরতাল দিয়েছিল আওয়ামী লীগ।

গত নির্বাচনের আগে সরকারের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে ধারণা দেওয়া হয়েছিল, অল্প কিছুদিন পর একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেওয়া হবে। আন্তর্জাতিক চাপেই হোক কিংবা আবারও নির্বাচনের আশায় বিএনপি জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন থেকে সরে আসে। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দেন, পরের ট্রেন ধরতে, অর্থাৎ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে অপেক্ষা করতে হবে এই সংসদের পূর্ণ মেয়াদ পর্যন্ত। যার আর এক বছর বাকি আছে।

৫ জানুয়ারি ভোটের বর্ষপূর্তিতে আওয়ামী লীগ একাধিক সমাবেশ করলেও বিএনপিকে কিন্তু কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ নেতারা অনেকেই আক্ষেপ করেন, তাঁরা জনগণের জন্য এত কাজ করেছেন অথচ গণমাধ্যমে এর প্রচার নেই। তাঁরা নাকি বেছে বেছে সরকারের ত্রুটি ও ব্যর্থতাকে তুলে ধরে। অন্যদিকে বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, গণমাধ্যম পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, গুম ও খুনের ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা হয় না।

বিএনপি আজ মাঠে বা সংসদে—কোথাও নেই। তারপরও আওয়ামী লীগ ভরসা পাচ্ছে না। আমাদের রাজনীতিকরা কে কত বছর ক্ষমতায় থাকলেন, সেটি নিয়ে বড়াই করেন; কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনে কীভাবে জনপ্রিয়তা ধরে রাখবেন, সে নিয়ে মোটেই মাথা ঘামান না। গত দুই বছর আওয়ামী লীগের নেতারা গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে উন্নয়নের কথা বলে আসছেন। তবে আধুনিক যুগে গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন টেকসই হয় না। অন্যদিকে, আগামী এক বছর নানা রাজনৈতিক সমীকরণের মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে যেতে সরকারকে বাধ্য করতে পারবেন, এমন আশা করছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা।

বিগত নির্বাচনে বিএনপি না গিয়ে ভুল করেছে বলে আওয়ামী লীগ নেতারা জোর গলায় প্রচার করে থাকেন। তাঁদের এ কথার পেছনে যুক্তিও হয়তো আছে। কিন্তু সেইসঙ্গে এ-ও স্বীকার করতে হবে যে বিএনপিকে বাইরে রেখে নির্বাচন করায় বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ, ১৫৪টি আসনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায় মহজোটের প্রার্থী। সংসদের ভেতরে ও বাইরে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তাঁরা প্রশাসনকে নিজের মনে করছেন। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো আগামী নির্বাচনেও হয়তো খেলা চলবে সংসদে প্রধান বিরোধী দল আর সরকারের অংশ জাতীয় পার্টিকে নিয়ে।

বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাস বলে, বেশির ভাগ সময় রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, বিদেশিদের হস্তক্ষেপও বেড়েছে। অনেকের মতো বিএনপির উপলব্ধি ভারতের কংগ্রেস সরকার আওয়ামী লীগের পাশে ছিল বলেই একতরফা নির্বাচন করে জিততে পেরেছিল। ভেতরে ভেতরে আবারও নাকি বিদেশিদের কাছে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে তা আরো বাড়বে, সে ধারণা পাওয়া যায়।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টে দুর্নীতির অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুটি মামলার বিচারকাজ শেষ পর্যায়ে। এর একটিতে তারেক রহমানও আসামি। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা কিংবা আশঙ্কা, বিএনপির এ দুই শীর্ষ নেতা সাজা পেতে পারেন কিংবা তাঁদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সহিংসতার শঙ্কা থেকে যায়।

নিকট অতীতে দৃষ্টি ফেরালে স্পষ্ট হয় ১৯৯৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ সালের উদ্ভূত পরিস্থিতি কিংবা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে না আসার খেসারত দিতে হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোকে তো বটেই, দেশের মানুষকেও। ক্ষমতায় থাকার জন্য জনগণকে হাতিয়ার বানানোর অধিকার সংবিধান কাউকে দেয়নি। যদিও সংবিধানের দোহাই দিয়ে নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করেছে, যে যখন পেরেছে।

সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘(১) একজন প্রধানমন্ত্রী থাকিবেন এবং প্রধানমন্ত্রী যেরূপ নির্ধারণ করিবেন, সেইরূপ অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী থাকিবেন। (২) প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদিগকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করিবেন : তবে শর্ত থাকে যে, তাঁহাদের সংখ্যার অন্যূন নয়-দশমাংশ সংসদ-সদস্যগণের মধ্য হইতে নিযুক্ত হইবেন এবং অনধিক এক-দশমাংশ সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইবার যোগ্য ব্যক্তিগণের মধ্য হইতে মনোনীত হইতে পারিবেন। (৩) যে সংসদ-সদস্য সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হইবেন, রাষ্ট্রপতি তাঁহাকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করিবেন। (৪) সংসদ ভাংগিয়া যাওয়া এবং সংসদ-সদস্যদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে এই অনুচ্ছেদের (২) বা (৩) দফার অধীন নিয়োগদানের প্রয়োজন দেখা দিলে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার অব্যবহিত পূর্বে যাঁহারা সংসদ-সদস্য ছিলেন, এই দফার উদ্দেশ্যসাধনকল্পে তাঁহারা সদস্যরূপে বহাল রহিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।’

সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আগামী নির্বাচন নিয়ে চলা সংকট সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন পথ দেখিয়েছেন। সংবিধানের মধ্যে থেকেও নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলের নেতাদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়। শেখ হাসিনা সরকারপ্রধান। সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে বিএনপিকেও এই সরকারে রাখা সম্ভব। প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিতে পারে। দায়িত্ব রয়েছেন সুশীল সমাজেরও।

আগামী একটি বছর রাজনীতির মাঠে অনেক জল ঘোলা হবে। তর্ক-বিতর্ক হবে। দেশের মানুষ চায়, বিএনপিপ্রধান যে ক্ষমা ও ইতিবাচক রাজনীতির কথা বলেছেন, তার বাস্তবায়ন; আর আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দল, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিজের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে নিজেকে এবং বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছেন। তাঁর ওপরই অনেকটা নির্ভর করছে আগামী নির্বাচন কেমন হবে এবং রাজনীতির ভবিষ্যৎ। দেশের মানুষ আশা করতেই পারেন, আরেকটা ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি হবে না। আর জনগণ তাদের পছন্দের মানুষকে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবে।

 

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ।